২০৫০ সালের কোনো এক বিকেল, বারান্দায় বসে আবির শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কয়েক বছর আগেও এই সময়টায় অবসরে সে হেডফোনে গান শুনত, কিন্তু এখন সেটাও করা যাচ্ছে না। ইদানীং শোনা যাচ্ছে গানের সুরেই নাকি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অনেকটা সম্মোহনের মতো। অবশ্য দেশের সচেতন মহল এটাকে প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের মতে, আগে যেমন মানুষ ভূতে বিশ্বাস করত, এটাও তেমনি একটা ভুল ধারণা। কিন্তু আবিরের সেটা মনে হয় না। এই তো সেদিন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রাতুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে মাঝরাতে অন্যের ঘরে ঢুকে চারজনকে খুন করেছে। তা–ও আবার খুব নৃশংসভাবে, লাশগুলোর দিকে তাকানো যায় না। অথচ আবির তাকে খুব ভালো করেই চেনে, রাতুল রক্ত দেখলেই ভয় পেত, তার পক্ষে এটা করা কখনোই সম্ভব না। মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হচ্ছে এটা নিয়ে। রাতুল বলছে, সে শুধু মাঝরাতে নিজের বেডরুমে শুয়ে গান শুনছিল, তারপর কী থেকে কী হলো, তার মনে নেই। দুই ঘণ্টা পর সে নিজেকে একটা ডাস্টবিনের পাশে আবিষ্কার করল, সারা গায়ে রক্ত লেগে আছে।
আবির জানে, এ রকম কিছু অবাস্তব না, কিন্তু সমস্যাটা হলো কেউ তো আর সেটা বিশ্বাস করবে না। আবির জানে, বছরের পর বছর ধরে তার প্রিয় গানগুলো কেন সে বারবার শুনতে চায়, কেন যেই সুর তার পছন্দের, সেগুলো তার মা–বাবা অথবা তার চেয়ে বয়সে বড়দের পছন্দ হয় না। উচ্চ কম্পাঙ্কের বিটগুলো তার মনে যে মাধুরতা সৃষ্টি করে, তার মা–বাবা হয়তো বয়সের কারণে তা ঠিক সেভাবে শোনে না, যেভাবে সে নিজে শোনে। তাই একই গান তার কাছে একরকম, আর তার মা–বাবার কাছে অন্য রকম লাগে। এখন কম্পাঙ্ক আর তালের তারতম্য দিয়ে যদি কোনো গানকে একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, তাহলে এত দিনে তাদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এতে কার কী লাভ হতে পারে? রাতুল খুব সাধারণ একটা ছেলে, আবার যে চারজন খুন হয়েছে, তারাও খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয় যে তাদের মৃত্যুতে কারও স্বার্থ থাকতে পারে। তাহলে এটাতে কার কী লাভ? তবে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, যেটা হচ্ছে তা তার আশপাশেই হচ্ছে।
ইদানীং শোনা যাচ্ছে গানের সুরেই নাকি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অনেকটা সম্মোহনের মতো। অবশ্য দেশের সচেতন মহল এটাকে প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের মতে, আগে যেমন মানুষ ভূতে বিশ্বাস করত, এটাও তেমনি একটা ভুল ধারণা।রাতুলের বাসার কাছাকাছি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কি না, আবির তা লক্ষ রাখতে শুরু করল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে একটা লোককে রাতুলের বাসার পাশ দিয়ে যেতে দেখে। ব্যাপারটা সত্যিই সন্দেহজনক। তারপর একদিন আবির লোকটাকে অনুসরণ করা শুরু করল। কিছু দূর গিয়ে একটা নির্জন স্থানে লোকটা তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিল, আশপাশে তাকিয়ে একটা হেডফোন কানে দিল সে। এরপর যা হলো সেটার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ লোকটা ঝোপের আড়ালে থাকা একটা বিড়ালকে নির্মমভাবে হত্যা করল। ব্যাপারটা একদম অপার্থিব। কিছুক্ষণ পর সে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, কানে এখন আর হেডফোনটা নেই। আবির তাকে আবারও অনুসরণ করা শুরু