শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ: বাস্তবতা ও করণীয়
Published: 21st, September 2025 GMT
অংশগ্রহণকারী
বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য;
সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
সুকোমল বড়ুয়া
অধ্যাপক,
পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেঘনা গুহঠাকুরতা
গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রফিকুল ইসলাম
সাবেক পরিচালক,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
বিশপ ফিলিপ অধিকারী
সভাপতি, ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশ
প্রশান্ত ত্রিপুরা
কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট
শুভ্র দেব কর
পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অর বিলিফ, বাংলাদেশ
রুমানা আমিন
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেম
জো ডিভাইন
অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, যুক্তরাজ্য ও গবেষক
মাথিল্ডা মেট্রট
গবেষক ও সিনিয়র লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, যুক্তরাজ্য
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকার কর্মী
মোর্শেদ হোসেন
কোঅর্ডিনেটর, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), ফেনী
নাজমুন নাহার নূপুর
সদস্য, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), লাকসাম
এস কে এ হাসিব
কোঅর্ডিনেটর, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি) বাগেরহাট
নরেন পাহান
সদস্য, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), নওগাঁ
জারিন মুনতাহা
সদস্য, তরুণ শান্তিদূতদের দল (ওয়াইপিএজি), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনাবদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য;
সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো জাতি হিসেবে আমরা গড়ে উঠতে পারিনি। নাগরিক হিসেবে আমাদের পরিচয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকেই আমরা সচেতন নই। ফলে অনেক সময় সমাজে সহিংসতা দেখা যায়। এখানে অতি রাজনীতি ও অপরাজনীতি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজ–সচেতনতার বোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত বিভাজনের মানুষদের একত্র করা জরুরি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিংবা আদিবাসী, যেই হোক, প্রত্যেকেই একই সমাজের সদস্য, একই দেশের নাগরিক—যদি এই উপলব্ধি জাগে সবার মাঝে যে সবাই মিলে সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, তবে কাজ এগোবে। এ জন্য অহিংস উদ্যোগ দরকার।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ বেশ কিছু অহিংস কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এতে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বোধ তৈরি হয়েছে, শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর তাঁরাই। এর প্রতিফলন দেখা গেছে নাসিরনগরের একটি ঘটনায়। ধর্মীয় সহিংসতার আড়ালে সেখানে রাজনীতি সক্রিয় ছিল। আমাদের প্রচেষ্টায় দুই সম্প্রদায় একত্র হয় ও কোড অব কন্ডাক্ট স্বাক্ষর করে। নিজেরাই দ্বন্দ্ব মেটানোর অঙ্গীকার করে। এই অভিজ্ঞতা অনুপ্রেরণামূলক হয়ে উঠেছে।
আমাদের স্বীকার করতে হবে—সাম্প্রদায়িকতা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান এবং এর মূল উৎপত্তি অনেকাংশেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিহিত। যদিও ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিল এবং তা অনেকাংশে কমিয়ে এনেছিল, তবু সাম্প্রদায়িকতা নানা রূপে, কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো প্রচ্ছন্নভাবে, আমাদের সমাজে ফিরে এসেছে। সমাধান একটাই—মানবতাবোধ ও সমাজ–সচেতনতার ভিত্তিতে সবাইকে একত্র করা। এলাকার প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে হবে। শান্তি-সম্প্রীতি কোনো প্রকল্প দিয়ে টেকসই হবে না; এটি টেকসই হবে তখনই, যখন আমরা সবাই একই সমাজের সদস্য হিসেবে দায়বদ্ধ হবো।
সুকোমল বড়ুয়া
অধ্যাপক, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শান্তি, সম্প্রীতি, সংঘাত, সহিংসতা—এসব আমার ভেতরের, আমার মনোবৃত্তির বিষয়। তাই ব্যক্তি হিসেবে আমাকে নিজেই এগুলো সমাধান করতে হবে; কারণ, করণীয় আমার হৃদয়বৃত্তি ও মনোবৃত্তির মধ্যেই বিরাজ করে।
আজকের গোলটেবিল আলোচনায় যে রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার কথা উঠেছে, তা গভীর উদ্বেগের বিষয়; কিন্তু আমার মনে হয় আরও গুরুতর কিছু বিষয় রয়েছে—সামাজিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক সহিংসতা, সংখ্যাগত বৈষম্য, ভূমিসংক্রান্ত সমস্যা, শিক্ষার বৈষম্য ও জেন্ডার ভেদাভেদ। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক সহিংসতা—পূজা-পার্বণ, উৎসবের প্রসঙ্গে অসহিষ্ণুতা—এগুলোও সংঘাতের জন্ম দেয়।
শ্রেণিসংঘাত—কৃষক ও মজুর, অফিস-আদালত ও ভাষা-সাহিত্যে বিরোধ, সবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁচড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নেয়। আমার মতে সবচেয়ে তীব্র হলো মনোজাগতিক সংঘাত; যদি আমরা নিজ নিজ মনোজগতে সহিংসতাকে নির্মূল করতে পারি, যদি সহমর্মিতা, প্রেম ও নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে পারি—তবেই অন্যান্য সংঘাত লাঘব হবে।
আমি শিক্ষক হিসেবে দেখেছি—একসময় প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা সহজেই দেওয়া হতো: ‘গুরুজনকে শ্রদ্ধা করো’, ‘নিজ জিহ্বাকে শাসন করো’—এমন বাণী শিশুর মননে মূল্যবোধ বপন করত। প্রাথমিক স্তর থেকেই অন্তর্মুখী, মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা জরুরি; না হলে কীভাবে দেশে সুনাগরিক তৈরি হবে? ১৯৭১–এর অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি—জাতি গঠনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান—দুই–ই দায়বদ্ধ।
বাংলাদেশ কারও জন্য বাইরের নয়; এটি আমাদের নিজেদের দেশ। শান্তি-সম্প্রীতি আমরা বিদেশ থেকে ধার করব না। যদি প্রত্যেকে নিজের হৃদয়ে দেশের ভালোবাসা, সমতা ও মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে সহিংসতা ও সংঘাতের বিস্তার সহজে রোধ করা সম্ভব হবে।
মেঘনা গুহঠাকুরতা
গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘর্ষের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আমার গবেষণায় দেখেছি, সংঘর্ষের প্রধান উৎস চারটি—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক (জীবন-জীবিকা, ভূমি বিরোধ), সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়। এগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে সংঘাতকে জটিল করে তোলে। সরকার প্রায়ই এসব ঘটনাকে কেবল রাজনৈতিক বলে আখ্যা দেয়, কিন্তু ভূমি বিরোধ বা জীবিকার বৈষম্য যখন সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়, তখন সেগুলো আলাদা করা যায় না।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমি চারটি স্তম্ভকে গুরুত্ব দিয়েছি—অংশগ্রহণ, সুরক্ষা, প্রতিরোধ ও পুনর্বাসন। অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুই নয়, বরং দলিত, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা সাধারণত আলোচনায় কম আসে, তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার সীমিত। আমার মতে, প্রতিরোধ সবচেয়ে জরুরি। পরিবার, স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যমে সহাবস্থানের চেতনা গড়ে তুলতে হবে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় কেন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়? এটি সব সময় ধর্মীয় কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। তাই যেকোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অরক্ষিত মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক গণহত্যার প্রবণতাও রুখতে হবে—মাতৃভাষা সংকট, নাম পরিবর্তন, সংস্কৃতির নিপীড়ন ইত্যাদি থামাতে হবে।
আমরা চাই সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি কেবল আচার নয়, দৈনন্দিন জীবনের চর্চা হবে। এমন একটি বাংলাদেশ আমরা চাই, যেখানে শান্তি, নিরাপত্তা ও মূল্যবোধ—সবাই ভাগাভাগি করে উপভোগ করবে।
রফিকুল ইসলাম
সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হিসেবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে যে দাঙ্গা বা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়, তা যতটা না ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ভূমিকা রেখেছে অপরাজনৈতিক শক্তি।
আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক ধর্মের মূল সৌন্দর্য কল্যাণকামিতা। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে যদি সত্যিকারভাবে লালন করা হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি ঘটার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি সে পথে হাঁটছি?
ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যায়বিচারহীনতা, সহিষ্ণুতার অভাব ও সদাচরণের অভাব। কোরআনে সমতা ও বৈচিত্র্যের ঐক্যের কথা বলা হয়েছে।
আমরা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। একসময় হিন্দু-মুসলিম গ্রামে আন্তরিকতা ছিল, এখন তা বাষ্পীভূত হয়েছে। এবার প্রশ্ন আসে, আমাদের কী করা উচিত? আমি মনে করি, আন্তধর্মীয় সংলাপ খুবই জরুরি। শুধু ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে নয়, যুব সম্প্রদায়কেও এতে যুক্ত করতে হবে।
আন্তধর্মীয় সংলাপ হলে ভুল–বোঝাবুঝি কমবে, ঘৃণা ও পূর্বধারণা দূর হবে। এ সংলাপ স্কুল, কলেজ, যুব ক্লাব এবং ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে ঘন ঘন আয়োজন করা দরকার। ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। ধর্মীয় নেতারা তাদের উপাসনালয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকেই এগিয়ে আসতে হবে। সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত মজবুত করতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে হলে এবং সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
বিশপ ফিলিপ অধিকারী
সভাপতি, ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশ
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় ও শান্তিপ্রিয় দেশ। এই দেশের ভিত্তি গড়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের ওপর। বারবার প্রমাণিত হয়েছে ঐক্য, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির শক্তিতে আমরা বড় বাধাও অতিক্রম করতে পারি।
তবে বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করা জরুরি। বিশ্বায়নের যুগে নানা চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসেছে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, সামাজিক বৈষম্য, সহিংসতা, মাদক, এমনকি ডিজিটাল মাধ্যমে বিভাজন—এসব সমস্যাই শান্তি ও সম্প্রীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি করণীয় সামনে আসে। প্রথমত, নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শিশু–কিশোরদের সহনশীলতা, শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্বের বোধে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, সব ধর্মেই যে শান্তি, ভালোবাসা ও মানবতার শিক্ষা আছে, সেই ইতিবাচক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
তৃতীয়ত, তরুণদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। সাহিত্য, প্রযুক্তি ও সমাজসেবার মাধ্যমে তাদের ঐক্যের দূত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তোলা জরুরি। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সবার জন্য সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের আলোচনার ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ভিন্ন মতকে প্রতিপক্ষ না ভেবে সম্ভাবনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যিশুখ্রিষ্ট বলেছেন, ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।’ আমরা যদি সেই
ভালোবাসা ও সেবাকে ধারণ করি, তবে বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশান্ত ত্রিপুরা
কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট
এফসিডিওর সহায়তায় দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এটির লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয়—এই তিন ধরনের সহিংসতা মোকাবিলা করা। আমরা চাই, সবাই যেন নিজ নিজ এলাকায় সমবেত প্রচেষ্টায় এই সহিংসতাগুলো মোকাবিলা করতে পারে; রাজনৈতিক দলগুলো মতপার্থক্য সত্ত্বেও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান খুঁজবে; ধর্মীয় হানাহানি কমানো যাবে স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে।
উল্লিখিত প্রকল্পে আমরা সারা দেশে ৭৪টি উপজেলার প্রতিটিতে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট পিস ফ্যাসিলিটেটর গ্রুপ (পিএফজি) বা শান্তি সহায়ক দল ও ২০ সদস্যবিশিষ্ট তরুণ শান্তি দূতদের দলের মাধ্যমে কাজ করছি। তারা নিজ নিজ এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতির প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলছে, বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড–বহুপক্ষীয় আলোচনা, আন্তধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি। তবে শান্তি শুধু একটি প্রকল্প বা সংগঠনের দায়িত্ব নয়, এটি সবার দায়িত্ব। আমরা আশা করব যে জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ সেপ্টেম্বর পালিত আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অ্যাক্ট নাউ’ অনুসরণ করে সবাই নিজ নিজ পরিসরে শান্তি ও সম্প্রীতির বিস্তারে আরও তৎপর হয়ে উঠবেন।
