পুকুরে ‘ডুবছে’ নওগাঁর উর্বর ভূমি, মাঠে মাঠে ‘দুই বিঘা জমি’র গল্প
Published: 2nd, October 2025 GMT
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতার উপেনের মতোই নওগাঁর কৃষক ইয়াছিন আলীর আবাদযোগ্য জমি ছিল মাত্র দুই বিঘা। সেকালের রাজা উপেনকে বলেছিলেন, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখান/ পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে, সমান হইবে টানা...।’ শেষ পর্যন্ত উপেন রাজাকে তাঁর দুই বিঘা জমি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ইয়াছিন আলীর জমিও এখন অন্যদের জিম্মায়। তাঁকে জমি লিখে দিতে না হলেও ‘বাধ্য হয়ে’ ইজারা দিয়েছেন। সেকালের রাজা উপেনের জমিতে বাগান করেছিলেন। আর একালের প্রভাবশালীরা ইয়াছিনের জমিতে পুকুর খুঁড়ে মাছ চাষ করছেন। যেখানে তিনি আগে বোরো ও আমন ধান আবাদ করতেন। মাঝের সময়টায় করতেন পাট ও শর্ষের মতো অর্থকরী ফসল।
ইয়াছিন আলীর বাড়ি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ধনপাড়া গ্রামে। তিনি বলেন, ‘একমাত্র আবাদি জমি হওয়ায় শুরুতে আমি কিছুতেই পুকুরের জন্য জমি দিতে রাজি হইনি। কিন্তু আমার জমির চারপাশে পুকুর হওয়ায় আমি বেকায়দায় পড়ে যাই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আট বছর আগে ইয়াছিনের জমির পাশে অন্য কৃষকদের জমি ইজারা নিয়ে একটি পুকুর খনন করেন আত্রাই উপজেলার মাছচাষি খয়বর রহমান। ক্রমে তিনি আরও দুটি পুকুর খোঁড়েন। পুকুরগুলোর উঁচু পাড়ের কারণে বছরের অধিকাংশ সময় ইয়াছিনের তিন ফসলি জমিতে পানি আটকে থাকত, ফসল খারাপ হতো। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই জমি বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) বছরে ২০ হাজার টাকায় খয়বরকে ইজারা দিয়ে দেন।
এখন ইয়াছিন আলীকে চাল, সবজি, গোখাদ্য খড়—সবই কিনতে হয়। ইজারার টাকায় সংসার চলে না, দিনমজুরি করেন। তিনি বলেন, ‘খালি মাছ খ্যায়ে কি আমাগের প্যাট ভরবে?’
কৃষি দপ্তরের হিসাব বলছে, ধান-চালের জেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ নওগাঁয় ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে প্রায় ৪ শতাংশ তিন ফসলি জমি পুকুরের পেটে চলে গেছে; আশপাশের জমিও জলাবদ্ধ হচ্ছে। বিশেষত, বিলে পুকুর খোঁড়ায় পানিপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে, জলাবদ্ধতা স্থায়ী হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও মানুষের জীবন–জীবিকায়।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের সময় শুরু হওয়া অবৈধ পুকুর খনন শেষ করার দায়িত্বে ‘বিএনপির লোক’২২ মে ২০২৫গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলার ১০টি এলাকা ঘুরে বিষয়টি অনুসন্ধান করেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। কথা বলেছেন কৃষক, মাছচাষি, বিশেষজ্ঞ আর প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্তত ৬০ জনের সঙ্গে। সবাই বলছেন, অবাধে যত্রতত্র পুকুর খনন করায় কৃষকেরা হারাচ্ছেন ফসলি জমি, কৃষিমজুরেরা হারাচ্ছেন কাজ।
গত কয়েক বছরে নওগাঁ ছাড়াও রাজশাহী, নাটোর ও পাবনায় এমন যথেচ্ছ পুকুর খননের প্রবণতা দেখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম মহসিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন এলাকায় কতগুলো পুকুরের প্রয়োজন আছে এবং পরিবেশের ওপর সেগুলোর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেসব বিবেচনায় পুকুর খননের অনুমোদন দেওয়া উচিত।’