করল। এখন আর তাকে দেখে অপার্থিব মনে হচ্ছে না। লোকটা একটা প্রথম সারির বেসরকারি ল্যাবের কাছে এসে দাঁড়াল, পেছনের পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে তা স্ক্যান করিয়ে ঢুকে পড়ল। এরপর আর আবিরের কিছুই করার নেই। তবে তাকে এখানে প্রবেশ করতেই হবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে অনধিকার প্রবেশ তৃতীয় মাত্রার অপরাধ, ধরা পড়লে কমপক্ষে দশ বছরের জন্য জেলে যেতে হবে। যদিও আবির মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যে করেই হোক এখানে প্রবেশ করবে সে।
পরদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আবির আবারও লোকটাকে অনুসরণ করা শুরু করল, মোড়ের কাছে একটা জায়গায় কিছুটা ভিড় দেখে লোকটাকে ধাক্কা দিল সে, আর এই সুযোগে পেছনের পকেট থেকে তার আইডি কার্ড নিয়ে নিল। তাকে সরি বলে তাড়াতাড়ি সেই ল্যাবের কাছে চলে এল আবির, আইডি স্ক্যান করিয়ে চুপিসারে সেখানে প্রবেশ করল সে। তখন ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, সন্ধ্যার আগে প্রায় ত্রিশ মিনিটের একটা বিরতি থাকে এখানে। ভেতরে কাউকেই সে দেখতে পেল না। মোটামুটি নিরাপদ একটা জায়গা বেছে বসে পড়ল আবির, এখান থেকে পুরো ল্যাবের ওপর নজর রাখা যাবে, ধরা পড়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যাবের কার্যক্রম শুরু হলো, একজন একজন করে ল্যাবের সদস্যরা আসতে শুরু করল, আর আবির মনোযোগ দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। দূর থেকে ঠিকঠাক বুঝতে না পারলেও আবিরের মনে হলো, স্থানীয় দোকানগুলোর হেডফোনে এই প্রতিষ্ঠানটির লোকেরা বিশেষ কোনো সেন্সর যোগ করছে, যার মাধ্যমে তারা দূর থেকেই শ্রোতা কী শুনছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে সেটা তো শুধু একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করবে, এর বাইরে তো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। আবির এতক্ষণ ধরে এসব চিন্তা করছিল, হঠাৎ পেছন থেকে একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করল। পেছনে ফিরল আবির, তবে খুব ধীরে ধীরে। এই পেছনে ফেরার মুহূর্তটা ওর কাছে যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হলো। আবির খুব ভালো করেই জানে, সে ধরা পড়ে গেছে। তার মনোজগতের কোনো এক কোণে হয়তো এখন ঝড় বয়ে চলেছে, যেখানে সে ভাবছে কেন শুধু শুধু এত ঝুঁকি নিতে গেল? ঝুঁকি নিয়ে কী-ই বা লাভ হলো? আবার তার মনোজগতের অন্য এক কোণে হয়তো তৈরি হয়েছে বিশাল এক শূন্যতা, সেখানে হয়তো তার পৃথিবীটাই থমকে গেছে, যেখানে তার জীবনের গল্পটা থেমে আছে এক ভীষণ নিস্তব্ধতায়। আবিরের ভাবনার সময়টাকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়ে পেছন থেকে নারী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘বসে থেকে লাভ নেই, উঠে পড়।’ অবশেষে আবির পেছনে ফিরল, মনে হলো যেন কতকাল পেরিয়ে গেছে, সময়টা বুঝি থেমে গেছে। তার মাথাটা খুব হালকা লাগছিল, অদ্ভুত এক শূন্যতা যেন ঘিরে ধরেছে তাকে। পেছনে মাঝ বয়সী এক নারী দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ল্যাব কোট, এক হাতে গ্লাভস, অন্য হাতটা দিয়ে আবিরকে স্পর্শ করেছিল সে। হালকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তুমি কি মতিনের আইডি নিয়ে এসেছ নাকি? ও বলল, আজ বিকেল থেকে আইডি কার্ড খুঁজে পাচ্ছে না।’ সুবোধ বালকের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল আবির।
‘এটা যে তৃতীয় মাত্রার অপরাধ, সেটা জানা আছে নিশ্চয়ই?’
