বাংলাদেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা অনেকখানি ফিরে এসেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার বেড়ে এপ্রিল মাসের শেষে গ্রস রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ডলারের দাম ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। এর মধ্যে দুটি ব্যাংক—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক—নিজেদের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সহায়তা দিতে হয়নি।

বাকি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেওয়ায় ওগুলোও দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে হয়তো রক্ষা পেয়ে গেছে। এরপরও কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা এখনো খুবই কাহিল। সেগুলোকে মার্জারের মাধ্যমে বড় কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়া  এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.

আহসান মনসুর ইতিমধ্যেই কয়েকবার আশ্বাস দিয়েছেন, এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা তাঁদের আমানতের টাকা ফেরত পেতে কোনো অসুবিধে হবে না। ওপরে আর্থিক খাতের যে চিত্র তুলে ধরা হলো, সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

গত ৯ মাসে দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই ধারা অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে পড়তে শুরু করলেও আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি সাফল্য বয়ে এনেছে। একটি অর্থনৈতিক ‘মেল্টডাউন’ থেকে জাতি রক্ষা পেয়েছে। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ আশকারা পেয়ে গত এক দশকে বিদেশে পুঁজি পাচার দেশের অর্থনীতিতে এক নম্বর সমস্যায় পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজি লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি।

২০২৪ সালের ৭ আগস্ট বণিক বার্তার শিরোনাম খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ওই বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিন বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা পায়নি। ঋণের অর্থ ব্যতিরেকেই যদি ডলারের দামকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশ কেন আইএমএফের এ রকম বিপজ্জনক শর্ত মেনে নেবে?

গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে গেলেন। আর যাওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন থেকে চার গুণ বেশি দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখো কোটি টাকা। গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসবকাল।

শ্বেতপত্র কমিটি দেখিয়েছে, স্বৈরশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে এরা দুর্বল করে ফেলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামিয়েছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।

সম্প্রতি ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার আইএমএফের ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, আইএমএফ দুটি শর্তের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানে অসন্তুষ্ট। প্রথমটি হলো ডলারের বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করে ফেলার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি নয়। দ্বিতীয়টি হলো সরকারি রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতকে বর্তমান সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সরকারের অনাগ্রহ।

ডলারের দামকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করলে ওই বাজারের ম্যানিপুলেটর ও অ্যাগ্রিগ্রেটরদের তাণ্ডবে ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে বাড়তে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় উঠে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা এখনই ডলারের দামকে বাজারভিত্তিক করে পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো ডলারের দাম নিয়ে সংকট ডেকে আনতে চায় না। পাকিস্তানে এখন ১ ডলারের দাম ২৮০ রুপি এবং শ্রীলঙ্কায় ৪০০ রুপি। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ১ ডলারের দাম ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রাখা গেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা পায়নি। ঋণের অর্থ ব্যতিরেকেই যদি ডলারের দামকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশ কেন আইএমএফের এ রকম বিপজ্জনক শর্ত মেনে নেবে?

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে, বাংলাদেশের এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে আট মাস ধরে অফিশিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স–প্রবাহের প্রবৃদ্ধির ধারার কারণে। সেই ধারা এখনো অক্ষুণ্ন আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর  গত ২৬ এপ্রিল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আইএমএফের ঋণের কিস্তি না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনই চলবে। বাংলাদেশের লক্ষ্য নিজস্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করা।’ এই দৃঢ়তা খুব শুভ লক্ষণ। এই দৃঢ়তা যেন বাস্তববাদী হয়।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইএমএফ র ঋণ র ক স ত সরক র র ১ দশম ক আর থ ক ঋণ র স

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে প্রতি বর্গকিলোমিটার দখল করার দাম দাঁড়াচ্ছে ২৭ রুশ সেনার প্রাণ

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময় ছিল গত বছর। এ বছর অন্তত ৪৫ হাজার ২৮৭ জন নিহত হয়েছেন।

নিহতের এ সংখ্যা যুদ্ধের প্রথম বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ এবং ২০২৩ সালে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি। এ যুদ্ধে ২০২৩-এ বাখমুতে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণঘাতী লড়াই হয়।

যুদ্ধের শুরুতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলের একেকটি লড়াইয়ে ধাপে ধাপে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে ২০২৪ সালে যুদ্ধের সম্মুখভাগ ধীরগতিতে এগোতে থাকায় নিহতের সংখ্যা মাসে মাসে বাড়তে থেকেছে। আর এটাই বিবিসিকে ইউক্রেনে কিলোমিটারপ্রতি ২৭ প্রাণহানির হিসাব প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। [এ হিসাব করা হয়েছে গত বছরের অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজারের ভিত্তিতে]

স্বতন্ত্র গণমাধ্যম মিডিয়াজোনা আর একদল স্বেচ্ছাসেবকের সহযোগিতায় বিবিসি রুশ সার্ভিস ওপেন সোর্স বা উন্মুক্ত সূত্রে প্রাপ্ত রাশিয়ার কবরস্থান, স্মৃতিসৌধ এবং শোক সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে।

