সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, সাধুর মতো দেখতে যাঁদের অনেকে পাগলও বলে থাকে, এমন একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে তিনজন লোক ধরে চুল কেটে দিচ্ছেন জোর করে। সাধু মানুষটি অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।

ওই তিনজন লোক কারা? ভিডিও দেখে শুধু আমরা এতটুকু জানতে পারছি, তাঁরা পোশাক-আশাকে চেহারা-সুরতে ইসলাম বেশধারী। সম্ভবত কোনো সংগঠনের হয়ে কাজ করেন। তবে দেখতে শক্ত সামর্থ্যবান। তাঁদের সঙ্গে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না বয়স্ক লোকটি। যেভাবে জোর করে ধরে তাঁর চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হলো, সেই দৃশ্য কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ভুক্তভোগী মানুষটি শেষ দিকে বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস।’ প্রকারান্তরে আল্লাহর কাছেই বিচার দিলেন তিনি। গরিবের আশ্রয়ের জায়গা তো ওই একটাই।

কয়েক দিন আগে এমন আরও একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যাঁরা চুল কেটে দিচ্ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী লোকটি বলছিলেন, ‘চুল কাটছিস, দাঁড়িও কাটতে হবে।’ তখন তাঁরা বলছিলেন, ‘তুমি তো নামাজ-কালামই পড়ো না, দাঁড়ি কাটলেই কি আর চুল কাটলেই কি!’

ঘটনা দুটির ভিডিও প্রায় একই সময়ে ছড়িয়ে পড়লেও এ ধরনের ঘটনা গত কিছু মাস নিয়মিতভাবেই আমাদের সামনে আসছে। কয়েক বছর আগে এসব ঘটনা শুরু হলেও গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত নানা পরিস্থিতিতে এর মাত্রা যেন বেড়ে গেছে। ফলে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়েছে।

শুরুতে একটা দলের বেশ কয়েকটি ভিডিও বেশ প্রচার হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেখানে তাঁরা লোকেদের ধরে ধরে চুল কেটে দিয়ে, গোসল করিয়ে, নতুন জামাকাপড় পরিয়ে, সেই কাজের ভিডিও করে আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকে প্রকাশ করতেন। এ ঘটনাগুলো ফেসবুকে কনটেন্ট আকারে প্রকাশ পেলে বেশ ভিউ হয়, মানুষ আলোচনা করে, আর তাতে যিনি প্রকাশ করেন, তাঁর কিছু টাকা আয় হয়।

আগেই বললাম এ ধরনের কনটেন্ট নতুন নয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বেশ অনেক আগ থেকেই দেখেছি। পশ্চিমের দেশগুলোতে অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরও এই কাজগুলো করেন, তাঁরা গৃহহীন মানুষদের কাছে যান, তাঁদের অযাচিতভাবে বেড়ে ওঠা চুল-দাঁড়ি কেটে একটা ভদ্রস্থ চেহারা দেন, জামাকাপড় এবং আর্থিক সহায়তাও করেন। সেই ভিডিওগুলো ছড়িয়ে যায়। কারণ, এ ব্যাপারটার মধ্যে দুপক্ষেরই একটা সম্মতি থাকে, সেই সম্মতির মাধ্যমে একজনের মুখ হাসি ফুটে ওঠাটা দেখতে সুন্দর ও আরামদায়ক। আমিও এমন ভিডিও সামনে পড়লে দেখি।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যায়, যখন আপনি কারোর সম্মতির বাইরে গিয়ে তাঁর ওপর জবরদস্তি করেন তখন। আমাদের দেশীয় যাঁরা কনটেন্ট বানাচ্ছেন, তাঁদের কেউই সম্মতির ধার ধারেন না। বরং একজনকে টার্গেট করে, বেশ অনেকটা ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরে, তারপর জবরদস্তি করে চুল কেটে দেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটাই প্রবলভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কাউকে টার্গেট করে, দৌড়ে ধরা, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুল কাটা—সবটাই।

কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সেভাবে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতার বালাই নেই বলেই যে কেউ ইচ্ছেমতো কনটেন্ট তৈরি করছেন, আর তাতে অন্যকে আহত করছেন।

এখন অনেকে ভবঘুরে মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য এমন কাজ করতে পারেন, কিন্তু এমন জোরদবস্তি করা তো কোনোভাবেই উচিত হবে না, যা অন্য যে কোনো স্বাভাবিক মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। আর কনটেন্ট তৈরি করে ‘ভিউ ব্যবসা’ করাও উদ্দেশ্য হবে না।

২.