বাংলাদেশে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন। ৭৪টি উপজেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বিস্তারের যে উদ্যোগ চলছে, তেমন উদ্যোগ যদি আরও বিস্তার লাভ করে, তা দেশব্যাপী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শান্তি একটি বহুমাত্রিক বিষয়। এটি শুধু সরকার, রাজনৈতিক নেতা বা আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্ব নয়, প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। এটাও আমরা লক্ষ করেছি, একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য থাকতে পারে, যেমন নারী ও পুরুষদের মধ্যে। শান্তি ও সমতা নিশ্চিত করতে নারীদের, যুব সমাজের এবং স্থানীয় অন্য সবার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা জরুরি।
শুভ্র দেব কর
পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অর বিলিফ, বাংলাদেশ
হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে নানান ধর্ম, বর্ণ ও মতের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করছে। এ বৈচিত্র্যসম্পন্ন সমাজকাঠামো আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি, আমাদের বড় শক্তি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সেই শক্তির ভিত এখন কতটা মজবুত? বাস্তবতা মিশ্র। একদিকে মানুষ প্রতিবেশীর বিপদে ধর্ম-বর্ণ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, জাতীয় সাফল্যে আমরা একসঙ্গে উদ্বেলিত হই। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক গুজব, বিদ্বেষ ও ঘৃণার স্রোত বাড়ছে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এই বিভেদকে উসকে দিচ্ছে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা এসেছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তাই আসন্ন নির্বাচনের আগে–পরে বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন।
সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, বৈষম্য বিলোপ আইন ও দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন জরুরি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং সংসদে সংরক্ষিত আসন রাখা অপরিহার্য।
রুমানা আমিন
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেম
আমরা আইএফইএস থেকে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি এবং সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে কাজ করছি। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের তরুণ সদস্য ও কমিউনিটি মোবিলাইজাররা মাঠপর্যায়ে দ্বন্দ্ব নিরসন এবং শান্তি সংলাপ প্রসারের ক্ষেত্রে কাজ করেন, আর এ কাজটা আমরা দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে যৌথভাবে করে থাকি।
আমরা বিশ্বাস করি যে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি, এবং যেহেতু আমরা নির্বাচন নিয়ে কাজ করি, তাই আমরা নির্বাচনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করি। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করছি, যাতে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে পারে।
এ লক্ষ্যে আমরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগে সহায়তা দিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি যেন তাদের মাধ্যমে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, বরং আমাদের দেশে যাঁরা জাতিগত সংখ্যালঘু এবং সমতলের ও পাহাড়ের সংখ্যালঘু আছেন, তাঁদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি। আমাদের লক্ষ্য হলো, যাঁদের কাছে সহজে পৌঁছানো যায় না, তাঁরাও যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আইএফইএসের পক্ষ থেকে আমরা এই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আমরা আশা করি যে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে পাবে।
জো ডিভাইন
অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, যুক্তরাজ্য ও গবেষক
