লেখকদের জন্য লি চাইল্ডের ৬ পরামর্শ
Published: 27th, September 2025 GMT
ব্রিটিশ লেখক লি চাইল্ড। যার প্রকৃত নাম জেমস ডোভার গ্রান্ট। তার উপন্যাস ‘জ্যাক রিচার’ বিশ্বের মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ওয়েব সিরিজও তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন লেখক হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হলো, ভালো পাঠক হওয়া। যারা লেখক হতে চান, তাদের লি চাইল্ড ৬টি পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রতিদিনের শব্দসংখ্যার একটা লক্ষ্য ঠিক করুন
লি চাইল্ড প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ শব্দ লেখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার জন্য এটাই আরামপ্রদ। অনেকের তুলনায় এটা খুব কম। আমি কখনও কখনও খুব চেষ্টা করে দুই হাজার শব্দ লিখতে পারি।যদি সময় সীমার কাছাকাছি গিয়ে মনে হয়, অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি তাহলে একটু তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকি।’’
আরো পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা শুরু ১৭ ডিসেম্বর
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি স্পর্শ করুক
লেখক হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হলো পাঠক হওয়া
লি চাইল্ড মনে করেন ভালো লেখক হতে হলে হাজার-হাজার বই পড়া উচিত। যাতে নিজের মতো করে ছন্দটা জাগানো যায়। যেমন- কী দিয়ে আপনি পাঠককে আঁকড়ে ধরবেন, কেমন গতিতে এগোবেন, কী হবে আপনার নিজস্বতা। তিনি বলেন, ‘‘ক্ষেত্রে আমি কোনোমতে শুরুটা করি, গল্প ভাবতে থাকি আর শেষে পৌঁছে যাই।’’
চরিত্রই রাজা
সবকিছুই নির্ভর করে চরিত্রের ওপর। পটভূমিটাও যদি কাজে লেগে যায়, সেটা বাড়তি পাওয়া। কিন্তু দিন শেষে মানুষ চরিত্রটাই মনে রাখে। আমার কাছে এর একটা ভালো উদাহরণ হলো লোন রেঞ্জার। লোন রেঞ্জারকে মোটামুটি সবাই চেনে। কিন্তু ওর গল্পটা কেউ বলতে পারবে না।
চরিত্রের প্রেমে পড়ে যাবেন না
একটা পর্যায়ে গিয়ে লেখকেরা আত্মরক্ষামূলক হয়ে যান। চরিত্রের মধ্যে খারাপ কোনো দিক ঢোকাতে কিংবা একটা মন্দ চরিত্র দাঁড় করাতে কোথায় যেন একটা বাধা অনুভূত হয়। শুরুতে যখন রিচার লেখা শুরু করি, আমি তার সঙ্গে অন্যদের একটু দূরত্ব রাখতে চেষ্টা করেছি। পাঠক রিচারকে যতটা পছন্দ করে, আমি ততটা করি না। ফলে চরিত্রের ওপর ন্যায়বিচার করা হয়। এর মাধ্যমে সে একটা কার্টুন চরিত্রের বদলে একজন সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠে।
লিখতে শুরু করুন
যদি আপনি বইটা প্রকাশনার জন্য কোথাও জমা দেন, নিশ্চয়ই সেটা কেউ না কেউ পড়বে। অতএব প্রথম বাক্য, প্রথম অনুচ্ছেদ কিংবা প্রথম পৃষ্ঠাতেই তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হবে। প্রথম কাজটা করতে পারলে আপনি মোটামুটি নিরাপদ থাকবেন। প্রকাশকেরা এমন একটা বই–ই চান, যেটা কেউ হাতে নেবে, পড়া শুরু করবে, আর আটকে যাবে।
পরামর্শ কানে নেবেন না
আপনার বই, আপনার পণ্য। অতএব আমার সোজাসাপ্টা কথা হলো, কারও পরামর্শ বা উপদেশ শুনতে যাবেন না। বইয়ের একটা নিজস্ব, প্রাণবন্ত উপস্থাপন থাকবে। কে কী বলল বা বলবে, সেসব মাথায় রাখতে গেলে আপনি সেই মাধুর্য হারাবেন।
সূত্র: বিবিসি
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বইম ল বই চর ত র র র একট প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের স্যালুট
