আসুন মেয়েদের সাফল্য উদ্যাপন করি
Published: 1st, October 2025 GMT
আবি ডেয়ার-এর উপন্যাস ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য লাউডিং ভয়েস’-এ উঠে এসেছে নাইজেরিয়ার গ্রামীণ কিশোরী আদুনির গল্প। আদুনি চায় পড়াশোনা করতে, নিজের ‘লাউডিং ভয়েস’ খুঁজে পেতে; যাতে সে নিজের কথা নিজেই বলতে পারে। জীবনের নানা বাধা সত্ত্বেও আদুনি নিজের স্বপ্ন ছাড়েনি। সে বিশ্বাস করে শিক্ষার মাধ্যমে নিজের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে এবং তার মতো আরও অনেক মেয়ের জন্যও সেই সুযোগ তৈরি করবে।
আবি ডেয়ার হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের শিক্ষার্থীদের আয়োজিত সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ কনফারেন্সের অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন। সেই কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুবাদে তাঁর কাজ সম্পর্কে জানতে পারি।
বর্তমানে অনেক সংস্থা ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য লাউডিং ভয়েস’ বইটিকে বাল্যবিবাহ রোধের কাজে ব্যবহার করছে। আবি ডেয়ার-এর বক্তব্য শুনতে শুনতে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম বাংলাদেশে, যেখানে কুড়িগ্রামের চর থেকে সুনামগঞ্জের হাওর পর্যন্ত অসংখ্য ‘আদুনি’-র সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পড়াশোনা করতে চায়, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অনেকেই বাল্যবিবাহের কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে, তাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটছে।
২০২৫ সালে এসেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ প্রতিবেদনে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়েশিশুর বিয়ে হয়ে যায়।
‘উপযুক্ত পাত্র’ না খুঁজে মেয়েদের শিক্ষিত ও স্বনির্ভর করতে হবেব্র্যাকের ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ শীর্ষক জরিপ থেকে জানা যায়, মেয়েদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি যাই হোক না কেন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনো ব্যাপকভাবে ঘটছে। দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের পাশাপাশি অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘উপযুক্ত পাত্র পাওয়া’–কে। আইনের দুর্বল প্রয়োগ একটি বড় সমস্যা, আর বাল্যবিবাহের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত বড় একটি বাধা।
সব ধরনের আর্থসামাজিক অবস্থাতেই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা নারীদের অবস্থান নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ—যেখানে বিয়ে ও সন্তান প্রতিপালনকেই নারীর জীবনের কেন্দ্রীয় ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়। ঢাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবারগুলো অহরহ নিচ্ছে। এখানে আর্থিক সমস্যার বিষয় নেই; বরং মেয়েদের পড়াশোনা ও কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গুরুত্ব না দেওয়াই প্রধান কারণ। তবে ব্যতিক্রমী গল্পও আছে।
সিনডারেলায় শহরের সব মেয়ে রাজপুত্রের স্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় একটি জুতাতে নিজেদের পা ‘ফিট’ করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করে। এই গল্প মেয়েশিশুদের এই ধারণা দিতে পারে যে, ‘বিশেষ’ একজন নারী হয়ে রাজপুত্রকে ‘অর্জন’ করাই যেন জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের গল্প পড়ে এবং দেখে বড় হলে মেয়েরা নিজেদের জীবনে অর্থপূর্ণ কোনো কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে কীভাবে?ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফিরদৌসী কাদরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আমার নানির চিন্তাধারাও ছিল খুব আধুনিক। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। নানা-নানি দুজনেই ভূমিকা রেখেছেন আমার গবেষক হওয়ার পেছনে। তখন আমার বোনদের বিয়ের প্রস্তাব আসত। নানি এগুলোর প্রশ্রয় দিতেন না। বরং বিয়ের প্রস্তাব এলে তিনি রেগে যেতেন। পড়তে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে; এটাই আমাদের বলতেন সব সময়।’
রাজকন্যার গল্পের দিন শেষকয়েক বছর আগে লন্ডনে রোজী অ্যালেন চিত্রকর্মের সিরিজ ‘ডেঞ্জারস অব ডিজনি’ দেখে চিন্তার খোরাক পেয়েছি। তিনি কিছু জনপ্রিয় গল্প (সিনডারেলা, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, স্নো হোয়াইট, স্লিপিং বিউটি ইত্যাদি) নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে নিপীড়ন, সম্মতির প্রয়োজনীয়তা, নারীদের জীবনে শারীরিক সৌন্দর্যের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব, বার্ধক্যের ভীতিসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
‘দ্য পারফেক্ট ফিট’ ছবিতে একটি সামাজিক সমস্যা তুলে ধরতে সিনডারেলার গল্প ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য ইত্যাদিতে অনবরত এই বার্তা দেওয়া হয়—নারীদের সব বিষয়ে নিখুঁত (পারফেক্ট) হতে হবে। এটি তাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে এবং প্রায় সব সময়ই তাদের জন্য ক্ষতিকর।
সিনডারেলায় শহরের সব মেয়ে রাজপুত্রের স্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় একটি জুতাতে নিজেদের পা ‘ফিট’ করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করে। এই গল্প মেয়েশিশুদের এই ধারণা দিতে পারে যে, ‘বিশেষ’ একজন নারী হয়ে রাজপুত্রকে ‘অর্জন’ করাই যেন জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুনআমাদের স্বপ্ন ছেলে আর মেয়েদের ভাগ করে দিই০৭ অক্টোবর ২০২০এই ধরনের গল্প পড়ে এবং দেখে বড় হলে মেয়েরা নিজেদের জীবনে অর্থপূর্ণ কোনো কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে কীভাবে? তারা কি নিজের মেধা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজস্ব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে?
