শেখ হাসিনা কি তাহলে পুলিশের ওপরই সব দায় চাপিয়ে দিলেন
Published: 6th, November 2025 GMT
ইতিহাসের কিছু মুহূর্ত আসে যখন নীরবতা ভেঙে যায় এবং ক্ষমতা তার নিজের তৈরি করা আয়নার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ক্ষমতাচ্যুত, পলাতক এবং নিজ দেশের শত শত মানুষকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত একজন নেতা যখন নির্বাসন থেকে কথা বলেন, তখন প্রতিটি শব্দ কেবল আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা থাকে না, তা হয়ে ওঠে ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব, দায়বদ্ধতার সংকট এবং ইতিহাসের সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ের দলিল।
সম্প্রতি ভারতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের তিনটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম—রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে প্রায় একই সুরে, একই ভাষায় ই-মেইলের মাধ্যমে যে সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েছেন, তা সম্ভবত এই ঐতিহাসিক সত্যকেই উন্মোচিত করে।
এই সাক্ষাৎকারগুলোর ছত্রে ছত্রে তিনি জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছেন এবং সেই দায়টি সযত্নে চাপিয়ে দিয়েছেন তারই দেড় দশকের ক্ষমতার প্রধান খুঁটি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত পুলিশের কাঁধে।
আরও পড়ুন১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণে ডুবিয়ে হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের গল্প বানাতেন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে তিনি বলেছেন, ‘মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যাঁদের সুপ্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক নির্দেশিকা মেনে চলার কথা ছিল। এসব নির্দেশিকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া ছিল। এমনটা হতে পারে যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যেগুলো ভুল ছিল।’
এএফপিকে আরও নির্দিষ্টভাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
এ বক্তব্যগুলো ক্ষমতার এক চিরচেনা কিন্তু ভয়ংকর প্রতিধ্বনির পুনরাবৃত্তি, যেখানে শীর্ষ নেতৃত্ব দায়বদ্ধতার শিখর থেকে নেমে এসে মাঠপর্যায়ের ‘অনিয়ম’ বা ‘ভুলের’ পেছনে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু জুলাইয়ের রক্তাক্ত রাজপথের তথ্য-প্রমাণ, ফাঁস হওয়া অডিও ও আন্তর্জাতিক তদন্তের অকাট্য দলিলগুলো কি এই অস্বীকারের রাজনীতিকে সমর্থন করে? নাকি এটি ইতিহাসের সেই সব স্বৈরশাসকের ছায়া, যাঁরা নিজেদের হাত থেকে রক্ত মুছে ফেলতে জল্লাদের পোশাককেই দোষারোপ করে?
কৌশলী সাক্ষাৎকার, নাকি নিয়ন্ত্রিত প্রচারণা?এই অস্বীকারের বয়ানটি জনসমক্ষে আসার প্রক্রিয়াটি নিজেই গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। কীভাবে তিনজন ভিন্ন সাংবাদিক, তিনটি ভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য ই-মেইলের মাধ্যমে নেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রায় হুবহু একই রকম প্রশ্ন করলেন এবং প্রায় অভিন্ন উত্তর পেলেন? সাংবাদিক, ফ্যাক্ট চেকার ও পর্যবেক্ষকেরা এই অস্বাভাবিক মিলের দিকে ইঙ্গিত করে যথার্থই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
অনেকের মতে, এই সব সাক্ষাৎকার কোনো পেশাদার জনসংযোগ সংস্থার মাধ্যমে সাজানো একটি মিডিয়া প্যাকেজ, যার উদ্দেশ্য ছিল একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, কঠিন প্রশ্ন এড়িয়ে, নিজের মতো করে একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা।
সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, তিনটি গণমাধ্যমই তাদের প্রতিবেদনকে ‘পতনের পর হাসিনার প্রথম ইন্টারভিউ’ বলে দাবি করেছে। যা প্রমাণ করে, প্রক্রিয়াটি কতটা সুচতুরভাবে সাজানো হয়েছিল, যেখানে প্রতিটি মিডিয়াকে ‘এক্সক্লুসিভ’ বা ‘একান্ত’ সাক্ষাৎকারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ই-মেইলের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তরের এই পদ্ধতি একজন অভিযুক্তকে সেই সুযোগ করে দেয়, যেখানে তিনি প্রতিটি শব্দ মেপে, আইনজীবীর পরামর্শে, নিজের দায় এড়িয়ে একটি নিখুঁত চিত্রনাট্য তৈরি করতে পারেন। ফলে বলতে হয়, এটি সাংবাদিকতা নয় প্রচারণা।
