সরকারি তেল সরাসরি সরবরাহের স্বচ্ছতা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ফতুল্লা ডিপো থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার লিটার ডিজেল গায়েব হয়েছে। দুই দফায় তেল চুরির এ ঘটনা জ্বালানি খাতের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।

জ্বালানি তেলের চুরি ও অপচয় রোধে সরকারের নির্মাণ করা ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনে তেল সরবরাহ চালু হয়েছে গত জুনে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় মূল টার্মিনাল থেকে সরাসরি তেল আসছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। এর মধ্যেই যমুনা তেল কোম্পানির ডিপোয় এ তেলেসমাতি ঘটল।

যমুনা তেল কোম্পানি ও ফতুল্লা ডিপো সূত্র বলছে, জ্বালানি তেল চুরির অন্যতম উপায় হলো, তেল মজুত রাখা ট্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে জালিয়াতি। ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকে পাইপলাইন থেকে তেল আসে। এর মধ্যে ২২ নম্বর ট্যাংকটি পুরোনো। নতুন করে তৈরি সক্ষমতা সনদে জালিয়াতি করে মজুত ক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আর ২৩ নম্বর ট্যাংকটি নতুন, শুরুতেই এটির সক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়। এতে করে ডিপোতে বাড়তি তেল মজুত হলেও মেপে পাওয়া গেছে কম।

ডিপোসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেল পরিমাপ করা হয় সনাতনি প্রক্রিয়ায়। একটি রড (ডিপ স্টিক) দিয়ে মূলত ট্যাংকের গভীরতা মাপা হয়। এ গভীরতা ২ মিলিমিটার কম দেখাতে পারলেই ১ হাজার ১৮০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করা যায়। ফতুল্লার দুই ডিপোতে সক্ষমতা আগে থেকেই বাড়তি দেখানোয় ট্যাংকের গভীরতার মাপে তেলের হিসাব কম আসছে। আসলে তেল ট্যাংকের ভেতরেই ছিল। এভাবেই বাড়তি তেল নিয়ে ধাপে ধাপে বাইরে বিক্রি করা হয় ডিপো থেকে।

জ্বালানি তেল চুরির অন্যতম উপায় হলো, তেল মজুত রাখা ট্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে জালিয়াতি। ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকে পাইপলাইন থেকে তেল আসে। এর মধ্যে ২২ নম্বর ট্যাংকটি পুরোনো। নতুন করে তৈরি সক্ষমতা সনদে জালিয়াতি করে মজুত ক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আর ২৩ নম্বর ট্যাংকটি নতুন, শুরুতেই এটির সক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়।

ট্যাংকে তেল মজুত শুরুর আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে সক্ষমতা যাচাই করে (ক্যালিব্রেশন) সনদ নিতে হয়। এটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর আবার যাচাই করে নবায়ন করতে হয়। তেল কোম্পানির হয়ে কাজটি করে দেয় বেসরকারি কিছু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ফতুল্লা ডিপোর ট্যাংক দুটির সক্ষমতা যাচাইয়ের কাজ করেছে খুলনার ঠিকাদার মেসার্স এস এম নুরুল হক। দুটিই ডিজেল রাখার ট্যাংক। এর মধ্যে ২২ নম্বর ট্যাংকে ২০১৮ সালে ও পরে ২০২৫ সালে যাচাই করা হয়েছে।

দুটি ট্যাংকের তিনটি সক্ষমতা প্রতিবেদন প্রথম আলোর হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের সক্ষমতা সনদ বলছে, ২২ নম্বর ট্যাংকে ২ হাজার মিটার গভীরতায় তেল ধারণক্ষমতা ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪ লিটার। আর ১২ হাজার ১৪০ মিটার গভীরতায় ধারণক্ষমতা ৭২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৭ লিটার। এ বছর নতুন করে সক্ষমতা যাচাই করে একই ঠিকাদার। এতে বলা হয়, ট্যাংকে ২ হাজার মিটার গভীরতায় ধারণক্ষমতা ১২ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ লিটার। আর ১২ হাজার ১৪০ মিটার গভীরতায় ধারণক্ষমতা ৭২ লাখ ৮ হাজার ১২৯ লিটার। অর্থাৎ, মজুত ক্ষমতা কমে গেছে ৫৮ থেকে ৫৯ হাজার লিটার। তবে ২৩ নম্বর ট্যাংক নতুন বলে এটির সক্ষমতা তুলনা করা যায়নি।

আরও পড়ুনঅনিয়ম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিন২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ বিষয়ে মেসার্স এস এম নুরুল হকের স্বত্বাধিকারী আন্দালিব বিন হক প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতার ক্ষেত্রে ১ শতাংশ তারতম্য হতে পারে। এতে ৭০ লাখের ক্ষেত্রে ৭ হাজার কমতে বা বাড়তে পারে। ৬০ হাজার লিটার কমার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত নন। এটি মুদ্রণজনিত ভুল হতে পারে।