বাংলাদেশে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে যেটা বুঝেছি, স্বাধীনতার পর সবাইকে বাঙালি বলে পরিচয়ে পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে—তা হোক হিন্দু বা মুসলিম, হোক মান্দি বা চাকমা। এটা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে; কিন্তু তা সফল হয়নি। আমরা বিদেশি হিসেবে সবকিছু গভীরভাবে বুঝতে পারি না, তবে যতটুকু বুঝেছি, গতানুগতিক বহু প্রকল্পই সফল হয়নি; একইভাবে চললে আগামী ৩০ বছরেও হবে না। আমাদের নতুন ধারণা ও উদ্যোগ আনতে হবে।
নতুন উদ্যোগে রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, নাগরিক সমাজ, তৃণমূলসহ সবার সম্মিলিত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এগোতে হবে। এটি সহজ কাজ নয়, বরং অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু চেষ্টা না করলে কখনোই পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সহিংসতা হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু মানুষের ভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদিবাসী শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে না, অনেক এলাকায় কিছু মানুষ রেস্টুরেন্ট বা অন্যান্য জনপরিসরে আলাদা প্লেট ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ আলাদা, নিচু বা স্বতন্ত্রভাবে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই বাস্তবতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, নতুন উদ্যোগ ছাড়া এই ভয় ও বৈষম্যের বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়।
মাথিল্ডা মেট্রট
গবেষক ও সিনিয়র লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, যুক্তরাজ্য
গবেষণার জন্য প্রায় ১৫ বছর ধরে আমরা চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছি। তবে পাঁচ বছর আগে চরম দারিদ্র্যের মানচিত্র তৈরি করার সময় আমরা লক্ষ করেছি, যেসব এলাকায় দারিদ্র্য বেশি, সেখানেই জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি বাস করে।
আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে সহিংসতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছি। মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বা প্রভাবশালী সম্প্রদায় বলছে, ‘সমস্যা নেই, সবাই শান্তিতে বাস করে।’ কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা ছিল এর বিপরীত। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের মনে সহিংসতা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভয় বাড়ছে। ভয়ের এই বৃদ্ধি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে রাষ্ট্র, সেবা এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংযোগে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ‘কোনো সমস্যা নেই’—এ ধরনের বক্তব্য সত্যকে চাপা দিয়ে সমস্যার শিকারদের অদৃশ্য করে। আমরা প্রশ্ন করি, আলাদাভাবে বসবাস কি সহনশীলতা বাড়ায়? লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে সংখ্যালঘু নারীর বিচার প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা আছে।
রাজনীতি বা আন্দোলনের সময় কেউ আলোচনা করতে চায় না, কিন্তু কাঠামোগত অসহিষ্ণুতার বিষয়ে এখনই কথা বলা প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদদের উচিত এই অসহিষ্ণুতাকে শনাক্ত করা এবং তার প্রতিকার করা।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকার কর্মী
আজ আমরা রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা কখনোই এমন বাংলাদেশ চাইনি। আগে খারাপ ছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ে এসেও যদি এ রকম খারাপ হয়, তাহলে তা কাম্য নয়।
অন্যকে গ্রহণ করতে না পারার প্রবণতা যত দিন পর্যন্ত মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তন আসবে না, তত দিন এই দেশে শান্তি-সম্প্রীতি সম্ভব নয়। অন্য সংস্কৃতি, ভাষা ও সম্প্রদায়কে স্বীকার না করা পর্যন্ত দেশের শান্তি-সম্প্রীতি নিশ্চিত করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস উদ্যাপন কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়; এটি আমাদের এই বার্তা দেয় যে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য শান্তি বজায় রাখা জরুরি।
আমার কাছে মনে হয়েছে, রাজনৈতিক সহিংসতা, জাতিগত সহিংসতা ও ধর্মীয় সহিংসতা মোকাবিলা করাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়ে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা ঐক্য ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে। আমরা যদি এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে দেখতে পাই, তাহলে হয়তো আগামী দিনে সত্যিকারের সম্প্রীতিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। তবে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন।
মোর্শেদ হোসেন
কোঅর্ডিনেটর, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), ফেনী
শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্র। শিশুদের মনে যদি ছোটবেলায় সম্প্রীতির ধারণা তৈরি হয়, ভবিষ্যতে তা আরও দৃঢ় হবে। কিন্তু আমাদের বড় বড় অনেক রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি। তাই তাদের পরিকল্পনায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
পিএফজি ফেনীতে যে কাজগুলো করেছে, অর্থাৎ সবাইকে এক টেবিলে বসানোর যে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তার কারণে গত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতা তেমন হয়নি। অথচ ফেনীতে একসময় কোনো না কোনো সংকট বিরাজ করত। সেই জায়গাটিতে গত এক বছরে রাজনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সহিংসতা, ধর্মীয় সহিংসতা বা জাতিগত সহিংসতা তেমন হয়নি। ফেনীর ছয়টি উপজেলায় পিএফজির কার্যক্রম সফলভাবে চলেছে।
নাজমুন নাহার নূপুর
সদস্য, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), লাকসাম
লাকসামে পিএফজি গঠন করার সময় দেখা গেছে, একদল মানুষ কিছু করার ইচ্ছা রাখলেও তারা কোনো পথ পাচ্ছিল না। ভালো কাজ করতে গেলে শক্তি ও সহায়তার প্রয়োজন হয়, যা তখন পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে তরুণেরা এগিয়ে আসায় এখন অনেক কিছুই সহজে করা যাচ্ছে।
পিএফজি ও ওয়াইপিএজির হস্তক্ষেপে লাকসামে সহিংসতা অনেক কমে গেছে। বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং ও অন্যান্য সহিংসতার ঘটনা কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
সহিংসতার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দলীয় প্রভাবের কারণে যথাযথভাবে কার্যকর হয় না। এ ছাড়া সহিংসতা মোকাবিলার ক্ষেত্রে পিএফজি সদস্যরা বারবার হুমকির মুখে পড়েন। তাই বদলি ও রাজনৈতিক প্রভাব কমানো এবং সঠিক বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
এস কে এ হাসিব
কোঅর্ডিনেটর, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি) বাগেরহাট
২০১৪ সাল থেকে দেখছি যেসব এলাকায় পিএফজি ছিল, সেখানে মারাত্মক কোনো সহিংসতা ঘটেনি।
বাগেরহাটের পাঁচটি উপজেলা পিএফজির অন্তর্ভুক্ত। পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা বিধান, ধর্মীয় সহিংসতা বা সামাজিক মাধ্যমে সংঘটিত কোনো সমস্যায় আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করি। আমরা পিএফজির সদস্যরা মানববন্ধন, গোলটেবিল বৈঠক এবং স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায় অবদান রাখি।
আমাদের করণীয় হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ধর্ম, বর্ণ বা জাতিনির্বিশেষে যদি আমরা অসাম্প্রদায়িক, সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ এবং সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন দেখতে চাই, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, শান্তি রক্ষা করতে চাই—আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নরেন পাহান
সদস্য, শান্তি সহায়ক দল (পিএফজি), নওগাঁ
আমরা পিএফজি সদস্যরা স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কাজ করি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি হস্তান্তরের জন্য প্রজাস্বত্ব আইন আছে, যেখানে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া জমি হস্তান্তর করা যায় না। অনেকে এই আইন লঙ্ঘন করে জমি নিবন্ধন করে, যা পরে উত্তরাধিকারী কর্তৃক জমি দাবি করলে সমস্যা সৃষ্টি করে। পত্নীতলার একটি ইউনিয়নে একবার জমি বিক্রিকে কেন্দ্র করে জাতিগত সংঘাত সৃষ্টির উপক্রম হয়েছিল। পিএফজি সদস্য ও পুলিশ-ইউএনওর হস্তক্ষেপে সংঘাত থামানো হয় এবং আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত মালিককে জমি দেওয়া হয়।
আমার সুপারিশ হলো প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার ৮ উপধারার যথাযথ বাস্তবায়ন করা। জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া জমি বিক্রি না করা এবং অতীতে অনুমতি ছাড়া বিক্রি হওয়া জমি সংশোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
জারিন মুনতাহা
