কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থেকে আয় হলেও চালু হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ রুট
Published: 7th, May 2025 GMT
কুমিল্লা বিমানবন্দর দেখলে বোঝার উপায় নেই, এক সময় এখানে বিমান ওঠানামা করত। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় সুবিশাল রানওয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে পিচ ঢালাই ও ব্লক। এখন সেখানে উড়ছে ধুলাবালি। বিমানবন্দরের সংরক্ষিত অধিকাংশ এলাকায় ঘাস ও ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। অনেক জমি বেদখল হয়ে গেছে। তবে এখানকার সিগন্যাল যন্ত্র ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রুটের ৩৫ থেকে ৪০টি ফ্লাইট থেকে প্রতি মাসে সরকার আয় করছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব।
কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে এখনও ২৪ জনশক্তি কাজ করেন। বিমাবন্দরের দায়িত্বরত প্রকৌশলী মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অল্প জনবল নিয়োগ ও রানওয়ে মেরামত করলেই বিমানবন্দরটি চালু করা সম্ভব। এই বিমানবন্দরের সিগন্যাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের উড়োজাহাজ।
সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের জন্য পরিত্যক্ত সাতটি বিমানবন্দর চালু করার কথা জানান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া। বিমানবন্দরগুলো হলো– বগুড়া, লালমনিরহাট, শমশেরনগর, ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা ও রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর। এগুলো চালু হলে পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বলে মনে করেন বেবিচক চেয়ারম্যান।
জানা যায়, কুমিল্লা শহরতলির দক্ষিণে তিন কিলোমিটার দূরে নেউরা, ঢুলিপাড়া, রাজাপাড়া, দিশাবন্দসহ কয়েকটি এলাকার ৭৭ একর জমিতে বিমানবন্দরটি স্থাপন করে যুক্তরাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে (১৯৪১-৪২) অনেকটা তড়িঘড়ি করেই এটি নির্মাণ করা হয়। তবে বিমানবন্দরটি ১৯৯৪ সালে যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে কুমিল্লার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের জন্য বেশ কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স আগ্রহী। ইউএস-বাংলার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশের অন্যতম প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা কুমিল্লা। এখানকার ইপিজেড, বিসিক, কয়েকশ শিল্পকারখানার সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ রাখতে হয়। এ ছাড়া কক্সবাজারের কাছে হওয়ায় পর্যটক যাতায়াতের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিমানবন্দরটি চালু চলে ২৫ মিনিটে ঢাকা ও ৪০ মিনিটে কক্সবাজার যাতায়াত সম্ভব। বিমানবন্দরটি চালু করতে তারা বেশ কয়েক বছর যাবৎ সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন বলে জানালেন তিনি।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের সিএনএস প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে এখানে নেভিগেশন ফ্যাসিলিটিজ, ডিভিওআর, ডিএমই, ভিসেট, এয়ার কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর, যাত্রীদের জন্য আলাদা কক্ষও আছে। শুধু উদ্যোগ নিয়ে রানওয়ে মেরামত ও কিছু যন্ত্রপাতি আনা হলেই অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল শুরু করা যাবে।
কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ডা.