আবারও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল আবির।
‘যা–ই হোক, আমি সুস্মিতা, আপাতত তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ল্যাবের পক্ষ থেকে তোমাকে কিছু কাজ দেওয়া হবে। ঠিকমতো করতে পারলে শাস্তি নিয়ে তোমার চিন্তার প্রয়োজন পড়বে না।’
আবিরের নির্লিপ্ততা দেখে আবারও বলে উঠল সুস্মিতা, ‘তাহলে কি পুলিশে ফোন করে জানিয়ে দেব? দশ বছরের জেল নিশ্চিত, তুমি হাতেনাতে ধরা পড়েছ।’
আবির মাথা নিচু করে বসে ছিল। সুস্মিতা একটা হেডফোন নিয়ে এসে ওর সামনে রেখে বলল, ‘যখন তোমাকে ফোন করে বলা হবে, তখন এই হেডফোনটা কানে গুঁজে দেবে। তোমাকে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। প্রয়োজন পড়লে, তোমাকে আবার ডাকা হবে।’
পেছনে মাঝ বয়সী এক নারী দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ল্যাব কোট, এক হাতে গ্লাভস, অন্য হাতটা দিয়ে আবিরকে স্পর্শ করেছিল সে। হালকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তুমি কি মতিনের আইডি নিয়ে এসেছ নাকি? ও বলল, আজ বিকেল থেকে আইডি কার্ড খুঁজে পাচ্ছে না।’ সুবোধ বালকের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল আবির।অবশেষে আবির হেডফোনটা তুলে নিল। হেডফোনটা নিয়ে সে চলে আসছিল, পেছন থেকে সুস্মিতা বলে উঠল, ‘তোমার জন্য শুভকামনা, আবির।’ পরক্ষণেই থমকে দাঁড়াল আবির, তার নাম জানার কোনো কারণ নেই সুস্মিতার। মস্তিষ্কজুড়ে থাকা বিশাল একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে আবির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এল, একটাবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকাল না সে। তাকালে হয়তো দেখতে পেত, সুস্মিতার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
পরদিন সকাল সাতটায় সুস্মিতার ফোনে ঘুম ভাঙল আবিরের। আবির কাল ওদের ল্যাবে তার স্কুলের পরিচয়পত্র ফেলে এসেছে। সুস্মিতা তাকে বলল, বিকেলে আবিরের পরিচয়পত্র ফিরিয়ে দিতে তাদের বাড়ির পাশের রেস্টুরেন্টে যাবে মতিন; আবির যেন সময়মতো সেখানে উপস্থিত থাকে, সেই সঙ্গে মতিনের ল্যাবের আইডি কার্ডটা যেন নিয়ে আসে।
বিকেল পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট, রেস্টুরেন্টে বসে মতিনের অপেক্ষা করছে আবির। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে কীভাবে সুস্মিতা তার নাম জানল। ঠিক পাঁচটা ত্রিশ মিনিটে মতিন সেখানে এল। আবিরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল মতিন, সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিল তার স্কুলের পরিচয়পত্রটা। আবিরও তার পকেট থেকে মতিনের ল্যাবের আইডিটা বের করে এগিয়ে দিল। মতিন দুটি কফির অর্ডার দিয়ে বসে পড়ল। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘তা তোমার স্কুলের আইডিটা একটু নেড়েচেড়ে দেখো, আমার তো মনে হয় ওটা নকল।’ আবির বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর পরিচয়পত্রটা পর্যবেক্ষণ করে বুঝল, নতুন করে প্রিন্ট করা একটা পরিচয়পত্রের চাকচিক্য কমাতে বালুতে অথবা ময়লায় ঘষাঘষি করা হয়েছে, কিন্তু ভালোভাবে খেয়াল করলে সেটা ঠিকই বোঝা যায়। সে শান্তকণ্ঠে বলল, ‘হুম, নকল।’ মতিন একটু হেসে বলল, ‘তাই বলি, সুস্মিতা এতটা কাঁচা কাজ করার মানুষ না। ল্যাবে তোমার অনধিকার প্রবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ তোমার এই পরিচয়পত্র, ওটা এত সহজে তুমি পাচ্ছ না।’ বাকিটা সময় আবির চুপ থেকেই কাটাল। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল আবির, খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছে সে।
বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে এসে আবিরের মনে হলো তাকে কেউ অনুসরণ করছে, পেছনে তাকাতেই একটা ছায়া যেন সরে গেল বাড়ির সামনের গলিতে। কেউ একজন আবিরকে অনুসরণ করে বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। আবিরের এখন এত কিছু চিন্তা করতে ভালো লাগছে না, নির্বিকারচিত্তে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল সে।
পরদিন সকালে আবারও সুস্মিতার ফোনে ঘুম ভাঙল আবিরের। সুস্মিতা তাকে হেডফোনটা কানে দিতে বলল। আবির এবার একটু নেড়েচেড়ে দেখল হেডফোনটা। কোনো ব্র্যান্ডের নাম লেখা নেই সেটায়। হেডফোনটা নিজের মুঠোফোনের সঙ্গে সংযুক্ত করে কানে দিল আবির। সুস্মিতার কথামতো একটা অ্যাপ ইনস্টল করে নিল আবির। অ্যাপটা বেশ রেস্ট্রিকটেড, সুস্মিতা ব্যক্তিগতভাবে তাকে পাঠিয়েছে। আপাতত আবিরের কাজ হচ্ছে, তার বাড়ির পাশের পার্কটায় মর্নিং ওয়াকে যাওয়া। আবির পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়ল।
আবির এবার একটু নেড়েচেড়ে দেখল হেডফোনটা। কোনো ব্র্যান্ডের নাম লেখা নেই সেটায়। হেডফোনটা নিজের মুঠোফোনের সঙ্গে সংযুক্ত করে কানে দিল আবির। সুস্মিতার কথামতো একটা অ্যাপ ইনস্টল করে নিল আবির। অ্যাপটা বেশ রেস্ট্রিকটেড, সুস্মিতা ব্যক্তিগতভাবে তাকে পাঠিয়েছে।পার্কের পথ ধরে হাঁটছে আবির, কানের হেডফোনে বাজছে পরিচিত একটা গান। সুস্মিতার পাঠানো অ্যাপটা পুরোপুরি একপাক্ষিক। অ্যাপের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুস্মিতার কাছে, আবিরের নিজের পছন্দসই গান শোনার সুযোগ নেই, সুস্মিতার যেটা ইচ্ছা সেটাই শুনতে হচ্ছে তাকে। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে কীভাবে সেন্সরের সাহায্য ছাড়াই অ্যাপ দিয়ে শ্রোতা কী শুনছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ল্যাব কর্তৃপক্ষ। সুস্মিতা মাঝেমধ্যে আবিরকে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছিল, এই যেমন একটু পর আবির যাতে ডানের রাস্তাটা ধরে এগোয়, সেটা সে বেশ জোর দিয়েই বলল। আবির তার নিজের ফোনের সব রকম লোকেশন সংক্রান্ত সেবা বন্ধ করে রেখেছে। সে বুঝতে পারল, হেডফোনটার সঙ্গে ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানো আছে, নয়তো সুস্মিতার পক্ষে তার অবস্থান এতটা সুস্পষ্টভাবে জানার কথা না। পার্কে আজ ভালোই মানুষ লক্ষ করল আবির, বেশ কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। বেশ কয়েকটা পরিচিত গানের পর একটি অপরিচিত আর অদ্ভুত গান শুনতে পেল আবির, বাধ্য হয়ে সেটাই শুনতে হলো তাকে। সুস্মিতার নির্দেশ, ও না বলা পর্যন্ত কোনোভাবেই হেডফোন খোলা যাবে না। সেই গানের সুর তীক্ষ্ণ ফলার মতো এসে বিঁধছে আবিরের বুকে। গানের লাইনগুলো যেন এক পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে তার ওপর। চারপাশের পরিবেশে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করল সে। পার্কের এই দিকটায় কাউকেই দেখতে পেল না আবির। একটু আগেও মানুষের কোলাহলে বিরক্ত ছিল সে, এখন কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। সামনের গাছটায় বিশাল এক ভিমরুলের চাক লক্ষ করল আবির। এইখানে বিকেলে অনেক শিশু খেলতে আসে, তাই এখানে এই চাকটা থাকা ভীষণ বিপজ্জনক। কী মনে করে সেই গাছে চড়ে বসল আবির, পেছনের পকেট থেকে ছোট একটা চাকু বের করে