নোয়াখালীতে বিয়ের আসরে এসে ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির অভিযোগ উঠেছে বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল হোসেন জিসানের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে শুক্রবার (১৬) দুপুরে বর ও কনেপক্ষের মধ্যে মারামারিতে কমপক্ষে ৭ জন আহত হয়েছেন। কনেপক্ষ বরকে আটক করে রাখলে সুধারাম থানা পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়েছে। 

শুক্রবার নোয়াখালী জেলা শহরের মেহেরার ডাইন নামের একটি রেস্টুরেন্টে ওই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। 

কনের মামা মো.

হিরণ জানিয়েছেন, প্রায় এক মাস আগে ফেনীর দাগনভূঁইয়া এলাকার বাসিন্দা ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল হোসেন জিসানের সঙ্গে তার ভাগ্নির বিয়ের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। গত শুক্রবার (৯ মে) দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী ১৬ মে বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। বরকে বৃহস্পতিবার প্রায় ১ লাখ টাকার উপহার সামগ্রীও দেওয়া হয়। বরের পরিবারের লোকজন কনের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান করেন।

হিরণ অভিযোগ করেন, শুক্রবার দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে বর জিসান তার বোনের (কনের মা) মোবাইল ফোনে কল করে জানান, তাকে ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে, তা না হলে তিনি বিয়ে করতে আসবেন না। এ কথা শুনে তার বোন ভেঙে পড়েন। তখন তারা অনুরোধ করে জিসানকে বলেন অনুষ্ঠানে আসার জন্য, এলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। দুপুর আড়াইটার দিকে বর জিসান আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে মেহেরান ডাইন রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হন। তখন কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে বরপক্ষের লোকজন কনেপক্ষের লোকদের ওপর হামলা চালান। 

অন্যদিকে, বরের ভগ্নিপতি শাহীন চৌধুরী বলেছেন, কনের পরিবার ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির যে অভিযোগ করছে, তা মিথ্যা। কনের মায়ের একটি আপত্তিকর ছবি ফোনে পেয়ে সেটি নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন বর। এ নিয়ে কনের পরিবার বর ও তার স্বজনদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় বরের মোবাইল ফোনসহ তিনটি ফোন নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।

সুধারাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিয়ে নিয়ে গণ্ডগোলের জের ধরে বরকে আটক করার খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা/সুজন/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ৫০ ল খ ট ক শ ক রব র পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