এ পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার অভিযানে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৪৫ জন নিহত রুশ সেনার নাম শনাক্ত করেছে বিবিসি।

তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা স্পষ্টতই আরও অনেক বেশি। সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিবিসি নিহত সেনাদের যে সংখ্যা পেয়েছে, সেটা মোট নিহতের মাত্র ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ৬৪ হাজার ২২৩ থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজার ২১১ জনের মধ্যে হতে পারে।

২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির দিনটি রুশ বাহিনীর জন্য সে বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল।

ওই দিন দখলকৃত দোনেৎস্কের ভলনোভাখা শহরের কাছে একটি প্রশিক্ষণ ভূমি ইউক্রেনের দূরপাল্লার এইচআইএমআরএএস (উচ্চ গতিসম্পন্ন আর্টিলারি রকেট সিস্টেম) মিসাইল হামলায় ৩৬তম মোটরাইজড রাইফেল ব্রিগেডের সদস্য আলদার বাইরভ, ইগর বাবিচ, ওখুঞ্জন রুস্তামভসহ বহু সৈন্য নিহত হন।

একটি মেডেল প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য তাঁদের লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল। কমান্ডার কর্নেল মুসায়েভসহ এই হামলায় ৬৫ জন সৈন্য নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে।

সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল বারিশিয়া থেকে আসা ২২ বছর বয়সী বাইরভ খাদ্যের মান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করছিলেন। কিন্তু সামরিক চাকরিতে বাধ্যতামূলক ডাক পড়ায় তিনি পেশাদার সৈনিক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে যান। রুশ সেনারা সে বছরের মার্চে কিয়েভের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বোরোদিয়াঙ্কার যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধে শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় রুশ সৈনারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে ইউক্রেনীয় বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।

সাইবেরিয়ার চিতা শহরের ৩১ বছর বয়সী ওখুঞ্জন রুস্তামভ বিশেষ বাহিনীতে বাধ্যতামূলক চাকরি শেষে ঢালাইকর (ওয়েল্ডার) হিসেবে কাজ করতেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে রুশ বাহিনী আংশিক সেনা সংগ্রহের সময় তাঁকে সামরিক বাহিনীতে ডাকা হয়।

৩২ বছর বয়সী ইগর বাবিচ অবশ্য স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেরিব্রাল পালসিতে (জটিল স্নায়বিক রোগ) আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের ফিজিওথেরাপি দিতেন।

বিবিসির সংগৃহীত উপাত্ত অনুযায়ী, ওই দিন মোট ২০১ জন রাশিয়ান সৈন্য প্রাণ হারান।

প্রশিক্ষণ ভূমিতে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর রাশিয়ার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক সাফল্যের খবর দেন।

কিন্তু এতে প্রশিক্ষণ ভূমিতে হামলার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রোজকার প্রতিবেদনে এ বিষয়ে একটি শব্দও ছিল না।

ওখুঞ্জন রুস্তামভের এক আত্মীয় জানান, যুদ্ধ চলার সময় ইতিমধ্যে তিনি পরিবারের ঘনিষ্ঠ তিন সদস্যকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমার স্বামী মারা যান। ১০ ফেব্রুয়ারিতে আমার ধর্মপিতা (গডফাদার) এবং ২০ ফেব্রুয়ারিতে নিহত হন আমার সৎভাই। এক শবযাত্রা থেকে আরেক শবযাত্রা।’

বিশ্লেষণে বিবিসি সৈন্যদের মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট তারিখকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। যখন তা পাওয়া যায়নি, তখন তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ বা মৃত্যুর খবর প্রকাশের তারিখ ব্যবহার করেছে।

যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালে, রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করেছে। কখনো প্রচণ্ড যুদ্ধে অনেক মানুষ নিহত হতো, কখনো আবার পরিস্থিতি শান্ত থাকাত।

২০২৩-২৪ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তিবদ্ধ হওয়া হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ যোদ্ধাদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ২০২৩ সালের কথা ধরা যায়। বেশির ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে। এ সময় রুশ বাহিনী দোনেৎস্ক অঞ্চলের ভুহলেদার ও বাখমুত শহর দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল।

বিবিসির হিসাব অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের প্রথম বছরে রাশিয়া কমপক্ষে ১৭ হাজার ৮৯০ জন সৈন্য হারিয়েছে। এ হিসাবে দখলকৃত পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার দুই বদলি বাহিনী বা অনিয়মিত যোদ্ধাদলের ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করা হয়নি।

২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৬৩৩।

২০২৪ সালের কখনো হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে দেখা যায়নি। এ সময় আভদিভকা ও রোবোটাইনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পোক্রোভস্ক ও তোরেতস্কের দিকে তীব্র আক্রমণ চালানো হয়।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনী কুরস্ক অঞ্চলে সীমান্ত পেরিয়ে আক্রমণ চালালে সেখানেও বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত রুশ সেনারা নিহত হন। শুধু আগস্টের ৬ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে আনুমানিক ১ হাজার ২২৬ জন রুশ সেনা প্রাণ হারান।

তবে শীর্ষ পর্যায়ের মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যানের মতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে পূর্ব দিকে ধীর অগ্রগতির সময় রুশ বাহিনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।