নিল। চাকুটা ছোট কিন্তু ধারালো, নিরাপত্তার স্বার্থে সব সময় সঙ্গে রাখে সে। বেশ সতর্কতার সঙ্গে ভিমরুলের চাকসহ পুরো ডালটাই কাটতে শুরু করল আবির। শেষ দিকে একটু ভুল করে ফেলল সে, ডালটা ওর ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ভারী হওয়ায় চাকসহ পুরো ডালটা নিচে পড়ে গেল। আবিরকে অবাক করে দিয়ে চাকের ভেতর থেকে একটা ভিমরুলও বেরিয়ে এল না। আবির নিচে এসে যখন পুরো ডালটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে দেখল, তখন কোথাও সেই ভিমরুলের চাকের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। আচ্ছন্নের মতো আবার পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল আবির। তার মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে, একটু আগে যা হলো তা নিছক মনের ভুল হতেই পারে না। আবিরের স্পষ্ট মনে আছে, সেই ভিমরুলের চাকের কথা, সেটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল? আবিরের ভাবনায় ছেদ পড়ল সুস্মিতার ফোনে। সে আবিরকে জানাল, এখন চাইলে সে হেডফোন খুলে ফেলতে পারে, তার কাজ হয়ে গেছে।
পরের কয়েকটা দিন একইভাবে সুস্মিতার কথা অনুযায়ী কাজ করে গেল আবির। এক সপ্তাহ পর সুস্মিতা তাকে আবারও সেই রেস্টুরেন্টে ডাকল। এবারে মতিনের বদলে সুস্মিতা নিজেই এসেছে। সুস্মিতার হাতে কিছু পত্রিকার পাতা লক্ষ করল আবির। গত কয়েক দিন পত্রিকায় নজর বোলানো হয়নি তার। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সুস্মিতা বলল, ‘তা আবির, তোমার সমাজসেবা কেমন চলছে?’ প্রশ্নটা ঠিকঠাক না বোঝায় আবিরকে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত দেখাল। সুস্মিতা তার হাতে থাকা একটা পেপার কাটিং এগিয়ে দিল আবিরের দিকে। আবির দ্রুততার সঙ্গে নজর বোলাতে থাকল খবরটার ওপর, ওর বাড়ির পাশের সেই পার্কের কথা লেখা সেখানে। পার্কের একটা গাছে অনেকগুলো বাবুই পাখির বাসা ছিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী আজ থেকে ছয় দিন আগে কেউ একজন বাবুই পাখির বাসাসহ ডাল কেটে ফেলেছে। সদ্য জন্ম নেওয়া অনেক পাখির ছানা, সেই সঙ্গে অনেকগুলো ডিম নষ্ট হয়েছে তাতে। আবির যা বোঝার বুঝে নিল, এতগুলো প্রাণের এই পরিণতির পেছনে সে দায়ী, এটা ভাবতেই তার ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছে। সুস্মিতা বাকি পেপার কাটিংগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা পড়েই এই হাল, বাকিগুলোও একটু দেখে নাও।’ আর পড়ার সাহস হলো না আবিরের, ভেতর থেকে খুব অস্বস্তিকর একটা শীতল অনুভূতি টের পাচ্ছে সে। মাথাটা যেন হালকা হয়ে আসছে, তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল।
বাইরে কোথাও বেশ জোরে বাজ পড়ল, ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল আবির। আবছা আঁধারে ঘরটাকে খুব চেনা মনে হলো, হ্যাঁ, এটা তারই বেডরুম। সময় এখন রাত ৩টা, সালটা ২০২৫। আতঙ্কে সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে আবিরের। তড়িঘড়ি করে নিজের হেডফোনটার দিকে নজর দিল সে, তার প্রিয় ব্র্যান্ডের নামটা স্পষ্ট লেখা আছে ওটায়। অবশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আবির, ইদানীং খুব ভয়ংকর আর অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছে সে। বারান্দায় এসে দাঁড়াল আবির, হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি। চারদিক বেশ নিস্তব্ধ, একটু আগে বৃষ্টিটা থেমেছে, সামনের গলির রাস্তাটা তাই ভিজে আছে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারদিকটা একনজর দেখে নিচ্ছিল আবির, ল্যাম্পপোস্টটার নিচে চোখ আটকে গেল তার। কালো রেইনকোট পরা একটা লোক যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে; মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস। দেহের গড়নটা কেন জানি আবিরের খুব চেনা মনে হলো, মতিন নয় তো? সেটা হওয়াটা বাস্তবসম্মত না, মতিন শুধুই তার দুঃস্বপ্নের একটা চরিত্রমাত্র। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আসলেই কি নেই? মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার হাতড়ে আবির মনে করার চেষ্টা করল মতিনের মুখাবয়ব, তবে খুব একটা মনে পড়ছে না। মাস্কটা খুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল লোকটা, বেশ ধীরে ধীরে আয়েশি ভঙ্গিমায় সিগারেটে তার প্রতিটা টান যেন আবিরকে আরও বেশি ধোঁয়াশায় ঘিরে ফেলছে। এবারে লোকটা পেছন দিকে ফিরে হাঁটতে শুরু করল। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে সে, অন্ধকার রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সিগারেটের ঘন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ক্রমেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল সে। পেছনে রেখে গেল আবিরকে, সেই সিগারেটের ধোঁয়া যেন তার মস্তিষ্কের কোষগুলোয় ঘুরে বেড়াতে লাগল দলছুট, দিগ্ভ্রান্ত এক মৌমাছির মতো।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব শ ত র মন মত ন র র জন য র আইড র একট
এছাড়াও পড়ুন:
জরুরি প্রয়োজনে খরচ, কী প্রস্তুতি থাকা দরকার
জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সময় মানুষের টাকার প্রয়োজন হতে পারে। এ নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। এটাই নির্জলা বাস্তবতা। কিন্তু সমস্যা হলো দেশের অনেক মানুষ এই জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কোনো সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করেন না। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনাও থাকে না। তাই হঠাৎই যখন এমন বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন মানুষ খেই হারিয়ে ফেলেন।
বিশেষ পরিস্থিতি কী? ধরা যাক, পরিবারের কোনো সদস্য হঠাৎই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন কিংবা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য ভালো পরিমাণের টাকার প্রয়োজন হয়। আবার পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে পড়াশোনা করতে পারেন, তখন এক ধাক্কায় অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আবার এমন হতে পারে, আপনি ব্যবসা করতে চাচ্ছেন, তখন হঠাৎ একটা বিনিয়োগের সুযোগ চলে এল। ওই সময় হাতে টাকা থাকলে সেই বিনিয়োগটা করা যায়। এভাবেই জরুরি প্রয়োজনে টাকা খরচের বাস্তবতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটু পরিকল্পনা করলেই হয়।
এবার দেখা যাক, কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে১. মাসিক সঞ্চয়
মাসিক আয়ের একটি অংশ শুরুতেই সরিয়ে রাখুন। বেতন অল্প হলে এ ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প খুব কার্যকর। ব্যাংকে ডিপিএস করতে পারেন। কিংবা কিছু টাকা জমলে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখতে পারেন।
২. আয়-ব্যয়ের হিসাব
