ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ আদৌ ফল দেবে কি
Published: 1st, October 2025 GMT
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে এটিকে শুধু খাদের কিনারে নিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং গভীর খাদে ছুড়ে ফেলেছেন। ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই বিপুল অঙ্কের অপরিশোধিত ব্যাংকঋণ দেশের ভেতরে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যেহেতু এ অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি, তাই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত ঋণের চাপে কতিপয় ব্যাংক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের জমতে থাকা ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘদিনের গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, সেটি নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের গভীর ঘুমের কারণে যে স্নায়ু বৈকল্যের সৃষ্টি হয়, সেটি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। যার প্রমাণ বর্তমান সময়ে রুগ্ণ হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক একীভূতকরণ একটি প্রচলিত কৌশল, যা বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোকে তাদের দুর্বল আর্থিক অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর এই কৌশল ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যাংক একীভূতকরণের বেশ কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি বড় প্রাতিষ্ঠানিক সত্তার জন্ম হয়, যার বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তৈরি হয়। আকারের সুবিধার কারণে মূলধনের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়, যা ঋণের প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করে।
এ ছাড়া ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ঋণের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পারফরম্যান্স সূচকের উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু ব্যাংক একীভূতকরণ গবেষণায় দেখা যায়, একীভূত করার প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এটি সফলতার মুখ দেখতে পায় না।
উপরন্তু এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে ব্যাংক একীভূতকরণ একটি বাজারমুখী কৌশল এবং তা শুধু বাজারসৃষ্ট সমস্যার সমাধান দেওয়ার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ ব্যাংকের আর্থিক দৈন্যদশা যদি বাজারসৃষ্ট কারণে হয়, যেমন সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ব্যাংকের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়ার অদক্ষতা বা ব্যাংকের স্বাভাবিক সুশাসনের ঘাটতি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক দৈন্যদশা কোনো সাধারণ বাজারমুখী কারণে সৃষ্টি হয়নি; বরং তা হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কতিপয় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকের দ্বারা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া একদিকে যেমন প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করতে পারে এবং এই আর্থিক বিপর্যয়ের ভার ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কর্মী বাহিনীর ওপর বর্তাবে। যাঁদের মাধ্যমে এই ব্যাংকগুলোতে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে, তাঁদের বিচারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত না করে ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বাজারে ব্যাংক কর্মচারীদের সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকিং খাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রুগ্ণ ব্যাংক একীভূতকরণের যে নীতি তা অনেকটাই পশ্চিমা নীতির সমার্থক, যা কিনা উন্নত আর্থিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর বাজারব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের বাজারব্যবস্থার থেকে বেশ আলাদা। তাই যেসব নীতি উন্নত বাজারগুলোর জন্য প্রযোজ্য, তা আমাদের বাজারে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাব একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব যে মাত্রায় ব্যবহৃত হয়, তা পশ্চিমা বিশ্বে হয় না। তাই ব্যাংক একীভূতকরণ আমাদের বাজারে কাজ যে করবে না, তা নিশ্চিতভাবেই অনুমান করা যায়। উপরন্তু এই কৌশল আমাদের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ব্যাংকিং খাতের কর্তাব্যক্তিদের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিস্তর গবেষণা রয়েছে। এসব গবেষণার মাধ্যমে এটি প্রতীয়মান হয়, ব্যাংকগুলো এই রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহার করে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগের এ ধনাত্মক প্রভাব শুধু তখনই কার্যকর হবে, যখন রাজনৈতিক যোগাযোগপুষ্ট ব্যক্তিরা ব্যাংকের মাইনরিটি নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবেন। রাজনৈতিক যোগাযোগপুষ্ট ব্যক্তিরা যদি ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন, তবে ব্যাংকের ঋণদান প্রক্রিয়া ও সুশাসনের প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। ফলে তাঁদের অনৈতিক কার্যক্রম অনেক সহজতর হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিই চরম সত্য।