সদস্য, তরুণ শান্তিদূতদের দল (ওয়াইপিএজি), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট তরুণদের ইয়ুথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
প্রথমবার আমি ওয়াইপিএজির ত্রৈমাসিক সভায় গিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন ধর্ম ও রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এক টেবিলে বসে আলোচনা করছে। নাসিরনগরে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল, যা ফেসবুকের কারণে বিস্তার লাভ করেছিল। সেটি কমাতে তরুণ নাগরিকদের উদ্যোগ খুবই কার্যকর হয়েছিল।
আমার অভিজ্ঞতা দেখায় যে মানসিকতার পরিবর্তন এবং সংলাপই শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার মূল উপায়। আমাদের সব জাতিগত, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পার্থক্য অতিক্রম করে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন, যাতে সমাজে সহিংসতা কমে এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
সুপারিশনাগরিকদের পরিচয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্মুখী, মূল্যবোধ-ভিত্তিক শিক্ষা প্রয়োজন।
সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্বাচনী, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থায় ন্যায্যতা ও রাজনৈতিক প্রভাব কমানো প্রয়োজন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নেতাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তঃধর্মীয় সংলাপে যুক্ত করতে হবে।
যুব সমাজকে শান্তি, সংলাপ ও সহাবস্থানে যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও বিভাজন প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক প র ইউন ভ র স ট ন শ চ ত করত র জন ত ক স ন শ চ ত কর য ক তর জ য সহমর ম ত আম দ র স জ ত গত স সহ ষ ণ ত অন য ন য ক ত করত ক জ করছ র সদস য ব স তবত ব যবস থ প রকল প জনগ ষ ঠ একসঙ গ ক ত কর ব স কর ক জ কর লক ষ য দ র সব বস থ ন উদ য গ র জন য স রক ষ দ র পর অব ব থ ত ক সহ ক র কর সমস য ন করত র ওপর জ করত উপজ ল র সময গ রহণ প এফজ ধরন র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ, স্বামী পলাতক
গাইবান্ধায় শিউলী বেগম নামে এক গৃহবধূকে গলা কেটে হত্যার পর মরদেহ বাড়ির পাশের একটি কলাবাগানে ফেলে পালানোর অভিযোগ উঠেছে স্বামী ফরিদ উদ্দীনের (৪৫) বিরুদ্ধে।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টার দিকে উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কাটাবাড়ী গ্রামের বাগদা বাজার টাওয়ার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শিউলী বেগম কাটাবাড়ী গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে ফরিদ উদ্দীনের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি একই ইউনিয়নের বোগদহ সদর কলোনী এলাকার শরীফ ড্রাইভারের মেয়ে। তাদের সংসারে একটি ৮ বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। প্রায় ১২ বছর আগে শিউলী ও ফরিদের বিয়ে হয়। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন ফরিদ। ফরিদের প্রথম স্ত্রীর ঘরেও দুই সন্তান রয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই নানা কারণে শিউলীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন ফরিদ। শনিবার সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। এক পর্যায়ে ফরিদ শিউলীকে মারধর করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ বাড়ির পাশে কলাবাগানে ফেলে রেখে পালিয়ে যান তিনি। প্রতিবেশীরা বিষয়টি দেখে পুলিশকে খবর দেন।
খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) রশিদুল বারী।
নিহত শিউলীর বাবা শরীফ মিয়া ড্রাইভার ও স্বজনদের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকে প্রায় সময় মেয়েকে (শিউলি) বিভিন্ন অজুহাতে গায়ে হাত তুলতেন ফরিদ। শিউলীকে হত্যা করে বাড়ির পাশের কলাবাগানে ফেলে রেখে পালিয়েছে সে। দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তাদের।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গোবিন্দগঞ্জ থানার (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা (ওসি) বুলবুল ইসলাম জানান, ফরিদের প্রথম স্ত্রী রয়েছে। শিউলী ফরিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হতো। নিহতের গলা ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রবিবার সকালে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ফরিদ ঘটনার পর থেকেই পলাতক। তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে।
ঢাকা/মাসুম/এস