যাঁরা এই কনটেন্টগুলো তৈরি করছেন, তাঁদের কেউ কেউ ইসলামি কোনো সংগঠন বা সমাজসেবামূলক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ কেউ তা-ও নয়। কিন্তু ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো দেখে খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, তাঁদের প্রত্যেকেরই টার্গেট থাকে কোনো ভবঘুরে, মাজার-খানকা ঘরানার ফকির বা পাগল বেশধারী মানুষকে ধরে নিয়ে তাঁদের চুল কেটে দেওয়া এবং এ কাজটাকে ভালো কাজ হিসেবে প্রদর্শন করা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কেউই সম্মতি-অসম্মতির ধার ধারছেন না। আর একই সঙ্গে কিছু মানুষও এই চুল কেটে দেওয়ার পক্ষে সমর্থন করছেন। এর ফলে তাঁরা এ ধরনের কনটেন্ট বানাতে আগ্রহী হচ্ছেন আরও বেশি।

কিন্তু এ ধরনের কনটেন্ট এবং মানুষের সমর্থন সমাজের মধ্যে ভবঘুরে, ফকির বা পাগলবেশে যাঁরা থাকেন কিংবা একই সঙ্গে বললে যাঁরা সমাজের সব মানুষের মতো করে চলেন না—তাঁদের প্রতি একটা বিরূপ ধারণা তৈরি করছে ও তাঁদের জীবনকেও বিপন্ন করে তুলছে। অথচ এই কাজ সংবিধান পরিপন্থী, মানবাধিকার পরিপন্থী অপরাধ। এই অপরাধের নিরোধকল্পে এক বছর ধরে ফেসবুকে, পত্রপত্রিকায় নানাভাবে অনেকেই এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে বলেই চলেছেন, তবু কোনো কাজ হচ্ছে না, সরকারেরও কোনো হেলদোল নেই।

৩.

কেবল চুল-দাঁড়ি কাটাই-ই না, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর আমরা আরও উপদ্রব দেখেছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যৌনকর্মীদের পিটিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন এক লোক, সেটা দিয়েও কনটেন্ট তৈরি করেছিলেন তিনি।

পিকনিক করতে যাওয়া নারীদের পোশাক পছন্দ না হওয়ায় তাঁদের মারধর করা হয়েছিল লঞ্চের ডেকে, অনেক মানুষের সামনে। নারীর সঙ্গে যৌন হেনস্থামূলক আচরণ করে ব্যক্তিকে ফুলের মালা পরিয়ে থানা থেকে বের করিয়ে নিয়ে আসার মতো নানা কাণ্ড ঘটেছে।

প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঘটনাগুলোকে ভালো-খারাপের পাল্লায় ফেলে খারাপ দমনের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিছু লোক এবং নানাভাবে তাঁদের কিছু সমর্থক জুটেও যাচ্ছে, এমনকি রাজনৈতিকভাবেও। ফলে বিপন্ন লোককে আরও বেশি বিপন্ন করে তোলার ঘটনা ঘটছে।

৪.

এই বিপন্ন করে তোলার রাজনীতি শুধু ব্যক্তিতেই আটকে নেই। আক্রান্ত হচ্ছে মাজারগুলোও। মাজারে শিরক হয়, মদ-গাঁজার আসর হয়—এসব বলে একটা গোষ্ঠী চব্বিশের ৫ আগস্টের তারিখের পর মাজার ভেঙেই চলেছে।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত—ছয় মাসেই কেবল ৮০টি মাজার ভাঙচুর হয়েছে। দুদিন আগেও নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলা সদর ইউনিয়নের আমানিপুর গ্রামে মরহুম কফিল উদ্দিন শাহ্ নামের এক পীরের আস্তানা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনার বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং পাশের সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের তিন শতাধিক লোক নৌকায় করে এসে আস্তানাটি ভাঙচুর করে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছে। খবর প্রথম আলোর।

তার আগে কুমিল্লার হোমনার কফিল উদ্দিন শাহ্‌রই মূল মাজারসহ আশপাশে আরও তিনটি মাজারে হামলা ও ভাঙচুর চালায় একদল লোক। হামলা চালানো হয় ফেসবুকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করার অভিযোগে। অথচ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

নেত্রকোনার ঘটনায় পুলিশ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে, কিন্তু কারও নাম নেই সেখানে। কুমিল্লায় হোমনার হামলার ঘটনায়ও কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মাজার ভাঙার পক্ষেও মানুষ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি আমাদের অনেক বুঝদার ভাইও প্রশ্ন করছেন, মাজারে ঘটে যাওয়া যে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড না হলে কীভাবে থামানো যাবে? কিন্তু সেইটা থামানোর কর্তৃত্ব এই রাষ্ট্রে তাঁকে কে দিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর আবার তাঁরা দিতে পারেন না।

৫.