এসব কারণে বলা যায়, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি বৃহৎ ব্যাংকের সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার অনেক সহজতর হবে। কারণ, তখন পাঁচটি ব্যাংক দখল না করে শুধু একটি ব্যাংক দখলই যথেষ্ট হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই একীভূতকরণ নীতি বরং ভবিষ্যতের কোনো রাজনৈতিক সরকারের সুবিধা প্রাপ্তিকে সহজতর করে দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের কথা মনে পড়ছে, যেখানে বিচারক বলেছিলেন তিনি প্রতিষ্ঠানের আকারের বিশালতায় শঙ্কিত। প্রখ্যাত ব্যাংকিং-বিষয়ক গবেষক রাজন ও জিংগেলস তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বৃহৎ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বেশি ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিযোগীদের থেকে বেশি মুনাফা করতে পারে, যা প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং ব্যাবসায়ের পরিপন্থী। সুতরাং বাংলাদেশে যদি একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি নতুন বৃহৎ ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করে, তা বাজারের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করবে। ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া বৃহৎ ব্যাংকগুলোর ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যায়। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, একীভূত করার প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বৃহৎ ব্যাংকগুলোর মার্কেট পাওয়ার বা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় রাজনৈতিক শক্তিগুলো এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও সক্রিয় হয়। আর এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যে সহজেই ব্যবহার করা যায়, তা আমরা নিকট অতীতে দেখেছি।
সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের পথ না ধরে বিকল্প ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দেওয়া। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা রাজনৈতিক প্রভাব, তাই ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলোকে কীভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা।
একীভূত ব্যাংকের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগানের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই অর্থ প্রস্তাবিত একীভূত করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করলে স্বল্প মেয়াদে তাদের তারল্যসংকট দূরীভূত হবে এবং বাজারে আস্থার সংকটের খানিকটা অবসান হবে। ফলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবে।এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দেশের সব স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরি করেন। তাঁরা তাঁদের মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি মজবুত ও জনপ্রিয় খাতে রূপান্তর করেছেন, যা বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সরকারের অনুগত স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের আর্থিক স্বার্থে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি শুধু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে আমাদের দেশের মেধাবী ব্যাংকাররা এ খাতকে আবারও একটি লাভজনক ও শক্তিশালী খাতে রূপান্তর করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
অধ্যাপক মসফিক, উদ্দিন লিডস বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্য
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক য গ য গ র র প রক র য় র আর থ ক ক এক ভ ত ব যবস থ আম দ র র জন য সমস য ব যবহ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের কৃষিতে যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে
নদী ও উর্বর মাটিতে ভরা আমাদের এই দেশে কৃষিই জাতীয় জীবনের মূল চালিকা শক্তি। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই কৃষি এখানে কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি ছিল সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে লুকিয়ে আছে কৃষকের ঘাম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের গল্প। হাজার বছরের এই কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে পয়লা অগ্রহায়ণ—নবান্ন উৎসবের দিনটিকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই দিনটি এখন বাংলার কৃষি ও কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, অর্জন এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। পাশাপাশি দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের এক জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
মোগল আমল পর্যন্ত এ অঞ্চলে কৃষি ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি প্রথা কৃষিকে করেছিল শোষণের শিকার। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর বাংলাদেশ কৃষিতে ছিল বিপর্যস্ত। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ ও উৎপাদনহীনতার কঠিন বাস্তবতায় জর্জরিত। ‘কৃষিই হবে উন্নয়নের ভিত্তি’—এই দর্শনে সরকার কৃষি পুনর্গঠনের নীতি গ্রহণ করে।
কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো।