নারীর ডাকে নারীর সমাবেশ

পৃথিবীর যে কোনো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা অসামান্য। বাংলার ইতিহাস এর বাইরে নয়। চব্বিশের অভূতপূর্ব জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল; যেখানে নারীরা ঢাল হয়ে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের প্রধান শক্তির ভূমিকা পালন করেছেন, শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। নির্মম সত্য হলো– আন্দোলন-সংগ্রামে নারীর মুখ প্রথম সারিতে থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাদের অবদান স্বীকারের ক্ষেত্রে থাকে কাপর্ণ্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থান তারই এক উদাহরণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য এসেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। এর বিপরীতে ন্যায্যতা-সমতার দাবিতে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি নেন সমাজের সচেতন নারীর একাংশ। তাদের আহ্বানে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ১৬ মে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সমবেত হন। 
সংসদ ভবন পেছনে রেখে সুন্দর সাজসজ্জাময় একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। যেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিদ্রোহে ফেটে পড়ে তাদের কথার স্বর, গান-নাটক এবং কথার ধ্বনিতে মুক্তির সুর। তাদের দাবিতে স্পষ্ট হয় ইনকিলাব-আজাদির কথা। সেখানে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশের পাহাড়-সমতলের নারীর প্রতি সমর্থন জানানো হয় এই মঞ্চ থেকে।
এই কর্মসূচিটি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন অনেকেই। যেসব মানুষ হেঁটে যাচ্ছিলেন, তারাও বলছিলেন, ‘দরকার ছিল এমন আয়োজনের ...।’ পুরুষের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। আয়োজকদের মতে, তাদের দাবি তো মানুষের দাবি, পুরুষের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই; বিরোধ পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। অন্য সব কমিশনের মতো এ কমিশনের সুপারিশেও ছিল আলোচনা-সমালোচনার উপাদান। দেখা যায়, এ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজন নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংস মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনার নামে নারীবিদ্বেষী অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। এর বিপরীতে বিভিন্ন ফোরামে নারীরা আলোচনা করেন নিজেদের মধ্যে। যে তরুণ সমাজ গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল; সেই তরুণ সমাজের নারী প্রতিনিধিরাই এই নারী সমাবেশের ডাক দেন। তবে এই কমিশনের প্রতিবেদন মূল বিষয় ছিল না। এখানে শত শত বছর এ অঞ্চলের নারীর দুর্ভোগ, বঞ্চনা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীমুক্তির চেতনাও রয়েছে বিদ্যমান। এটিই এই আয়োজনের মূল বলে উল্লেখ করেছেন আয়োজকরা।
এমন এক জরুরি মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরে অনেকেই আনন্দিত। এমন একজন নারী এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে, শাড়ি পরে হাতে লাঠি নিয়ে মিছিলে হাঁটছিলেন। তিনি তেমন কাউকেই চেনেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে চলে এসেছেন। হাঁটতে হাঁটতে জানা গেল বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই; নারী অধিকারের কথা শুনে চলে এসেছেন।
মঞ্চের প্রথমেই বসেছিলাম। আমার পরনে শার্ট, প্যান্ট, মাথায় ক্যাপ। পাশের নারী সুন্দর জামদানি শাড়ি পরে বসে আছেন, এই ভরদুপুরে। দরদর করে ঘাম ঝরছে, ব্যাগ থেকে গামছা বের করে দিলাম। তিনি নির্ভয়ে মুখ মুছে নিলেন। অন্যদিকে স্লিভলেস ব্লাউজে, টাঙ্গাইলের তাঁত কটনে বসে আছেন এক তরুণী। ঠিক হাতের ডান পাশেই বোরকা, নেকাব পরা এক নারী, কোলে শিশু। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের মা-বোনও এসেছেন– অদ্ভুত সুন্দর এক মেলবন্ধন। মঞ্চে তখন নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌন হয়রানি নিয়ে দুই নারী বলছিলেন। ছোটবেলায় বাবার বন্ধুর মাধ্যমে যৌন হয়রানির কথা যখন তিনি বলছিলেন; তখন অনেক নারীর চোখে জল। সানগ্লাস দিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। কারণ এ তো সব নারীরই গল্প!
এ আয়োজনে নারীরাই সব করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন নারীরা, ভলান্টিয়ারও তারাই ছিলেন। এখানে কোনো সংগঠন বা দলীয় ব্যানার আনার ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। যেটি এ আয়োজনকে আরও সুন্দর-সাবলীল করে তুলেছে। 
এ নারী সমাবেশের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, এ আয়োজনে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বজন, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের শ্রমিক, যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী, হিজড়া, লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যময় ও অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ, তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, আদিবাসী, অবাঙালি এবং আরও অনেকে– যারাই এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি, তাদের অধিকার আদায় না হলে মানবিক, সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, বৈচিত্র্যময়তা ও সহনশীলতার বাংলাদেশ হবে না। এ আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়ে তাদের এ আয়োজন। 
আমরা দেখেছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ কমেনি। যে নারীরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তারা আজ অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এগুলো সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্র। এই চিত্রপট সামনে রেখে, নারীবান্ধব সমাজ তৈরি করতে নারীরা মতভিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন এই মৈত্রী যাত্রায়।
এ দেশে কৃষি, মৎস্যজীবী ও গৃহকর্ম পেশায় নারীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই কিন্তু আমরা জানি কৃষিকাজে নারীর অবদান অতুলনীয়। নারী যদি কৃষিকাজে প্রধান ভূমিকা না রাখতেন, তাহলে এ খাতে ধস নেমে যেত। এ ছাড়া নারী-পুরুষ একই কাজে অংশগ্রহণ করে নারীরা কম মজুরি পান। দলিত, হরিজন ও আদিবাসী নারীরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার হন। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ নারী আজও ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত। এশিয়ায় বাল্যবিয়ের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ; প্রতিনিয়ত নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। অহরহই প্রবাসী নারীশ্রমিক দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে। এসব কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীর এমন দলবদ্ধ লড়াই অনস্বীকার্য। 
‘মৈত্রী যাত্রা’র ঘোষণাপত্রে বলা হয়– নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু, হিজড়া ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিচয়ের নাগরিকের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো শর্তাধীন নয়, হতে পারে না। এ মৌলিক বিষয়গুলো হুমকির মুখে রাখলে তা হবে অর্ধশতকের নারী আন্দোলন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও ইনসাফের ধারণার পরিপন্থি। মৈত্রী যাত্রার দাবি– অধিকার ও ধর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা তৈরি করতে না দেওয়ার জন্য এ আয়োজন। এর মধ্য দিয়ে জানান দেওয়া হয়, সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীবিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখা হবে। যে ক্ষমতা কাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামোকে ভাঙার ডাক দিয়েছেন নারীরা।
সমাবেশ শেষে তখন রাত হয়ে গেছে। সংসদ ভবন এলাকায় মেলা যেন ভাঙছে না। সবার ভেতর উৎসব উৎসব আমেজ। চা-কফি, ফুচকা-চটপটির আয়োজন চারপাশে। লম্বা মিছিলে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ঠান্ডা পানিতে গলা ভেজাচ্ছেন অনেকে। কোনো কোনো পুরুষ আয়োজকদের ডেকে এমন আয়োজনের জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। জানা গেল, এক পুরুষ অংশগ্রহণকারী এসেছেন রাজশাহী থেকে, শুধু এ আয়োজনের জন্য। এমন আরও নানা লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষ এক মিছিলে হেঁটেছেন, যেমনটা আমরা দেখেছি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময়। এ কর্মসূচির দাবিও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মতোই– একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের, যেখানে সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের যৌথ মূল্যবোধের ওপর। সমতা ও ন্যায্যতার পথে হাঁটবে আগামীর বাংলাদেশ। v

সম্পর্কিত নিবন্ধ