মাইকেল কফম্যান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এ সময় সাঁজোয়া গোলন্দাজ আক্রমণকারীদের বিক্ষিপ্ত দল নিয়ে অবিরত আক্রমণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে রুশদের দখলে নেওয়া নতুন ভূখণ্ডের তুলনায় সামগ্রিক হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।’

প্রায় দুই বছর তীব্র যুদ্ধের পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর রাশিয়ান বাহিনী দোনেৎস্কের ভুহলেদার সামরিক সরঞ্জামের ঘাঁটি দখল করে নেয়।

যুদ্ধ-গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) অনুমান, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের ২ হাজার ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে।

এমনকি তখনো যুদ্ধের সম্মুখভাগে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পতন ঘটেনি।

এই অভিযানে অন্তত ১১ হাজার ৬৭৮ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।

ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিবিসি শুধু সেসব সেনাসদস্য ও কর্মকর্তা নিহত হওয়ার হিসাব করেছে, যাঁদের নাম প্রকাশ্য শোক সংবাদে ছিল এবং যাঁদের নিহত হওয়ার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ এ সময়সীমার মধ্যে পড়েছে।

আইএসডব্লিউর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে রাশিয়া সামগ্রিকভাবে ৪ হাজার ১৬৮ বর্গকিলোমিটার জমি দখল করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি বর্গকিলোমিটার দখলকৃত ভূখণ্ডের জন্য ২৭ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। তবু তো এখানে আহতের হিসাবে করা হয়নি।

যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে রুশ বাহিনীতে নিয়োগকে প্রভাবিত করছে

রাশিয়া বিভিন্ন উপায়ে নিজের কমতে থাকা সেনাবল বাড়ানোর পথ খুঁজে বের করেছে।

বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, ‘২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়া সেনা নিয়োগ বাড়ায়। নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা নিহতদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে মস্কো নতুন করে বহর সাজানোর সুযোগ পায়।

রাশিয়ার তিনটি অঞ্চলে নতুন নিয়োগ চুক্তিতে সই করা সেনাদের এককালীন প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সেনারা যে যুদ্ধভাতা পান, তা স্থানীয় গড় আয়ের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি।

যাঁরা ২০২৪ সালে কার্যকর হওয়া একটি আইনের বলে ফৌজদারি মামলার হাত থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন, বিবিসি তাঁদেরও ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসেবে গণ্য করেছে।

বিবিসির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নিহতদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এ পর্যন্ত শনাক্তকৃত মোট নিহত সেনাদের চার ভাগের এক ভাগই স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা।

২০২৩-২৪ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তিবদ্ধ হওয়া হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ যোদ্ধাদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

হতাহতের সংখ্যার বিবেচনায় রাশিয়ার বাশখোর্তোস্তান প্রজাতন্ত্র শীর্ষে রয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে ৪ হাজার ৮৩৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা, যাঁদের ৩৮ শতাংশ কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই যুদ্ধে গিয়েছিলেন।

রুশ শহর উফায় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এককালীন প্রণোদনা স্থানীয় গড় [মাসিক] বেতন ৬৭ হাজার ৫৭৫ রুবেলের (৬০০ পাউন্ড) ৩৪ গুণ।

উন্মুক্ত তথ্যসূত্র থেকে সংগৃহীত মৃত্যুর হিসাব সব সময়ই অসম্পূর্ণ থাকবে।

কেননা গত কয়েক মাসে নিহত সেনাদের বড় অংশের মরদেহ এখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই পড়ে থাকতে পারে। সেগুলো উদ্ধার করাও মাঠে সক্রিয় সেনাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

যদি দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর যোদ্ধাদের হতাহতের চিত্র আমলে নেওয়া হয়, তাহলে রুশ সেনাদের প্রাণক্ষয়ের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ।

শোক সংবাদ ও নিখোঁজ যোদ্ধাদের অনুসন্ধান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ২১ হাজার থেকে ২৩ হাজার ৫০০ জন নিহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এভাবে হিসাব করলে মোট নিহত সেনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার ৭০০।

আরও পড়ুনজেলেনস্কির বিদায় চান ট্রাম্প-পুতিন দুজনই, তা কি সম্ভব১১ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
  • দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে বাড়িয়ে দিতে পা
  • আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে দুই দিনের বৈঠকেও ঐকমত্য হয়নি
  • ‘তুমি বেঁচে থাকবে, আমার গল্পটি বলো’
  • ডিবিএইচের ১০১ কোটি টাকা মুনাফা, ১৭% লভ্যাংশ ঘোষণা
  • আইএমএফ ঋণের সুরাহা ছাড়াই শেষ আরেক দফার বৈঠক
  • ইউক্রেনে প্রতি বর্গকিলোমিটার দখল করার দাম দাঁড়াচ্ছে ২৭ রুশ সেনার প্রাণ
  • আইএমএফের ঋণ নিয়ে কী হচ্ছে
  • ডলারের দরে নমনীয়তা দেখায়নি সরকার, আইএমএফের সঙ্গে আজ আবার বৈঠক