আরও পড়ুননুরেমবার্গ থেকে ঢাকা: স্বীকারোক্তির আয়নায় স্বৈরাচার২৩ আগস্ট ২০২৫অস্বীকারের বিপরীতে প্রমাণের হিমশৈলশেখ হাসিনার এই নিখুঁতভাবে সাজানো ‘ডিনায়াল ন্যারেটিভ’ বা অস্বীকারের বয়ানটি একটি বিশাল হিমশৈলের চূড়ামাত্র, যার নিচে ডুবে আছে প্রমাণের এক অখণ্ড পর্বত।
আমরা সবাই জানি জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের সেই কালো দিনগুলোয় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশই ছিল শিশু।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১৩৩ শিশু–কিশোর শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশু–কিশোররাও রয়েছে। এই শিশু–কিশোরদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ১১৭ জন।
এই হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দেশজুড়ে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সমন্বিত ও পদ্ধতিগত অভিযান, যাকে জাতিসংঘ সুস্পষ্টভাবে ‘ব্যাপক ও পদ্ধতিগত’ নিপীড়ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫প্রশ্ন হলো, কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নির্দেশ বা নীতিগত সবুজ সংকেত ছাড়া দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক শাখা একই সময়ে, একই পন্থায় এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন চালাতে পারে কি? এটি কি নিছকই কিছু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তার ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ ছিল, নাকি একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় নীতির বাস্তবায়ন?
ব্যক্তিগত নির্দেশের অভিযোগকে যখন শেখ হাসিনা ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তখন তাঁর নিজের কণ্ঠস্বরই তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিসির অনুসন্ধানী দল ‘বিবিসি আই’ ২০২৫ সালের ৯ জুলাই প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে একটি অডিও রেকর্ডিংকে সামনে নিয়ে আসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ধারণ করা ওই অডিওতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আগেও নির্দেশ দিয়েছি, এখন সরাসরি নির্দেশ দিয়েছি; এখন তারা লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানেই পাবে (আন্দোলনকারীদের), সেখানেই সরাসরি গুলি করবে।’
শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলে পুলিশকে একটি অনুগত বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন, যারা আইনের শাসন নয়, শাসকের ইচ্ছাকেই ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। এখন সেই আনুগত্যের ফসল যখন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তখন তিনি সেই দায় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি সেই সব হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, যাদের তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আজ নিজেই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন।ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) দ্বারা রেকর্ড করা এই অডিওর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) এটি শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো কর্তৃক এই অডিও ফাইলের ফরেনসিক যাচাই (বিশেষত ইএনএফ অ্যানালাইসিস) এই অডিওকে নিছক অভিযোগের স্তর থেকে একটি আন্তর্জাতিক ‘প্রামাণ্য স্বীকারোক্তি’র স্তরে উন্নীত করেছে।
এখন এমন প্রমাণ দেখা যাচ্ছে যে এই অডিও ফাঁসের ঠিক পরেই ঢাকার রাজপথে সামরিক-গ্রেডের রাইফেল, যেমন টাইপ-৫৬ অ্যাসল্ট রাইফেল মোতায়েন করা হয়, যা পুলিশের নথিতেই লিপিবদ্ধ আছে। এটি কি ‘মাঠপর্যায়ের ভুল’ ছিল, নাকি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অলিখিত স্বীকারোক্তি, যা এক অসতর্ক মুহূর্তে ইতিহাসের জন্য রেকর্ড হয়ে গেছে?
আবার তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) রাজসাক্ষী হিসেবে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তো শেখ হাসিনার অপরাধ অস্বীকৃতির সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আইজিপি তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাঁকে অবহিত করেন যে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিথাল ওয়েপন ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন।’
এই সাক্ষ্যটি ফাঁস হওয়া অডিওর নির্দেশ এবং রাজপথে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি জীবন্ত সেতু তৈরি করে। এটি প্রমাণ করে, পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে বা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়নি; তাদের কাছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল এবং সেই নির্দেশ পালনের জন্য একটি সুসংগঠিত কাঠামো কার্যকর ছিল।
যে যন্ত্র ছিল ক্ষমতার রক্ষাকবচ, সে-ই আজ বলির পাঁঠাশেখ হাসিনার এই দায় চাপানোর কৌশলটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটি কেবল একটি আইনি প্রতিরক্ষা কৌশল থাকে না, হয়ে ওঠে ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক জটিল পাঠ। দেড় দশক ধরে যে পুলিশ ও র্যাবকে শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতার প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আজ পতনের পর তাদেরই ‘ভিলেন’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর শাসনামলে র্যাবের বিরুদ্ধে ছয় শতাধিক মানুষকে গুম করার অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল একটি অলিখিত রাষ্ট্রীয় নীতি।
এই ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়েই ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও এর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সেদিন এই বাহিনীগুলোর কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর সরকারের নীতি এবং তাঁরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদনপুষ্ট। আজ সেই একই বাহিনী যখন গণমানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে, তখন সেই দায়কে ‘কিছু ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কি দ্বিচারিতা নয়?
এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী লর্ড ডেভিড ওয়েন বর্ণিত ‘হুব্রিস সিন্ড্রোম’-এর সঙ্গে মেলানো যায়। দীর্ঘ সময় ধরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় থাকার ফলে শাসক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং নিজেকে রাষ্ট্রের সমার্থক ভাবতে শুরু করেন। তাঁর কাছে নিজের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত এবং যেকোনো ব্যর্থতার দায় অন্যের।
শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলে পুলিশকে একটি অনুগত বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন, যারা আইনের শাসন নয়, শাসকের ইচ্ছাকেই ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। এখন সেই আনুগত্যের ফসল যখন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তখন তিনি সেই দায় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি সেই সব হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, যাদের তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আজ নিজেই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন।
নির্বাসন থেকে কি নতুন রাজনৈতিক কৌশল করা হচ্ছেএই সাক্ষাৎকারগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এগুলো কেবল অতীতকে অস্বীকার করার প্রচেষ্টা নয়, এটি নির্বাসন থেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের এক নতুন রণকৌশলের অংশ। যখন শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর দল অংশ নিতে না পারলে আগামী নির্বাচন বয়কট করা হবে, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি নিজেকে একজন পরাজিত ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হতে দিতে রাজি নন; বরং হাসিনা তাঁর অনুগত কর্মী-সমর্থকদের কাছে বার্তা পাঠাতে চাইছেন, তাঁর লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিজের বয়ান প্রতিষ্ঠা করে তিনি দেশের অভ্যন্তরে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে নিজের প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হলো শেখ হাসিনার শব্দচয়ন। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট যখন তাঁকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না প্রশ্ন করে, তার উত্তর ছিল এক ক্যালকুলেটেড রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট: ‘আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।’
শব্দচয়নের এই রাজনীতিকে বুঝতে হবে। ‘শোক’ একটি নিষ্ক্রিয় ও দূরবর্তী আবেগ, যা যেকোনো নাগরিকই প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু ‘ক্ষমা’ একটি সক্রিয় স্বীকারোক্তি, যা নিজের কৃতকর্মের দায় কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রতীক। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো, যা ঘটেছে তার জন্য নিজেকে নৈতিকভাবে দায়ী বলে স্বীকার করা। শেখ হাসিনা সযত্নে সেই দায় এড়িয়ে গেছেন। এটি প্রমাণ করে, ক্ষমতা হারানোর পরও তাঁর মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আরও পড়ুনএকটি শরীর, একটি বুলেট এবং এক স্বৈরাচারের পতন০২ আগস্ট ২০২৫ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও দায়বদ্ধতার আয়নাএই অস্বীকার ও দায় চাপানোর রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জেনারেলরা গণহত্যার দায় অস্বীকার করে একে ‘মাঠপর্যায়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাৎসি কমান্ডাররা ‘ওপরে হুকুম ছিল’ তত্ত্ব দিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চেয়েছিলেন।
সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, শেখ হাসিনা সরকার দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ‘অধিনায়কত্বের দায়’ বা ‘কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি’-র নীতির ভিত্তিতেই দণ্ডিত করা হয়েছিল। সেদিন ট্রাইব্যুনালের যুক্তি ছিল, শীর্ষ নেতারা সরাসরি গুলি না চালালেও তাঁদের নির্দেশ, নীতি ও নীরবতাই অধস্তনদের অপরাধ করতে উৎসাহিত করেছে। আজ ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, সেই একই ‘অধিনায়কত্বের দায়’-এর নীতি তাঁর বিরুদ্ধেই অকাট্যভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে।
আইসিটির প্রধান অভিযোগকারী আদালতে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ছিলেন এই অপরাধের প্রাণভোমরা অর্থাৎ নিউক্লিয়াস; তাঁর নির্দেশ ছাড়া এমন সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড সম্ভব নয়।’
শেষ পর্যন্ত, শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলো তাঁর রাজনৈতিক দেউলিয়া অবস্থাকেই প্রকাশ করল। যে গণ-অভ্যুত্থান ছিল দেড় দশকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ, তাকে তিনি ‘সহিংস বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তা দমন করাকে তাঁর ‘সাংবিধানিক অধিকার’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে, সত্যের শক্তিই সর্বাধিক। আবু সাঈদের নিরস্ত্র বুক পেতে দেওয়া থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরায় পুলিশের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিকেই আঙুল তোলে।
যে পুলিশ বাহিনীকে শেখ হাসিনা দেড় দশক ধরে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন, আজ সেই বাহিনীর কাঁধে দোষ চাপিয়ে তিনি ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি পাবেন না। কারণ, ২০২৪-এর রক্তপাতের দায় কেবল পুলিশের ট্রিগার-ফিঙ্গারে নয়; বরং সেই আঙুলকে নড়াতে যে নীতিগত নির্দেশ চক্র কাজ করেছে তার কাছেই শেষ পর্যন্ত গিয়েই থামে।
আরিফ রহমান গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ঠপর য য় র ব যবহ র কর হত য ক ণ ড স ব ক র কর র র জন ত এই স ক ষ র জন ত ক ক ষমত র দ ড় দশক ন র এই র শ সন রক ষ ক কর ছ ন হয় ছ ল কর ছ ল তত ত ব র জন য ত কর ছ ল একট সবচ য় র ওপর করছ ন আগস ট অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনা কি তাহলে পুলিশের ওপরই সব দায় চাপিয়ে দিলেন
ইতিহাসের কিছু মুহূর্ত আসে যখন নীরবতা ভেঙে যায় এবং ক্ষমতা তার নিজের তৈরি করা আয়নার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ক্ষমতাচ্যুত, পলাতক এবং নিজ দেশের শত শত মানুষকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত একজন নেতা যখন নির্বাসন থেকে কথা বলেন, তখন প্রতিটি শব্দ কেবল আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা থাকে না, তা হয়ে ওঠে ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব, দায়বদ্ধতার সংকট এবং ইতিহাসের সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ের দলিল।
সম্প্রতি ভারতে বসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের তিনটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম—রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে প্রায় একই সুরে, একই ভাষায় ই-মেইলের মাধ্যমে যে সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েছেন, তা সম্ভবত এই ঐতিহাসিক সত্যকেই উন্মোচিত করে।
এই সাক্ষাৎকারগুলোর ছত্রে ছত্রে তিনি জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছেন এবং সেই দায়টি সযত্নে চাপিয়ে দিয়েছেন তারই দেড় দশকের ক্ষমতার প্রধান খুঁটি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত পুলিশের কাঁধে।
আরও পড়ুন১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণে ডুবিয়ে হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের গল্প বানাতেন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে তিনি বলেছেন, ‘মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যাঁদের সুপ্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক নির্দেশিকা মেনে চলার কথা ছিল। এসব নির্দেশিকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া ছিল। এমনটা হতে পারে যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যেগুলো ভুল ছিল।’
এএফপিকে আরও নির্দিষ্টভাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
এ বক্তব্যগুলো ক্ষমতার এক চিরচেনা কিন্তু ভয়ংকর প্রতিধ্বনির পুনরাবৃত্তি, যেখানে শীর্ষ নেতৃত্ব দায়বদ্ধতার শিখর থেকে নেমে এসে মাঠপর্যায়ের ‘অনিয়ম’ বা ‘ভুলের’ পেছনে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু জুলাইয়ের রক্তাক্ত রাজপথের তথ্য-প্রমাণ, ফাঁস হওয়া অডিও ও আন্তর্জাতিক তদন্তের অকাট্য দলিলগুলো কি এই অস্বীকারের রাজনীতিকে সমর্থন করে? নাকি এটি ইতিহাসের সেই সব স্বৈরশাসকের ছায়া, যাঁরা নিজেদের হাত থেকে রক্ত মুছে ফেলতে জল্লাদের পোশাককেই দোষারোপ করে?
কৌশলী সাক্ষাৎকার, নাকি নিয়ন্ত্রিত প্রচারণা?এই অস্বীকারের বয়ানটি জনসমক্ষে আসার প্রক্রিয়াটি নিজেই গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। কীভাবে তিনজন ভিন্ন সাংবাদিক, তিনটি ভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য ই-মেইলের মাধ্যমে নেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রায় হুবহু একই রকম প্রশ্ন করলেন এবং প্রায় অভিন্ন উত্তর পেলেন? সাংবাদিক, ফ্যাক্ট চেকার ও পর্যবেক্ষকেরা এই অস্বাভাবিক মিলের দিকে ইঙ্গিত করে যথার্থই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
অনেকের মতে, এই সব সাক্ষাৎকার কোনো পেশাদার জনসংযোগ সংস্থার মাধ্যমে সাজানো একটি মিডিয়া প্যাকেজ, যার উদ্দেশ্য ছিল একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, কঠিন প্রশ্ন এড়িয়ে, নিজের মতো করে একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা।
সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, তিনটি গণমাধ্যমই তাদের প্রতিবেদনকে ‘পতনের পর হাসিনার প্রথম ইন্টারভিউ’ বলে দাবি করেছে। যা প্রমাণ করে, প্রক্রিয়াটি কতটা সুচতুরভাবে সাজানো হয়েছিল, যেখানে প্রতিটি মিডিয়াকে ‘এক্সক্লুসিভ’ বা ‘একান্ত’ সাক্ষাৎকারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ই-মেইলের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তরের এই পদ্ধতি একজন অভিযুক্তকে সেই সুযোগ করে দেয়, যেখানে তিনি প্রতিটি শব্দ মেপে, আইনজীবীর পরামর্শে, নিজের দায় এড়িয়ে একটি নিখুঁত চিত্রনাট্য তৈরি করতে পারেন। ফলে বলতে হয়, এটি সাংবাদিকতা নয় প্রচারণা।
আরও পড়ুননুরেমবার্গ থেকে ঢাকা: স্বীকারোক্তির আয়নায় স্বৈরাচার২৩ আগস্ট ২০২৫অস্বীকারের বিপরীতে প্রমাণের হিমশৈলশেখ হাসিনার এই নিখুঁতভাবে সাজানো ‘ডিনায়াল ন্যারেটিভ’ বা অস্বীকারের বয়ানটি একটি বিশাল হিমশৈলের চূড়ামাত্র, যার নিচে ডুবে আছে প্রমাণের এক অখণ্ড পর্বত।
আমরা সবাই জানি জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের সেই কালো দিনগুলোয় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশই ছিল শিশু।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১৩৩ শিশু–কিশোর শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশু–কিশোররাও রয়েছে। এই শিশু–কিশোরদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ১১৭ জন।
এই হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দেশজুড়ে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সমন্বিত ও পদ্ধতিগত অভিযান, যাকে জাতিসংঘ সুস্পষ্টভাবে ‘ব্যাপক ও পদ্ধতিগত’ নিপীড়ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫প্রশ্ন হলো, কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নির্দেশ বা নীতিগত সবুজ সংকেত ছাড়া দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক শাখা একই সময়ে, একই পন্থায় এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন চালাতে পারে কি? এটি কি নিছকই কিছু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তার ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ ছিল, নাকি একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় নীতির বাস্তবায়ন?