সঞ্চয়ের অন্যতম শর্ত হলো নিজের আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা। যেমন ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে, তার সুদ কত আসছে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। আবার কোথায় কত টাকা খরচ হচ্ছে, এর সঠিক হিসাব রাখা। সংসারের অপ্রয়োজনীয় খরচ হচ্ছে, তা নজরে রাখতে হবে।
৩. সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ
উচ্চমাধ্যমিক পাসের সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ নিয়ে অনেক পরিবার বিপাকে পড়ে যান। বহু পরিবারের সন্তান অর্থের অভাবে নিজের পছন্দমতো বিষয়ে বা পছন্দ মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন না। সেই সময়ে তার পড়াশোনার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার দরকার হতে পারে। সেই সময় খেয়াল করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করুন, যাতে প্রয়োজনের সময়ে হাতে টাকা পাওয়া যায়। এর জন্য কার্যকর মাধ্যম হতে পারে দেশের প্রচলিত শিক্ষাবিমা। চাইলে অনেকে সঞ্চয়পত্রও করতে পারেন, যদি একসঙ্গে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করার সক্ষমতা থাকে।
৪. চিকিৎসার খরচ
হঠাৎ পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হতে পারেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার দরকার হয়। হঠাৎ বিপাকে পড়া এমন পরিবারের প্রধান অবলম্বন হতে পারে স্বাস্থ্যবিমা। এ ছাড়া অনেক পরিবারের সদস্যের ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এমন জরুরি খরচও বিমা থেকে করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন কয়েক বছর আগে থেকে বিমা পরিকল্পনা করা।
৫. ভরসা যখন ক্রেডিট কার্ড
বিপদের সময় ক্রেডিট কার্ডও ভরসা হয়ে ওঠে। তাই প্রয়োজন মতো ক্রেডিট কার্ড রাখুন। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিলে সুদের অঙ্ক কম হবে, তা বুঝে নিতে হবে। অনেক সময় আচমকা টাকার দরকার হলে ক্রেডিট কার্ড কাজে লাগতে পারে। তবে সময় মতো সেই ধার শোধ করা জরুরি। একই সঙ্গে দেশের এমএফএস সেবা বিকাশও এখন অ্যাপ থেকে গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকঋণের সুদের হারেই এই সুদ নেওয়া হয়। ফলে স্বল্পকালীন ছোট খরচ মেটানোর জন্য এই ঋণ হতে পারে খুবই কার্যকর মাধ্যম। ঋণের অঙ্ক নির্ভর করে গ্রাহকের লেনদেনের অঙ্কের ওপর।
সঞ্চয়ের কার্যকর তিন ধরনজরুরি পরিস্থিতির জন্য কার্যকর সঞ্চয় পরিকল্পনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সময়ভিত্তিক সঞ্চয়ের ভারসাম্য তৈরি করা। অর্থাৎ সব টাকা এক জায়গায় না রেখে আয় ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—এই তিন ধরনের সঞ্চয়ের ব্যবস্থা রাখা।
হঠাৎ চিকিৎসা, ভ্রমণ বা অপ্রত্যাশিত খরচের জন্য নগদ ব্যবহারযোগ্য সঞ্চয় রাখুন। এটি হতে পারে ব্যাংক হিসাব, মোবাইল ওয়ালেট বা সঞ্চয়পত্র। সাধারণত তিন থেকে ছয় মাসের খরচের সমপরিমাণ অর্থ এখানে রাখা নিরাপদ।
যেসব লক্ষ্য দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পূরণ করতে চান। যেমন সন্তানের স্কুল-কলেজ ফি, বাড়ি সংস্কার ইত্যাদি। এ জন্য মধ্যমেয়াদি সঞ্চয় দরকার। এ জন্য ব্যাংকে এফডিআই বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
অবসরজীবন, সন্তানের উচ্চশিক্ষা বা বড় সম্পদ গঠনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ জরুরি। এটি হতে পারে সরকারঘোষিত পেনশন প্রকল্প, জীবনবিমা বা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়পত্র। এতে মূলধন অক্ষুণ্ন রেখে নিয়মিত আয় পাওয়া সম্ভব।