আশার কথা, পুরোনো রূপকথা নতুন করে লেখা এবং এই যুগের উপযোগী গল্প লেখার কাজ শুরু হয়েছে। এসব গল্পের মেয়েরা সাহসী, আত্মবিশ্বাসী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কোনো রাজপুত্র এসে ‘উদ্ধার’ করবে সেই আশায় তারা বসে থাকে না, নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে, এবং সমাজটাকেও এগিয়ে নেয়।
সাজগোজের দিকে মনোযোগ দিয়ে মেয়েদের ‘রাজকন্যা’ এবং পরনির্ভরশীল বানিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেই যুগ শেষ। মেয়েরা নিজের ইচ্ছামতো খেলুক বা যা করতে ভালো লাগে করুক। তারা ধুলো-কাদা গায়ে মাখুক, হাসুক, আনন্দ করুক।
হার স্টোরিজ: বাংলার দুঃসাহসী মেয়েরা‘হার স্টোরিজ: বাংলার দুঃসাহসী মেয়েরা’ একটি চমৎকার বই। এতে রয়েছে সাহসী নারীদের দুঃসাহসী অর্জনের গল্প। তাঁদের মধ্যে আছেন জ্যোতির্বিদ, গল্পকথক, শিক্ষাবিদ, বিপ্লবী, কবি, চিকিৎসক, সংগ্রামী, যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী, সংগীতশিল্পী, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, আলোকচিত্রী, অভিনেত্রী, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, স্থপতি, মানবাধিকার কর্মী, পর্বতারোহী, কমব্যাট পাইলট, ভারোত্তোলক এবং মা।
কিছুদিন আগে ঢাকা এয়ারপোর্টে তেমন এক দুঃসাহসী মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি চীনে যাচ্ছিলেন। সাত বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ছিলেন; সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে বৃত্তি নিয়ে চীনে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নিয়ে পড়ছেন। তাঁর মা ও তাঁকে পড়াশোনার ব্যাপারে সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন। চীনের যে শহরে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে এত ঠান্ডা যে তাঁর নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু করে। তিনি ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিয়ে আবার পড়তে যান। কী অসম্ভব মনের জোর! ফিরদৌসী কাদরী, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসহ নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারা মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের অনুপ্রেরণা একটা বিশাল ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুনবাল্যবিবাহ এবং আমাদের মাধ্যমিক পড়াশোনায় বাধা১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫মেয়েদের সাফল্য উদ্যাপন করতে শিখুনবাংলাদেশের মেয়েরা মানসিকতা এবং সাহসে অনেক এগিয়ে আছে। তাঁরা খেলাধুলা থেকে শুরু করে রোবোটিকস সব ক্ষেত্রেই অবদান রাখছে। সমস্যা হলো সমাজের অনেকেই মেয়েদের সাফল্য উদ্যাপনে তেমন আগ্রহী নয়, বরং তাদের সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হয়। সমাজের সবাইকে মেয়ে এবং নারীদের পড়াশোনা এবং পেশাগত জীবনের অর্জন উদ্যাপন করা শিখতে হবে।
বাবা-মায়ের দায়িত্ব মেয়েদের শিক্ষায় উৎসাহ দেওয়া এবং তাদের জন্য বই, চলচ্চিত্র এবং খেলনা বাছাই করার সময় সচেতনভাবে সেই সব বিষয় বেছে নেওয়া, যা মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালকসহ সাংস্কৃতিক কর্মীদের উচিত শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ক নারী চরিত্র নিয়ে গল্প বলা।
গণমাধ্যমকেও ইতিবাচক নারী রোল মডেলদের তুলে ধরতে হবে। বাল্যবিবাহ নিয়ে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত, সমাজটাকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করা এবং মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
লায়লা খন্দকার উন্নয়ন কর্মী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র গল প র জন য র জ বন হওয় র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নারী নিহত
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুরের রাজৈরে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের খাদে পড়ে এক নারী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে রাজৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন তারা।
নিহত নিলুফা ইয়াসমিন নিলা (৩০) বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রুনসী গ্রামের আবুল বাসারের স্ত্রী।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে ডাম্পট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত
অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, মা-মেয়ে নিহত
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুয়াকাটা থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল চন্দ্রা পরিবহনের বাসটি। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের রাজৈর বাসস্ট্যান্ড পার হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি সড়কের পাশের খাদে পড়ে যায়। পরে হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিলার মরদেহ উদ্ধার করে। আহত হন অন্তত ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাদারীপুরের মস্তফাপুর হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, বাস খাদে পড়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা হয়। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। নিহত নারীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মাদারীপুর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা/বেলাল/মাসুদ