আজ মহালয়া। সনাতন ধর্মের ভাষ্যমতে, দিনটি পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনার প্রতীক। মহালয়ায় হিন্দু সম্প্রদায় তাঁদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করেন, তাঁদের শান্তি কামনা করেন এবং একই সঙ্গে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানান।

মহালয়াকে কেবল আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান নয়; বরং সনাতনী সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সামাজিক সংহতির এক গভীর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ভোরের আলো আর শিশিরসিক্ত প্রভাতে এ মহালয়ার আচার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রত্যেক প্রজন্মকে অতীতের শিক্ষার আলো ধরে সমাজের নৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা প্রতিবছরের মতো এবারও ভক্তি, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্প্রীতির মিলনক্ষেত্র হিসেবে উদ্‌যাপিত হবে। এ উৎসবের মর্যাদা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র, সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অশুভ চক্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে প্রতিমা ভাঙচুরের মাধ্যমে অনৈতিক প্ররোচনা সৃষ্টি করছে। গত কয়েক দিনে কুষ্টিয়া, গাজীপুরসহ কয়েকটি জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে, যেটি উদ্বেগজনক। এ কর্মকাণ্ড শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করে না; বরং সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংহতিতেও ক্ষতি করে। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের ৫টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪টি জেলাকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ নামের একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। তাই দুর্গাপূজায় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎপরতা এ প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। কমিশনারের নেতৃত্বে ডিএমপি ইতিমধ্যে ২৫৮টি মণ্ডপে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে মণ্ডপভিত্তিক পাহারা, পৃথক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, প্রতিমা বিসর্জনের দিন সার্বিক তৎপরতা, সিসিটিভি স্থাপন, অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রতিরোধে নজরদারি। এটি প্রমাণ করে, সামাজিক ন্যায় ও আইনশৃঙ্খলার অটল ভিত্তি রক্ষায় রাষ্ট্র সচেতন ও সংবেদনশীল ভূমিকা গ্রহণ করছে।

একইভাবে সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার মণ্ডপে নিরাপত্তার আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি মণ্ডপে পর্যাপ্ত পুলিশি পাহারা, সিসিটিভি নজরদারি, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, জরুরি সেবা সংযোগ ও দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তবে সরকারের একক তৎপরতা যথেষ্ট নয়, স্থানীয় কমিউনিটি, পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ এবং সাধারণ নাগরিকদের সচেতন অংশগ্রহণ সমানভাবে অপরিহার্য। প্রতিটি মণ্ডপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

দার্শনিকভাবে ভাবলে দুর্গাপূজা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, এটি মানবসমাজের নৈতিক সংহতি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক জীবন্ত প্রতীক। প্রতিমা ভাঙচুর বা অশুভ প্ররোচনার বিরুদ্ধে সক্রিয় তৎপরতা মানে কেবল আইন রক্ষা নয়; বরং সমাজের নৈতিক ক্ষেত্রও রক্ষা করা। নাগরিকের সচেতনতা ও রাষ্ট্রের সংহত তত্ত্বাবধানের সমন্বয় নিশ্চিত করলে উৎসবের মর্যাদা ও সামাজিক সম্প্রীতি অটুট থাকবে।

আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব সুস্পষ্ট। সেটি হলো কেউ যেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পবিত্রতা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূক্ষ্ম সূত্রকে বিপন্ন করতে না পারে। রাষ্ট্রের নীতি ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত কার্যক্রম যদি জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার সঙ্গে মিলিত হয়, তবেই আমরা দেখতে পাব উৎসবমুখর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুর্গাপূজার চিত্র। তখন এটি কেবল ধর্মীয় উৎসবের মহিমা বহন করবে না; বরং মানবসমাজের নৈতিক সংহতি, সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামাজিক সুষমতার স্থায়ী প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ ক স হত

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাদ্রোৎসব ‘কারাম’

বাঙালি ছাড়াও এ দেশে বসবাস করে আরও অনেক জাতি। যারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নামেই অধিক পরিচিত। ‘কড়া’ তেমনই একটি জাতির নাম। যারা এ দেশে টিকে আছে সবচেয়ে কমসংখ্যক মানুষ নিয়ে। এদের একমাত্র গ্রামটি দিনাজপুরে, বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়িতে। সেখানে বাস করে মাত্র বিশের অধিক পরিবার।

ভাদ্র মাস। গরমে চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যেই রওনা হয়েছি ওই গ্রামে। তাদের একটি লোকোৎসব দেখব বলে।

এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্রমাসের চাঁদের পূর্ণিমায় এ উৎসব পালন করে তারা। তাদের বিশ্বাস, এটি তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্যলাভের উৎসব। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে এ উৎসবে বিশেষ আচার পালন করে কড়ারা। এ গাছ তাদের কাছে অতি পবিত্র। গাছের ডাল কেটে আনার কাজটি করেন যুবকেরা।

গ্রামটিতে যখন পৌঁছাই, তখন বিকেল হয় হয়। গোত্রপ্রধান বা মাহাতো জগেন কড়ার সঙ্গে আলাপ চলে। খানিক পরই হইচই। এক যুবক পার্শ্ববর্তী ধর্মপুরের গহিন শালবন থেকে কেটে এনেছেন ‘খিল কদম’গাছের একটি ডাল। আমরাও তখন মিশে যাই লোকাচারে।

এ দেশে সবচেয়ে কমসংখ্যক মানুষ নিয়ে টিকে থাকা ক্ষুদ্র ‘কড়া’ জাতিসত্তার প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্রমাসের চাঁদের পূর্ণিমায় এ উৎসব পালন করে তারা। তাদের বিশ্বাস, এটি তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্যলাভের উৎসব। 

ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে আগে থেকেই বাঁশ ও শাপলা ফুল দিয়ে তৈরি করে রাখা ছিল মাড়োয়া। অতঃপর ডালটিকে বরণ করে মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।

সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিটি বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আঙিনা পরিপাটি করে সাজানো হয়। এ সময় ঘরে ঘরে তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যায়। কড়ারা বলে, তেলের পিঠা ছাড়া কারাম উৎসব হয় না।

পূজাস্থলে ‘খিল কদম’ গাছের ডাল নিয়ে আসার আনুষ্ঠানিকতা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছয় ম্যাচে ছয় জয় রিয়ালের, বার্নাব্যুতে উৎসব হলো অন্য কারণেও
  • ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাদ্রোৎসব ‘কারাম’
  • বিকাশ, নগদ, রকেটসহ এমএফএস প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ঠিক আছে কি না, দেখতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক
  • ‘মাজারের অপরাধডা কী, তাঁরায় মাজারে হামলা করলো ক্যারে’
  • মতবিনিময় সভা: নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপনে সবার সহযোগিতা আহ্বান
  • ঢাকাসহ সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ২৯
  • বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ বাম জোট, আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
  • সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হবে: ডিএমপি কমিশনার
  • ওয়েবসাইটের কুকিজ সংগ্রহের অনুরোধ ভালো না খারাপ, নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা