নারীর সমতার পক্ষে সৃজনশীল কনটেন্ট নির্মাণ জরুরি
Published: 23rd, June 2025 GMT
বাস্তব ও ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রচারিত অনেক বিষয়ই নারীর সমতা ও মানবাধিকারের পক্ষে যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নারীর পক্ষে সৃজনশীল কনটেন্ট বা আধেয় নির্মাণ করা এখন জরুরি। আজ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আনোয়ারা বেগমÑমুনিরা খান মিলনায়তনে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: নারীর মানবাধিকার আন্দোলন’ শিরোনামে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সন্দীপ কুমার মিস্ত্রী এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কনটেন্ট রাইটার ফারজানা আফরোজ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সংগঠনের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
কর্মশালায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার পাচ্ছে কি না, তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। লিঙ্গগত পরিচয়ের কারণে সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য ঘটে চলেছে। নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বাড়ছে। গণমাধ্যম, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী বিষয়ে কাজ হলেও নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর অধিকারের বিষয়টি কনটেন্টের মাধ্যমে বেশি প্রচারিত হলে তা সবার কাছে গুরুত্ব পাবে।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাস্তব জগৎ ও ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রকাশ ও প্রচার হওয়া অনেক বিষয়ই নারীর মানবাধিকার, সমতা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য বিলোপের পক্ষে নেই। এই পরিস্থিতিতে নারীর মানবাধিকার ও সমতার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নারী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে সৃজনশীল কনটেন্ট নির্মাণ জরুরি।
কর্মশালায় বক্তব্য দেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। তিনি বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে কাঠামোবদ্ধভাবে সাংগঠনিক কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমে নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের তথ্যপ্রযুক্তি উপপরিষদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প যেভাবে যুদ্ধবাজদের জন্য পথ খুলে দিলেন
মনে হচ্ছে যেন এই তো গতকালও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের অবৈধ ইরান-আক্রমণে সরাসরি যোগ দিয়েছে। শনিবার তারা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ট্রাম্প এই হামলাকে ‘খুব সফল একটি আক্রমণ’ বলে দম্ভোক্তিভরা দাবি করেছেন।
সিএনএন এ ঘটনাকে নাটকীয়ভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছে: ‘এটি ২০২৫ সালের জুন মাসের একটি অবিস্মরণীয় গ্রীষ্মকালীন রাত। এটিকে হয়তো একদিন এমন এক মুহূর্ত হিসেবে মনে রাখা হবে, যখন মধ্যপ্রাচ্য চিরতরে বদলে গেল, যখন ইসরায়েলের ওপর পারমাণবিক ধ্বংসের ভয় দূর হলো, যখন ইরানের শক্তি ধ্বংস হলো, আর আমেরিকার শক্তি আরও বেড়ে গেল।’
আরও পড়ুনইরানে আক্রমণ করে ট্রাম্প বড় জুয়া খেললেন১০ ঘণ্টা আগেতবে বাস্তবতা হলো ইরানের ওপর এসব আক্রমণের পেছনে ‘পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়’ আসলে কোনো কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে বারবার বলা হচ্ছে, এই হামলা কেবল ইরানের সেনাবাহিনী ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হলো, এতে শত শত সাধারণ মানুষ মারা গেছে।
যাঁরা ইসরায়েলের এসব আগ্রাসনকে সমর্থন করার ‘চাকরি’ করেন না, তাঁদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার। তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারছেন, ইরানের ওপর এই হামলা কেবল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য একটি সুবিধাজনক যুদ্ধ, যার মাধ্যমে তিনি একসঙ্গে অনেকগুলো উদ্দেশ্য পূরণ করছেন। বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করে যে অভিযান হয়েছে, তা আসলে অনেক গভীর রাজনৈতিক লাভের হিসাব করে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা খাবার বা সাহায্য নিতে গিয়ে প্রতিদিনই হত্যার শিকার হচ্ছেন। এই বাস্তবতা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার একটি কৌশলও এই ইরান-আক্রমণ। একই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজ দেশে যে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে আছেন, সেখান থেকেও তিনি জনগণের দৃষ্টি সরাতে পেরেছেন।
আরও পড়ুনইরানে হামলার পর এখন ট্রাম্পের সামনে যে তিন অনিশ্চয়তা২২ জুন ২০২৫এমনিতেও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইসরায়েলিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ধারণা। তাই দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার মুখে থাকা একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুর জন্য এটি বড় রকমের রাজনৈতিক লাভ এনে দিচ্ছে।
শুরুতে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলেছিলেন। এতে নেতানিয়াহু প্রবল বিরক্ত হয়েছিলেন। তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। কারণ, আমেরিকার বোমা হামলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষায়, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো একেবারে ‘ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’।