কারও ধর্ম বোঝাপড়া, ভালো-খারাপের মানদণ্ড, সামাজিক দায়বোধ—একেকজনেরটা একেক রকম। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ধর্মভেদে ভিন্নতা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু জোরপূর্বক ধরে একজনের ওপর আরেকজনের চিন্তা চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে আপত্তিজনক ঘটনা ঘটে, সেগুলোর প্রতিফলনই হচ্ছে চুল কাটার এসব ভিডিও। কারও কাছে কোনো বিষয় অপরাধ মনে হলে সেটার জন্য আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ আছে, সেখানে অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে। রাষ্ট্র তার বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু নাগরিকের কোনোমাত্র অধিকার নেই, অন্য নাগরিকের ওপর জবরদস্তি করা, তার ওপর জোর খাটানো, চুল কেটে দেওয়া, কোনো মাজার ভাঙচুর করার।

এই অধিকার যেমন মানবাধিকার কিংবা সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে নেই, একইভাবে ধর্মের দিক থেকেও নেই। ধর্ম কারোর ওপর এমন বোধ চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন, ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’ ফলে ধর্মের দায় দিয়ে আপনি কারও ওপর কোনো ধরনের আঘাত করার অধিকার রাখেন না।

৬.

সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এই অন্তর্বর্তী সরকার এসব ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কোথাও একটা জমায়েত, কিছু সংখ্যায় মানুষের মতামত একত্র হলেই সেটাকে ভয় পাচ্ছে সরকার, যেহেতু এই সরকারের কোনো নিজস্ব জনমত নেই, ফলে সবাইকেই নিজের জনমত ভেবে, সবাইকেই আশকারা দিচ্ছে। এতে করে ধর্মীয় ও পরিচয়ে যাদের সংখ্যা কম, তাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ তার মতামত চাপিয়ে দিচ্ছে।

এই চাপিয়ে দেওয়া ভালো কিছু বয়ে আনবে না। কারণ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও লড়াই ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। বড় গোষ্ঠী থেকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ থেকে কিছু পরিবার, তা থেকে একটি পরিবার, সেখান থেকে একজন মানুষ।

এই সংকোচন থেকে বাঁচতে আমাদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সমাজের চিন্তা, আদর্শ, পরিচয়গত বিভিন্নতার গুরুত্বগুলো অনুভব করা। মানুষকে মানুষের মর্যাদা। যার যার অধিকার সুরক্ষায় আওয়াজ তোলা। নতুবা আমরা সবাই আক্রান্ত হব।

মীর হুযাইফা আল মামদূহ লেখক ও গবেষক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কনট ন ট ত র র কনট ন ট জবরদস ত এ ধরন র ফ সব ক আম দ র আল ল হ সরক র করছ ন র ওপর র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

আজ মুক্তি পাচ্ছে নতুন দুই সিনেমা, হলে আছে আরও ৭ সিনেমা

কুয়াকাটায় একদল ব্যাচেলর
করোনার সময় দীর্ঘদিন ঘরবন্দী ছিল মানুষ। বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে কুয়াকাটায় ঘুরতে যায় একদল ব্যাচেলর। সেখানে নারীদের একটি দলের সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যায়। তাদের কেন্দ্র করেই রোমান্টিক, কমেডি ও থ্রিলারের মিশেলে তৈরি হয়েছে নাসিম সাহনিকের ‘ব্যাচেলর ইন ট্রিপ।’

সিনেমাটির শুটিং শুরু হয় ২০২২ সালের শেষ দিকে। প্রথম লটে এক সপ্তাহের মতো শুটিং করার কথা থাকলেও বাজেটের সমস্যায় দুই দিন পর শুটিং টিমকে রেখেই ঢাকায় চলে গেছেন পরিচালক—এমন একটা অভিযোগ সে সময় এনেছিলেন সিনেমার নায়িকা শিরিন শিলা। পরে তিনি আরও জানান, নায়ক-নায়িকাসহ শিল্পীদের থাকা, খাওয়া—সবকিছুতেই অব্যবস্থাপনা ছিল। এতে ইউনিটে অসন্তোষ তৈরি হয়। সে সময় কলাকুশলীরা ধরেই নিয়েছিলেন, এ সিনেমার শুটিং আর হবে না। দ্বন্দ্ব মিটিয়ে পরের বছর শেষ হয় শুটিং। ডাবিং ও পোস্টের কাজ শেষ করতে লেগে যায় আরও এক বছর।

সিনেমায় জুটি হয়েছেন শিরিন শিলা ও কায়েস আরজু। ছবি: কায়েসের সৌজন্যে

সম্পর্কিত নিবন্ধ