পৃথিবীর এক দিকে যখন সূর্যের আলো নিভে আসে, তখন অন্য দিকে শুরু হয় নতুন এক সকাল। এমন সকাল যেখানে কোনো আনন্দ নেই, নেই বিশ্রাম বা বিলাস; আছে শুধু ঘাম কষ্ট আর নীরব সংগ্রাম। সেই সকালেই লাখো বাংলাদেশি শ্রমিক মাথায় হেলমেট পরেন, কেউ হাতে ট্রাউল ধরেন, কেউ স্টিয়ারিংয়ে বসেন, কেউবা মরুভূমির দিকে হাঁটেন। তারা জানেন, তাদের ঘামের প্রতিটি ফোঁটা একদিন দেশের মাটিতে সোনার দানায় রূপ নেবে।
এই মানুষগুলো আমাদের অর্থনৈতিক সেনা। তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন না, কিন্তু প্রতিদিন যুদ্ধ করেন সময় যন্ত্রণা আর একাকিত্বের সঙ্গে। তারা শুধু নিজের জন্য লড়াই করেন না, তারা লড়ে যান প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, দেশের পতাকা উঁচু রাখার জন্য। আমরা তাদের বলি ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। তারা প্রবাস থেকে উপার্জন করে নিবাসে যা পাঠান তাই রেমিট্যান্স।
মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে
রাতের অন্ধকারে কখনও একা বসে থাকা প্রবাসীর মুখে দেখা যায় এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ মায়ের ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে মায়ের মায়াবী মুখ। ছেলে বলে, ‘মা, তুমি এখনও ঘুমাওনি?’
মা বলেন, ‘না রে বাবা, তোকে মনে পড়ছিল।’
এই ছোট্ট সংলাপেই লুকিয়ে আছে এক মহাকাব্যিক ভালোবাসা। হাজার মাইল দূরে থেকেও মা ও ছেলের মমতার বাঁধন ছিঁড়ে যায় না। ছেলেটি কান্না চেপে বলে, ‘আমি ভালো আছি মা।’
এই ‘ভালো থাকার’ আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক অশ্রু, নির্ঘুম রাত, অপমান ও সংযমের গল্প। একজন প্রবাসী গৃহকর্মী হয়তো দিনের পর দিন অপরিচিত কোনো পরিবারের ঘর মুছছেন, কিন্তু তার নিজের ঘরে আলো জ্বলে না মাসের পর মাস। একজন পিতা হয়তো বিদেশের ব্যস্ত শহরে গাড়ি চালান ১৬ ঘণ্টা, যেন দেশে থাকা তার ছেলেটি বিদ্যালয়ে যেতে পারে। এভাবেই জন্ম নেয় এক নতুন অভিধান- যেখানে ত্যাগ মানে প্রবাসী, ভালোবাসা মানে রেমিট্যান্স, আর দেশপ্রেম মানে দূরদেশে থেকেও মাটির গন্ধ অনুভব করা।
ঘামে গড়া অর্থনীতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মূল শক্তি, স্থিতিশীল থাকে জিডিপি, ঘুরে দাঁড়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি।
বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে কর্মরত। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই যান না কেন, তারা নিজের নামের আগে উচ্চারণ করেন একটা শব্দ ‘বাংলাদেশ’। তাদের পাঠানো অর্থ গ্রামের ঘর থেকে জাতীয় বাজেট পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের টাকায় গড়ে ওঠে বাড়ি, সেতু, স্কুল, মসজিদ; তাদের অর্থেই চলে সন্তানের পড়াশোনা, বোনের বিয়ে, মায়ের ওষুধ এবং দেশের অর্থনীতি। রেমিট্যান্সের প্রতিটি নোটে লেগে থাকে ঘাম, অশ্রু আর একটি না বলা গল্প।
ত্যাগের প্রতিচ্ছবি
