মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকা কঠিন—কথাটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। অথচ সেই মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতের অন্যতম মাধ্যম—কাউন্সিলিং সেবায় রয়েছে চরম অবহেলা।

সম্প্রতি জবি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে মানসিক সহায়তা প্রদানকারী একমাত্র কাউন্সিলিং সেন্টারটিও রয়েছে সংকটে। পেশাদার কাউন্সিলরের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সেবা নিয়ে বাড়ছে অসন্তোষ ও উদ্বেগ।

গত ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট নয়জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তারা হলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের সুমাইয়া মেহজাবিন স্বর্ণা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অমিতোষ হালদার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেজবাহ উল আজিম, ব্যবস্থাপনা বিভাগের মেহেবুল্লাহ তৌসি, আইন বিভাগের ফাইরুজ আবন্তিকা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবরিনা রহমান শাম্মী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের হাবিব রিয়াদ, ফিন্যান্স বিভাগের মো.

আহাদ হোসেন এবং সংগীত বিভাগের প্রত্যাশা মজুমদার।

আরো পড়ুন:

২ দাবিতে জবি ছাত্র ফ্রন্টের গণভোট

সেমিনারে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেন জবি শিক্ষার্থী

এসব শিক্ষার্থীদের প্রায় সবারই আত্মহত্যার প্রধান কারণ হতাশা। তাদের এ মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার নানা ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলিং সেন্টার। উদ্দেশ্য ছিল মানসিক চাপ ও হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু বর্তমানে এটি চলছে অস্থায়ী ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। ছোট দুইটি কক্ষে চলছে কার্যক্রম, নেই কোনো পেশাদার মনোরোগ চিকিৎসক বা মানসিক বিশেষজ্ঞ। দায়িত্বে থাকা মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা খণ্ডকালীন এবং সেমিস্টার পরীক্ষার সময় ব্যতীত সেবা দেন। তবে তাদের বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ বা তদারকি নেই। ফলে সেবার মান ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ২৬১ জন শিক্ষার্থী কাউন্সিলিং সেবার জন্য নিবন্ধন করেন। তাদের মধ্যে ১৯৯ জন সেবা গ্রহণ করেছেন, সাতজন নিজেরাই সেবা বাতিল করেন এবং ৫৫ জনের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এই সময়ের মধ্যে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মঘাতী চিন্তায় ভুগেছেন। যাদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক মনে করেন, তরুণদের হতাশা, কর্মসংস্থান সংকট, প্রেম ঘটিত জটিলতা ও পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। কার্যকর কাউন্সিলিং না থাকলে এটি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন মহলের মতে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার। শুধু একজন নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ পেশাদার কাউন্সিলিং টিম গঠন করাই এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, একাডেমিক কাউন্সিলিংয়ের মতো মানসিক কাউন্সিলিংকেও গুরুত্ব দেওয়া হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ ও কাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এখন সময় প্রতিশ্রুতির নয়, কার্যকর উদ্যোগের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, “কাউন্সিলিং মানে একদিনের সেশন নয়। এটি পেশাদার, ধৈর্যশীল ও অভিজ্ঞ হাতে পরিচালিত হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই সেবা চালানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।”

কাউন্সিলিং সেন্টার পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারাজানা আহমেদ বলেন, “আমাদের এখানে একজন অভিজ্ঞ পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা খণ্ডকালীন শিক্ষার্থী। সেমিস্টার চললে সেবায় বিঘ্ন ঘটে। তবুও তারা নিজ উদ্যোগে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হতাশা, সম্পর্কের জটিলতা ও পারিবারিক সমস্যার কারণে সাহায্য নিতে আসে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, “আমরা কাউন্সিলিং সেবার মানোন্নয়নে কাজ করছি। মনোবিজ্ঞান ছাড়াও সমাজকর্ম বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও কার্যকর সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

তবে পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ নিয়ে তিনি বলেন, “এটি সময়সাপেক্ষ। আর আপাতত তা সম্ভবও নয়।”

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর মন ব জ ঞ ন ব ভ গ র ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

গকসু নির্বাচন: জাহিদের প্রচারণায় সবুজের ডাক

৭ বছরের দীর্ঘ নীরবতা শেষে আবারো সরগরম হয়ে উঠেছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) ক্যাম্পাস। ৩২ একরের সবুজ চত্বরে এখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে।

আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনের চতুর্থ কার্যনির্বাহী পরিষদের ভোটগ্রহণ। ইতোমধ্যেই প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন ভোটারদের মন জয় করার প্রচারে। প্রার্থী-সমর্থকদের দৌড়ঝাঁপ, লিফলেট ছড়াচ্ছে, স্লোগান ভেসে আসছে চারদিক থেকে। শিক্ষার্থীরা কেউ সমর্থনে শ্লোগান দিচ্ছে, কেউবা চুপচাপ তাকিয়ে দেখছে প্রার্থীদের কর্মযজ্ঞ।

আরো পড়ুন:

ইবিতে প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু বৈদ্যুতিক শাটলের 

পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে ধরা ঢাবি হল সংসদ নেতাসহ ৬ শিক্ষার্থী