একটি সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের পুরো জমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তাই বিমানবন্দর চালু করতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেবিচককে যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। কুমিল্লা বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো চিঠি এখনও আসেনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ম নবন দরট ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্টার্টআপ বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে হলে
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগের বিস্তার একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকজুড়ে এক বৈপ্লবিক গতি পেয়েছে। স্টার্টআপ এখন শুধু একটি ব্যবসা উদ্যোগ নয়, বরং নতুন অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা ও উদ্যোক্তামনস্কতার সংমিশ্রণে এই স্টার্টআপ মডেল তরুণদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই স্বপ্নযাত্রার প্রধান বাধা অর্থায়ন বা ফান্ডিং। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। এখানে সম্ভাবনা থাকলেও কাঠামোগত জটিলতা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও বিনিয়োগকারীদের অনীহার কারণে অনেক স্টার্টআপ অঙ্কুরেই
ঝরে পড়ে।
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের প্রবণতাও বড় পরিবর্তন এসেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক ক্যাপিটাল মার্কেট কোম্পানি সিবি ইনসাইটসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক স্টার্টআপ ফান্ডিং ৩৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ সুদের হার এবং লাভজনকতার প্রতি বিনিয়োগকারীদের অধিক মনোযোগ এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী। এই বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার মতো উদীয়মান বাজারের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের চিত্রটিও মোটেই ভিন্ন নয়। বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম। একই বছরে বিনিয়োগের ৯৯ শতাংশই এসেছে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে, যা দেশে স্থানীয় পুঁজির সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তোলে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিনিয়োগ আরও কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় পতন ছিল ৭৭ শতাংশ (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, অক্টোবর ২০২৩)। এই সংকটের পেছনে রয়েছে একাধিক কাঠামোগত দুর্বলতা। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের স্টার্টআপ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, বিনিয়োগ ঝুঁকি গ্রহণে অনীহা এবং নীতিগত অস্বচ্ছতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা জরুরি। ২০২৪ জানুয়ারি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবর অনুযায়ী, ভারতে ২০২৩ সালে স্টার্টআপ ফান্ডিং ৬০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। রেস্ট অব ওয়ার্ল্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে পাকিস্তানে স্টার্টআপ ফান্ডিং নেমে এসেছে ১৫ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলারে, যা ২০২০ সালের পর সর্বনিম্ন। অথচ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভারত ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে, যেখানে সরকার, করপোরেট ও একাডেমিয়া মিলিতভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সমন্বয় এখনও অনুপস্থিত।
বিষয়টি আরও গভীরভাবে বোঝার জন্য আমাদের বুঝতে হবে, কেন বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনও স্টার্টআপকে ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ বলে বিবেচনা করেন না। এর উত্তর লুকিয়ে আছে দেশের বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে। স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ ও মেধাসম্পদ– যা প্রথাগত ব্যবসার দৃষ্টিতে অদৃশ্য বা অননুমেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে এসব অ্যাসেট বিবেচনায় না নিয়ে তাকে কম মূল্য দিয়ে থাকে অনেক বিনিয়োগকারী।
এখানে যদি দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেখি, ২০১৯ সালে দেশটির সরকার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের একটি স্টার্টআপ ইনিশিয়েটিভ চালু করে। সরকারি তহবিল, কর ছাড় ও প্রযুক্তি পার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা পাঁচ বছরে ইউনিকর্ন স্টার্টআপ সংখ্যা ১৫ থেকে ৩৪-এ উন্নীত করে। বাংলাদেশেও ২০২০ সালে আইসিটি ডিভিশনের অধীনে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ গঠিত হয়, যার প্রাথমিক তহবিল ছিল ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই তহবিল থেকে কার্যকর প্রকল্পে কতটা বণ্টন হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা নেই।
এই সংকট উত্তরণে সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজন একটি জাতীয় স্টার্টআপ নীতি, যেখানে কর রেয়াত, রপ্তানি প্রণোদনা, সহজতর কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উচিত স্টার্টআপ লোন প্যাকেজ চালু করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে আংশিক গ্যারান্টি প্রদানের চিন্তা করা। একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘ইনোভেশন হাব’ বা ইনকিউবেটর তৈরির সুযোগ দিলে তরুণ উদ্যোক্তারা গবেষণা থেকে ব্যবসার বাস্তবায়ন পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ যাত্রা সম্পন্ন করতে পারবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। তাদের কাছে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোকে পিচ করার জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারে, যেটি হবে সরকার-প্রণোদিত এবং স্বচ্ছ পদ্ধতিতে পরিচালিত। একইভাবে আন্তর্জাতিক ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়েও স্টার্টআপ পুঁজি সংগ্রহ সম্ভব।
স্টার্টআপ এখন শুধু ব্যবসা নয়, এটি একটি ‘ভিশন’। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে স্টার্টআপের ভূমিকা অপরিসীম। সরকার, বিনিয়োগকারী এবং সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ
ছাড়া বাংলাদেশ এই সম্ভাবনার দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে না।
মীর হাসিব মাহমুদ: সহ-প্রতিষ্ঠাতা-লিড নেশন একাডেমি (এলএনএ), চিফ বিজনেস অফিসার-গোইয়ারা লিমিটেড ও ফাউন্ডার-বেস্ট এইড