সক্ষমতার ক্ষেত্রে ১ শতাংশ তারতম্য হতে পারে। এতে ৭০ লাখের ক্ষেত্রে ৭ হাজার কমতে বা বাড়তে পারে। ৬০ হাজার লিটার কমার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত নন। এটি মুদ্রণজনিত ভুল হতে পারে।আন্দালিব বিন হক, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এম নুরুল হকের স্বত্বাধিকারী

আন্দালিব বিন হক আরও বলেন, তাঁরা শুরুতে যে খসড়া প্রতিবেদন দিয়েছেন, সেটি ভালো করে যাচাই–বাছাই করেনি যমুনা। এতে ভুলটা হতে পারে। তবে এখন তাঁরা পুনরায় সক্ষমতা যাচাই করছেন। এ ছাড়া বিএসটিআইয়ের উপস্থিতিতে তাঁরা সক্ষমতা যাচাই করেছেন কি না, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

তেল গায়েব হওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যে আমলে নিয়েছে যমুনা অয়েল কোম্পানি। ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকের সক্ষমতা পুনরায় যাচাই করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করতে একটি কমিটি করা হয়েছে।

আরও পড়ুনজ্বালানি তেল ‘চুরি’ করতে যমুনা অয়েলে অভিনব জালিয়াতি৩১ আগস্ট ২০২৫

গত ২৫ সেপ্টেম্বর যমুনার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো অপারেশন বিভাগের এক চিঠি বলছে, ঢাকা–চট্টগ্রাম পাইপলাইনের মাধ্যমে ২৪ জুন তেল সরবরাহ শুরু হয়। ফতুল্লা ডিপোতে তেল গ্রহণ সমাপ্ত হয় ৪ জুলাই। এতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০৪ লিটার ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ১৪ সেপ্টেম্বর তেল আসা শুরু হয়, যা শেষ হয় ২২ সেপ্টেম্বর। এবার ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬১৪ লিটার।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ট্যাংকে গভীরতা অনুযায়ী তেলের পরিমাণগত পার্থক্য রয়েছে। তাই আবার সক্ষমতা যাচাই করতে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর আরেকটি চিঠিতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এতে পাইপলাইন কোম্পানির একজনকেও রাখা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য যমুনা অয়েল কোম্পানির এজিএম (ইএন্ডডি) মো.

আলমগীর আলম মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ফতুল্লা পরিদর্শনে এসেছেন। সবকিছু যাচাই–বাছাই করে দেখছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।

তবে যমুনার তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতা যাচাইয়ে কোনোভাবেই ১ শতাংশের বেশি ত্রুটি হতে পারে না। তেল চুরি করার জন্যই মজুত সক্ষমতা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। নতুন ট্যাংকেও একইভাবে কমানো হয়েছে। এভাবে প্রতি ধাপে প্রায় ৬০ হাজার করে দুই দফায় দুই ট্যাংকে প্রায় আড়াই লাখ লিটার তেল চুরি করা হয়েছে।

এই কর্মকর্তারা আরও বলেন, জ্বালানি তেল চুরির চক্র একইভাবে কিছু ট্যাংকলরির সক্ষমতা কমিয়ে দেখায় এবং ডিপো থেকে চুরির তেল বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। প্রথম দফায় কিছু তেল পাইপলাইনে রয়ে গেছে। তাই দ্বিতীয় দফায় ঘাটতি কম হয়েছে।

যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরত-ই ইলাহীকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠানো হলে তিনি তা দেখেছেন, তবে উত্তর দেননি।

যমুনার কর্মকর্তারা বলেন, যমুনায় তেল চুরির ঘটনা নিজেরাই তদন্ত করছে। এভাবে সত্য উদ্‌ঘাটন হবে না; বরং এভাবে প্রতিবার তেল চুরি পার পেয়ে যায়। বিপিসি বা জ্বালানি বিভাগের আলাদা তদন্ত কমিটি করে এসব অনিয়মের অনুসন্ধান করা উচিত।

আরও পড়ুনহিসাবে ভুল করায় ধরা পড়ল ডিজেল চুরি!০৯ নভেম্বর ২০১৭

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ধ রণক ষমত স প ট ম বর প রথম আল য চ ই কর ব যবস থ সরক র ব ষয়ট ক ষমত তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

৩২ নম্বরের দিকে যাওয়া ২টি বুলডোজার আটকে দিল সেনাবাহিনী

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়া দুটি বুলডোজার আটকে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় ছাত্র-জনতার সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর ১টার দিকে ঘটনাটি ঘটে।

সূত্র জানায়, দুটি বুলডোজার ট্রাকে করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বুলডোজারের ওপরে কিছু তরুণকে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিচ্ছিল। পরে সেনাবাহিনী ও বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ৩২ নম্বরে প্রবেশের রাস্তায় বুলডোজার দুটি আটকে দেন। ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরু‌দ্ধে রায় ঘোষণা চলছে। সোমবার (১৭ নভেম্বর) বেলা ১১টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারা দেশজুড়ে এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।

গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাড়িটিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও বুলডোজার এনে বাড়িটির কিছু অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকা/এমআর/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