অনেক প্রবাসী ভাই আছেন যারা একটানা দশ-পনেরো বছর দেশে ফেরেননি। বছরের পর বছর তাদের ঈদ কেটে যায় পরদেশে। একটি ভিডিও কলেই তারা জড়িয়ে ধরেন সন্তানকে, মোবাইলের স্ক্রিনে চুমু খান তাদের মুখে। অনেক প্রবাসী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হন। কেউ কেউ আর ফেরেন না জীবিত অবস্থায়। তাদের কফিনে মোড়ানো লাল-সবুজ পতাকা তখন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। তাদের সন্তানরা হয়তো বুঝে না বাবার অনুপস্থিতি মানে কী, কিন্তু যখন প্রবাসে থাকা সেই বাবা বাড়ি ফেরেন লাশ হয়ে, তখন বুঝতে শেখে- পরিবার ও দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু গর্ব ও হাসি নয়, কখনও কখনও কান্না।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মানবিক মুখ
আজ যাদের আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলি, তাদের জীবনের ভেতর আছে এক অনন্য মানবিকতা। তারা প্রতিদিন নিজের চেয়ে অন্যের জন্য বাঁচেন। মায়ের জন্য, স্ত্রীর জন্য, সন্তানের জন্য, দেশের জন্য। নিজের কষ্টকে গোপন করে হাসেন, যেন প্রিয়জনেরা সুখে থাকে। অনেকে হয়তো বলেন, ‘ওরা তো বিদেশে টাকা কামায়’। কিন্তু সত্য হলো, ওরা উপার্জন করে ঘাম দিয়ে, অবহেলা সহ্য করে, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে। তাদের পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের মাটি ভুলে যান না।
সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব
প্রবাসী আয় শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই ঘটায় না, এটি সামাজিক পরিবর্তনেরও অনুঘটক। গ্রামের গৃহিণীরা এখন ব্যাংক হিসাব রাখেন, বিদেশ থেকে আসা টাকা দিয়ে গড়ে ওঠে নতুন ব্যবসা, ছোট খামার, দোকান। অনেকে প্রবাসী টাকায় সন্তানের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ সরকারের ‘এক্সপ্যাট্রিয়েটস ওয়েলফেয়ার ব্যাংক’ ও ‘ওভারসিজ ওয়েলফেয়ার ফান্ড’ এখন প্রবাসীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে; অবৈধ দালালচক্র, ভুয়া চুক্তি, কাজের নিশ্চয়তা না থাকা- এসব অব্যবস্থার মধ্য দিয়েও তারা দাঁড়িয়ে থাকে একা, নিঃশব্দে, দৃঢ়ভাবে।
রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান
যে দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো রেমিট্যান্স, সে দেশের প্রবাসীরা যেন শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতিও পান- এটাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। তাদের জন্য বিমানবন্দরে শালীন আচরণ, দ্রুত সেবা, বিদেশে আইনি সুরক্ষা ও পরিবারে আর্থিক সহায়তা এসব এখন শুধু দাবি নয়, অধিকার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলো যেন আরও কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়ায়- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দেশের প্রকৃত নায়ক
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, জুলাই বিপ্লবীরা অভ্যুত্থান দিয়েছেন, কৃষকরা দিয়ে যাচ্ছেন খাদ্যের নিরাপত্তা, আর প্রবাসীরা দিয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তাদের ঘামে সিঞ্চিত প্রতিটি টাকায় জেগে থাকে এই দেশের প্রাণশক্তি। তারা আমাদের গর্ব। তাদের জন্যই ব্যাংক ভরে থাকে বৈদেশিক মুদ্রায়, বাংলাদেশের নাম উঠে আসে বিশ্ব তালিকায়। তাই আমাদের উচিত তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় উচ্চারণ করা- ‘হে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, আপনাদের প্রতি আমাদের স্যালুট। আপনাদের শ্রমে বেঁচে আছে এই মাটি, আপনাদের ঘামে ধুয়ে যায় দারিদ্র্যের দাগ, আপনারা দেশের প্রকৃত নায়ক।’
ঢাকা/তারা//