এই কোলাহলের ভিড়েই ব্যতিক্রম মো. জাহিদ হাসান। তিনি সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু প্রচারে তার ভিন্ন সুর, ভিন্ন আয়োজন। অন্যদের মতো কেবল লিফলেট বিলি বা মতবিনিময় নয়; তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ছোট ছোট বীজ। তিনি সবার নজর কেড়েছেন পরিবেশবান্ধব প্রচারণার এই অভিনব কৌশল দিয়ে।

প্রথমে অনেকে অবাক হয়েছেন। লিফলেট খুলতেই ভেতরে জড়িয়ে আছে কচি সবুজ বীজ। সঙ্গে লেখা এক টুকরো বার্তা, “এই লিফলেটে বীজ আছে, দয়া করে ভিজে মাটিতে ফেলবেন। আমি এজিএস হই আর না হই, এই বীজ থেকে অন্তত একটা গাছ হোক। যেটা ছায়া দেবে, অক্সিজেন দেবে, আর বলবে একজন শিক্ষার্থী একদিন স্বপ্ন দেখেছিল পরিবর্তনের।”

কথাগুলো পড়ে চুপ হয়ে গেছেন অনেকেই। সাধারণত হ্যান্ডবিল পড়ে শেষ হলে তা ছুড়ে ফেলা হয় মাটিতে। ময়লায় ভরে যায় ক্যাম্পাস। কিন্তু বীজসংবলিত এই লিফলেট তো আর বর্জ্য নয়, এটা ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনা। এতে শুধু ভোটারদের মনোযোগই আকৃষ্ট হচ্ছে না, ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ সচেতনতার বার্তাও। ফলে তার প্রচারণা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

জাহিদ বলেন, “সাধারণ প্রচারপত্র পড়ার পর তা বর্জ্যে পরিণত হয়। কিন্তু বীজযুক্ত প্রচারপত্র ফেলে না দিয়ে শিক্ষার্থীরা তা রোপণ করতে পারবেন, যা ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ হবে। পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমি চাই, আমার প্রচারণা শুধু ভোটের জন্য না হয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনায় নতুন দিশা আনুক। পরিবর্তনের শুরুটা হোক এক টুকরো সবুজ থেকে।”

তার কথা শোনার পর অনেকে মুগ্ধ হয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, এই তরুণের স্বপ্ন হয়তো সত্যিই একদিন বড় পরিবর্তন ডেকে আনবে। যেখানে অন্যরা স্লোগানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেখানে তিনি দিচ্ছেন এক খণ্ড সবুজের আশ্বাস। অনেকে বলছেন, ‘স্মার্ট ক্যাম্পেইন’।

শুধু বীজ বিলি করেই থেমে থাকেননি জাহিদ। তার মুখে শোনা যায় দৃঢ় উচ্চারণ—“আমি নির্বাচিত হলে ছাত্র সংসদে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে। আর যদি সেটা না পারি, তবে আমি নিজেই পদত্যাগ করব।”

ক্যাম্পাসজুড়ে তার এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের মতো। শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে লিখছেন, “এমন প্রার্থীই জিতে যাক।”

জাহিদের এই প্রচারণা যেন নির্বাচনী উত্তেজনার ভিড়ে একটুকরো নির্মল বাতাস। যেখানে অন্য প্রার্থীরা লিফলেট আর শোডাউনে ব্যস্ত, সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বীজ।

অনেকেই বলছেন, জাহিদ হাসানের উদ্যোগকে অনেকেই ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য এক ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখছেন। কারণ, রাজনৈতিক প্রচারণায় পরিবেশবান্ধব চিন্তার এমন প্রয়োগ দেশে খুব একটা দেখা যায় না। তার এই ছোট উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের মনে এক বড় পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়েছে।

নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। প্রচারের শব্দ আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু এর মাঝেও শিক্ষার্থীরা যখন সেই বীজ হাতে মাটিতে ফেলছেন, তখন যেন ভেতরে ভেতরে বুনছেন আরেক রকম স্বপ্ন।

হয়তো জাহিদ জয়ী হবেন, হয়তো হবেন না। কিন্তু তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়া এই বীজগুলো একদিন অঙ্কুরিত হবে, বেড়ে উঠবে। আর প্রতিটি গাছ সাক্ষী হয়ে থাকবে—একজন শিক্ষার্থী একসময় স্বপ্ন দেখেছিল, পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে একটুখানি সবুজ থেকেই।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুর্দান্ত প্রকৌশলী, প্রাণবন্ত মানুষ
  • ‘আপনাদের কার্যক্রম তো সন্ত্রাসীদের মতো’ সাংবাদিকদের বললেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ভিডিও ভাইরাল
  • ‎ বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় বেরোবির ৩ শিক্ষক-শিক্ষার্থী
  • ব্যাংকিং খাতে আস্থা বাড়াতে নিজের কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগের গল্প বললেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
  • ভারত ম্যাচের আগে দলে মনোবিদ যুক্ত করেছে পাকিস্তান
  • প্রকাশ্য থেকে গুপ্ত: ভেতর থেকে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি
  • ডাকাতি হওয়া ২৩ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৩
  • বেতনের অর্ধেক যদি চলে যায় বাসা ভাড়ার পেছনে...
  • রাজনৈতিক ‘অস্ত্র’ না হয়ে প্রভাবমুক্ত হোক পুলিশ
  • গকসু নির্বাচন: জাহিদের প্রচারণায় সবুজের ডাক