‘সিভিক ডিফেন্ডারস অব বাংলাদেশ’ ওয়েব পোর্টাল উদ্বোধন
Published: 29th, September 2025 GMT
বাংলাদেশের ডিজিটাল ও জনপরিসর ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, ডিজিটাল দমন-পীড়ন বৃদ্ধি, লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্য ছড়ানো এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা, এসব চ্যালেঞ্জগুলো প্রতিনিয়ত চোখে পড়ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল অধিকার, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং নাগরিক পরিসরে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ রক্ষা ও প্রসারের প্রচেষ্টায় ‘সিভিক ডিফেন্ডারস অফ বাংলাদেশ’ ওয়েব পোর্টাল চালু করা হয়েছে।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মোহাম্মদপুরের ওয়াই ডাবলিউসিএ মিলনায়তনে এই ওয়েব পোর্টালটি গণমাধ্যম, গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, উন্নয়ন সহযোগী, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আরো পড়ুন:
খাগড়াছড়ি ইস্যুতে গুজবে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া: বাংলাফ্যাক্ট
কাড়াকাড়ি করে প্রশাসনে লোক নিয়োগ করিয়েছে বিএনপি-জামায়াত: তথ্য উপদেষ্টা
বেসরকারি অ্যাডভোকেসী প্রতিষ্ঠান ‘ভয়েস’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন নীতি পর্যালোচক ড.
প্যানেল আলোচনায় আলোচকরা বলেন, জনপরিসরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে তুলে ধরার জন্য ভয়েসের এই উদ্যোগ অতি প্রশংসার দাবিদার। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, তা নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকার ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ কাঠামো গঠনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. অনন্য রায়হান বলেন, “ডিজিটাল ও নাগরিক পরিসরে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশে কিছু আইনগত সংস্কার বা কাঠামো প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এই ধরনের ওয়েব পোর্টাল আইনব্যবস্থার সাহায্যকারী পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।”
সামিনা ইয়াসমিন বলেন, “নারীবাদী আন্দোলন ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো এই পোর্টালকে ব্যবহার করে লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্যমূলক ক্যাম্পেইনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলা করতে পারে, নিরাপদ ডিজিটাল পরিসরের পক্ষে সোচ্চার হতে পারে এবং নাগরিক জীবনে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, নারী সাংবাদিকদের জন্যে এই প্ল্যাটফর্মটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সংবাদ মাধ্যমে আমরা নারী ও পুরুষের সংবাদের ভিন্নতা দেখি। এই বৈষম্যসহ অপতথ্যগুলো এই ওয়েব পোর্টালে উঠে আসা উচিত।”
উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ টনি মাইকেল গোমেজ বলেন, “এই ওয়েব পোর্টালটি একটি অ্যাডভোকেসি ও ক্ষমতায়নের হাতিয়ার। এমন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে যুবসমাজ, তৃণমূল ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং বৃহত্তর নাগরিক পরিসরে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রতিরোধে অবদান রাখতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মটি একটি ইনফরমেশন টুল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।”
ডালিয়া চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, “ওয়েব পোর্টালটির অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো, জনপরিসরের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো যাচাই করে নথিভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তব জীবনের ডিজিটাল ও নাগরিক পরিসরে অধিকার লঙ্ঘন এবং লিঙ্গভিত্তিক অপতথ্যের কেস স্টাডি গুলো শুধুমাত্র সচেতনতা বাড়াতেই নয়, বরং বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, এমনকি নীতিনির্ধারকদের অর্থবহ পরিবর্তনের জন্যে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।”
ওয়েব পোর্টালটি উন্মোচনের পাশাপাশি ‘কোল্যাবোরেটিভ অ্যাকশন্স ফর প্রোমোটিং ডিজিটাল অ্যান্ড সিভিক স্পেস অ্যান্ড কমব্যাটিং জেন্ডার ডিজইনফরম্যাশন’ প্রকল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন ভয়েস-এর উপ-পরিচালক, মুশাররাত মাহেরা।
ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, “এই ওয়েব পোর্টালটি একটি প্রযুক্তিভিত্তিক নথির ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করবে, যা আসলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জনপরিসরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দলিল। আগামীর গবেষক এবং অধিকারকর্মীদের জন্য এতে সমন্বিত তথ্যাবলি অত্যন্ত কর্যকর হবে বলে আমি আশা রাখি।”
ঢাকা/রায়হান/সাইফ
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
শান্তিশৃঙ্খলা ফেরানো সরকারের মূল দায়িত্ব
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় তিনজন নিহত এবং সেনাসদস্য, পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গত রোববার জেলার গুইমারা উপজেলায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে সহিংসতা ও গুলির ঘটনা ঘটে। পরে একদল দুর্বৃত্ত গুইমারার রামেসু বাজারে ঢুকে দোকানপাট ও বসতঘরে আগুন দেয় এবং লুটপাট চালায়।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উদ্বেগ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনমনে, বিশেষ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে, সেটা প্রশমনের দায়িত্ব সরকারের। এই মুহূর্তে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং জনজীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনাটাই মূল চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২৪ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা হওয়ার পর অভিযুক্ত একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন থেকে ‘জুম্ম ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে পাহাড়ি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার ছাত্র-তরুণেরা আন্দোলন করে আসছিলেন। একপর্যায়ে বাঙালি সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হওয়ায় সহিংসতার শঙ্কায় প্রশাসন খাগড়াছড়ি সদর ও দুই উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
ধর্ষণ মামলায় এক আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কেন কর্মসূচি অব্যাহত থাকল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, সাধারণ পাহাড়িদের পেছন থেকে কোনো গোষ্ঠী উসকে দিয়েছে। পরিস্থিতি অবনতির পেছনে কারও ইন্ধন যদি থাকে, সেটা তদন্ত করে বের করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারহীনতা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে যে উদ্বেগ রয়েছে, সেটা নিরসনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতটা দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাতে এক বিবৃতিতে জানাচ্ছে, শুধু খাগড়াছড়িতেই গত এক বছরে সাতজন পাহাড়ি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার একটিরও বিচার হয়নি। ফলে আন্দোলনের পেছনে নারীর নিরাপত্তা ও বিচারহীনতার কারণে পাহাড়িদের ক্ষোভকেও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে একের পর এক ভুয়া ভিডিও, অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, সেটাও সহিংসতা উসকে দিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ভুয়া ভিডিও ও অপতথ্যের উৎস খুঁজে বের করা এবং সেটা বন্ধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এবার ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য কীভাবে জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক সহিংসতা উসকে দেয়, দেশে-বিদেশে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত থাকার পরও এটা মোকাবিলায় কার্যকর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারাটা যারপরনাই দুঃখজনক।
খাগড়াছড়ির কিশোরী ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত বাকি দুজনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতা, অগ্নিকাণ্ড, লুটপাটের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা অপতথ্য ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি। সহিংসতায় নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো ও যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াটাও রাষ্ট্র ও সরকারের জরুরি কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।
খাগড়াছড়িতে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে ও জনজীবনে স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করতে সব পক্ষের ধৈর্য ও সংযত আচরণ প্রত্যাশিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের সঙ্গে পাহাড়ি ও বাঙালি নেতাদের এখানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।