এই সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৮০-র দশক থেকে ধান, গম ও সবজি উৎপাদনে বিপ্লব দেখা দেয়। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ। ধান, সবজি, মাছ-মাংস ও দুগ্ধ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে অগ্রগণ্য। এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে কোটি কৃষকের পরিশ্রম, কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন এবং কৃষি নীতি ও নেতৃত্বের সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন কেবল চাষাবাদ নয়, এটি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমন্বিত ক্ষেত্র।
অতীতের কৃষি ছিল পরিশ্রমনির্ভর। বর্তমান কৃষি হচ্ছে জ্ঞাননির্ভর। কৃষি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল বীজ, জলবায়ু সহনশীল জাত, জৈব সার প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি–নির্ভর স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা। কৃষি এখন উৎপাদন থেকে টেকসই উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে।
দেশের খাদ্যনিরাপত্তার মেরুদণ্ড হলো ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১২০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল এই জাতগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে ধান চাষের সংকট দূর করেছে। এই উদ্ভাবনই বাংলাদেশকে ‘রাইস সেলফ সাফিশিয়েন্ট নেশন’ বা ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। সবজি ও ফলের উন্নত জাতের জনপ্রিয়তা বাড়ায় সেগুলো এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।
শ্রম থেকে প্রযুক্তির রূপান্তরে যান্ত্রিকীকরণ বাংলাদেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের সময় ও শ্রম বাঁচছে এবং উৎপাদন ব্যয় কমছে।
কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।বাংলাদেশের কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কৃষকেরা মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে ফসলের রোগনির্ণয়, বাজারদর, আবহাওয়ার তথ্য ও সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। ড্রোন ইমেজিং, স্যাটেলাইট মনিটরিং ও রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে জমির স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। স্মার্ট কৃষি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ কৃষি ৪.০-এর যুগে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, সার ও পানির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ এবং বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি এখন আর শুধু পুরুষের নয়, নারীর হাতও সমানভাবে এর অগ্রযাত্রায় যুক্ত। তাঁরা বীজ বপন, রোপণ, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। নতুন প্রজন্মের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘স্মার্ট অ্যাগ্রিপ্রেনিউরশিপ’ শুরু করছে। ই-কমার্স ভিত্তিক কৃষিপণ্য বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম, হাইড্রোপনিক ফার্মিং ইত্যাদি কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার’ মডেল। এই মডেলে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষকের সহনশীলতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এখন চাষ হচ্ছে লবণাক্ততা সহনশীল ধান, বন্যাপ্রবণ এলাকায় গড়ে উঠেছে ফ্লোটিং গার্ডেন বা ভাসমান কৃষি।
শুষ্ক এলাকায় রয়েছে ড্রিপ সেচ ও সোলার কৃষি। বাংলাদেশের এই জলবায়ু সহনশীল কৃষি মডেল আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জমি ক্রমে কমছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষিজমির প্রায় ৩০ শতাংশ জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই টেকসই কৃষি কৌশলই একমাত্র সমাধান।
কৃষি এ দেশের অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি হলেও কৃষকই সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, অথচ কৃষির মোট জিডিপি অবদান মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। মানে দাঁড়ায়, কৃষকের পরিশ্রমের প্রকৃত আর্থিক মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।
এই বৈষম্যই কৃষক–জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থা এখনো মধ্যস্বত্বভোগীনির্ভর। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে একাধিক ধাপ পার হয়, যেখানে কৃষক সর্বনিম্ন অংশ পান। কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ঘাটতি থাকায় প্রতিবছর ২৫-৩০ শতাংশ কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যদি কার্যকর কৃষি বিমা ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে কৃষকেরা উৎপাদনে ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন।
কৃষির ভবিষ্যৎ এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রিসিশন ফার্মিং, স্মার্ট গ্রিনহাউস, ড্রোন ডেলিভারি সিস্টেম, বায়োইনফরমেটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কৃষিনীতির ধারণাগুলো আগামী দিনের কৃষিকে পুনর্গঠন করবে। বিশ্ব কৃষি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হলে এই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিবিপ্লবকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘কৃষক থেকে ভোক্তা’ সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।
গোলাম মর্তুজা সেলিম, কৃষি সংগঠক ও রাজনৈতিক কর্মী
ইমেইল [email protected]