বিল গ্রাস করছেন প্রভাবশালীরারানীনগর উপজেলায় কালিকাপুর বেড়িবাঁধের দুই ধারে বিল মনসুর, কালিকাপুর বিল ও ধনপাড়া তিন ফসলি মাঠে গত ২৬ আগস্ট গিয়ে দেখা যায়, জালের মতো বিছিয়ে আছে অসংখ্য পুকুর। কোথাও একটি পুকুরের পাড়ের সঙ্গে আরও কয়েকটি পুকুর লাগানো।
আতাইকুলা থেকে বেড়িবাঁধের ৩ নম্বর স্লুইসগেট এলাকা পর্যন্ত বিল মনসুরের পূর্ব অংশে রাস্তার দুই পাশে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গুনে ৬৮টি পুকুর পাওয়া যায়। বিলজুড়ে ৮০টির বেশি পুকুর রয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, এগুলো খোঁড়া হয়েছে গত ১০ বছরে। ১৫০ বিঘা আয়তনের পুকুরও আছে।
নওগাঁতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ফসলি জমিতে সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায়। কৃষকদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের দুজন সাবেক সংসদ সদস্যের প্রশ্রয়ে প্রভাবশালীরা এ কাজ করেছেন।
আত্রাই উপজেলার শুটকিগাছা গ্রামের বাসিন্দা মাছচাষি খয়বর রহমান বলেন, ‘পুকুর খননে প্রশাসন বাধা দিলে ভাইয়ের (সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম) কাছে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’ পরবর্তী সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেনও পুকুর খোঁড়ার পক্ষে ছিলেন—‘তাঁদের সময়টাতে প্রশাসন সমস্যা করত না।’
আরও পড়ুনপ্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে ধানি জমিতে অবাধে পুকুর খনন২৩ এপ্রিল ২০২৪সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের চকতারতা, মোক্তারপাড়া, শ্যামপুর, আলাদাদপুরসহ অন্তত ১৫টি গ্রাামের ফসলি মাঠের পানি নামে নলগাড়া বিল দিয়ে। বিলের ২০ একর খাসজমি দখল করে এলাকার মাটি ব্যবসায়ী মনির হোসেন ছোট-বড় ১০টি পুকুর খনন করেন। মাঠের অন্তত ১৫ জন কৃষক বলেন, বিলটির মাঝবরাবর পুকুর কাটায় এবার অন্তত ৫০০ বিঘা জমিতে কৃষকেরা আমন ধান আবাদ করতে পারেননি। অন্যান্য বিল ও ফসলি মাঠেও জলাবদ্ধতা হয়েছে।
বক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সারওয়ার কামাল বলেন, ‘একজন ব্যক্তির বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য শত শত কৃষক ফসল–আবাদ করতে না পেরে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’
বিলের তিন ফসলি জমি নষ্ট করে একের পর এক পুকুর খনন করে চলছে মাছ চাষ। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা পুকুরের এই চিত্র সম্প্রতি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মনসুর বিলের.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ন ফসল উপজ ল র র ন নগর
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২৯
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কয়েকটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় বুধবার দিনভর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ধারালো চাকু, দুটি লোহার রড, একটি সাইকেল ও ৩০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত মামলা, মাদক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন হীরা (১৯), রফিক (২১), আবদুর রহমান (৩৯), নাবিদ হাসান ওরফে চয়ন (২৬), খোকন (৩১), মনসুর (৩৫), জুয়েল (৩২), সানজু (২২), মিলন (৪২), শাওন (৩৬), নোয়াজ শরীফ (২৮), সেলিম (৩৪), আসাদুজ্জামান ওরফে ইমন (২৩), আনোয়ার হোসেন (৩৬), সজল (৩০), বরকত গাজী (২৮), জুয়েল (৩৮), আরমান (৩০), বাদল (৩৮), কোরবান (২৮), নয়ন (২৭), মাসরুফ (২৩), আল আমিন (২৭), রাকিব (১৮), মিলন (২৫), ওয়াজিদ (৩৬), এরশাদ (২৫), ছালাম ওরফে সামাদ (৩৭) ও দিলসার (৩০)।