আসলে ইরান দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে। অনেক মার্কিন নীতিনির্ধারক বহু আগে থেকেই ইরানে বোমা ফেলার সুযোগ খুঁজে আসছেন। কারও কারও মুখে তা বিভিন্ন সময় খুব খোলাখুলিভাবে উঠে এসেছে।
যেমন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের একসময়কার রাষ্ট্রদূত এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সাময়িক সময়ের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে থাকা জন বোল্টন ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি মতামত কলামে লিখেছিলেন: ‘ইরানের বোমা থামাতে হলে, ইরানেই বোমা ফেলতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র যখন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের পক্ষে এমন একটি প্রকাশ্য আহ্বান ছাপায়, তখন তা স্পষ্ট করে দেয়, ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রে ও তাদের গণমাধ্যমে কতটা ভয়ংকর ও শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ এরভান্দ আব্রাহামিয়ান তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অব মডার্ন আর্ট’ বইয়ে লিখেছেন: ‘অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মজা করে বলত, উঠতি যুবকেরা যেভাবে প্লেবয় ম্যাগাজিন পড়ে, তেমনভাবে শাহ অস্ত্রের ম্যানুয়াল পড়তেন।’ এই শাহ ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা করেছিলেন, যা কিনা ট্রাম্প এখন বোমা মেরে ধ্বংস করছেন।মনে রাখতে হবে, ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরানকে ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’ বা ‘অশুভ শক্তির অক্ষ’ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ইরানকে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একই কাতারে নামিয়েছিলেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে থাকে, তারপরও তার কর্মকাণ্ড বহু ক্ষেত্রে তাকে তথাকথিত ‘অশুভ শক্তি’ হিসেবে দেখা কিছু দেশের তুলনায় অনেকটাই কম ভয়াবহ। বর্তমানে ইরান এমন একটি গণহত্যার জন্য দায়ী নয়, যেটিতে যুক্তরাষ্ট্র ১০-২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রত্যক্ষভাবে অর্থায়ন করছে।
আর ইরান তো সেই দেশ নয়, যে কয়েক দশক ধরে (লাতিন আমেরিকায় ডানপন্থী সন্ত্রাসী শাসনকে সমর্থন করা থেকে শুরু করে ভিয়েতনামে গণহত্যা চালানো পর্যন্ত) বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে বোমা বর্ষণ করে মানুষ হত্যা করছে।
তার চেয়েও বড় কথা, মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র গোপন পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ ইরান নয়, বরং ইসরায়েল। ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (এনপিটি) সই করেনি এবং কখনোই জাতিসংঘকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে নজরদারির অনুমতি দেয়নি।
আরও পড়ুনইরানের সঙ্গে যুদ্ধে নেতানিয়াহুকে চড়া মূল্য দিতে হবে ১৬ ঘণ্টা আগেঅনেকে বলেন, ইরান সরকার ‘দমনমূলক’ বলে তাদের ওপর হামলা চালানোটা ন্যায্য। কিন্তু তারা যদি সত্যিই দমননীতি নিয়ে চিন্তিত হন, তাহলে তাদের একবার যুক্তরাষ্ট্র ইরানে কীভাবে দমননীতি জোরদার করেছে, তা ভেবে দেখা উচিত। যেমন ১৯৫৩ সালে সিআইএ ইরানের জনপ্রিয় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটায়, যার ফলে একনায়ক শাহ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এই শাহই ছিলেন সেই নেতা, যিনি মার্কিন অস্ত্রের ওপর ভর করে এক ভীতিকর ও নির্যাতননির্ভর রাজত্ব চালিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ এরভান্দ আব্রাহামিয়ান তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অব মডার্ন আর্ট’ বইয়ে লিখেছেন: ‘অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মজা করে বলত, উঠতি যুবকেরা যেভাবে প্লেবয় ম্যাগাজিন পড়ে, তেমনভাবে শাহ অস্ত্রের ম্যানুয়াল পড়তেন।’ এই শাহ ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা করেছিলেন, যা কিনা ট্রাম্প এখন বোমা মেরে ধ্বংস করছেন।
এখন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হয়তো ২০২৫ সালের এই গ্রীষ্মের রাতের হামলা নিয়ে খুব একটা আপত্তি নেই। বরং এই হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকট আরও গভীর হয়েছে, তা তাদের জন্য ব্যবসার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম এই অবৈধ হামলার পক্ষে এখন যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যস্ত আছে। অথচ বাস্তবতা হলো, নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করে রাখা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যখন অন্যদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে হুমকি হিসেবে দেখে এবং তাদের ওপর ‘পুলিশিং’ করে, তখন এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আর কিছু হতে পারে না।
ট্রাম্প কী করবেন, তা বলা কঠিন—কারণ, তিনি নিজেকে অপ্রত্যাশিত ও উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়া নেতা হিসেবেই পরিচিত করে তুলেছেন। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যুদ্ধ যতই চলুক, অস্ত্রশিল্পের খিদে কখনোই মিটবে না।
বেলন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