ব্যক্তিগত নির্দেশের অভিযোগকে যখন শেখ হাসিনা ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তখন তাঁর নিজের কণ্ঠস্বরই তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিসির অনুসন্ধানী দল ‘বিবিসি আই’ ২০২৫ সালের ৯ জুলাই প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে একটি অডিও রেকর্ডিংকে সামনে নিয়ে আসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ধারণ করা ওই অডিওতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আগেও নির্দেশ দিয়েছি, এখন সরাসরি নির্দেশ দিয়েছি; এখন তারা লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানেই পাবে (আন্দোলনকারীদের), সেখানেই সরাসরি গুলি করবে।’
শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলে পুলিশকে একটি অনুগত বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন, যারা আইনের শাসন নয়, শাসকের ইচ্ছাকেই ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। এখন সেই আনুগত্যের ফসল যখন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তখন তিনি সেই দায় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি সেই সব হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, যাদের তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আজ নিজেই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন।ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) দ্বারা রেকর্ড করা এই অডিওর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) এটি শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো কর্তৃক এই অডিও ফাইলের ফরেনসিক যাচাই (বিশেষত ইএনএফ অ্যানালাইসিস) এই অডিওকে নিছক অভিযোগের স্তর থেকে একটি আন্তর্জাতিক ‘প্রামাণ্য স্বীকারোক্তি’র স্তরে উন্নীত করেছে।
এখন এমন প্রমাণ দেখা যাচ্ছে যে এই অডিও ফাঁসের ঠিক পরেই ঢাকার রাজপথে সামরিক-গ্রেডের রাইফেল, যেমন টাইপ-৫৬ অ্যাসল্ট রাইফেল মোতায়েন করা হয়, যা পুলিশের নথিতেই লিপিবদ্ধ আছে। এটি কি ‘মাঠপর্যায়ের ভুল’ ছিল, নাকি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অলিখিত স্বীকারোক্তি, যা এক অসতর্ক মুহূর্তে ইতিহাসের জন্য রেকর্ড হয়ে গেছে?
আবার তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) রাজসাক্ষী হিসেবে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তো শেখ হাসিনার অপরাধ অস্বীকৃতির সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আইজিপি তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাঁকে অবহিত করেন যে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিথাল ওয়েপন ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন।’
এই সাক্ষ্যটি ফাঁস হওয়া অডিওর নির্দেশ এবং রাজপথে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি জীবন্ত সেতু তৈরি করে। এটি প্রমাণ করে, পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে বা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়নি; তাদের কাছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল এবং সেই নির্দেশ পালনের জন্য একটি সুসংগঠিত কাঠামো কার্যকর ছিল।
যে যন্ত্র ছিল ক্ষমতার রক্ষাকবচ, সে-ই আজ বলির পাঁঠাশেখ হাসিনার এই দায় চাপানোর কৌশলটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটি কেবল একটি আইনি প্রতিরক্ষা কৌশল থাকে না, হয়ে ওঠে ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক জটিল পাঠ। দেড় দশক ধরে যে পুলিশ ও র্যাবকে শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতার প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আজ পতনের পর তাদেরই ‘ভিলেন’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর শাসনামলে র্যাবের বিরুদ্ধে ছয় শতাধিক মানুষকে গুম করার অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল একটি অলিখিত রাষ্ট্রীয় নীতি।
এই ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়েই ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও এর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সেদিন এই বাহিনীগুলোর কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর সরকারের নীতি এবং তাঁরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদনপুষ্ট। আজ সেই একই বাহিনী যখন গণমানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে, তখন সেই দায়কে ‘কিছু ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কি দ্বিচারিতা নয়?
এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী লর্ড ডেভিড ওয়েন বর্ণিত ‘হুব্রিস সিন্ড্রোম’-এর সঙ্গে মেলানো যায়। দীর্ঘ সময় ধরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় থাকার ফলে শাসক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং নিজেকে রাষ্ট্রের সমার্থক ভাবতে শুরু করেন। তাঁর কাছে নিজের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত এবং যেকোনো ব্যর্থতার দায় অন্যের।
শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ বছরের শাসনামলে পুলিশকে একটি অনুগত বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন, যারা আইনের শাসন নয়, শাসকের ইচ্ছাকেই ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। এখন সেই আনুগত্যের ফসল যখন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তখন তিনি সেই দায় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি সেই সব হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, যাদের তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আজ নিজেই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন।
নির্বাসন থেকে কি নতুন রাজনৈতিক কৌশল করা হচ্ছেএই সাক্ষাৎকারগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এগুলো কেবল অতীতকে অস্বীকার করার প্রচেষ্টা নয়, এটি নির্বাসন থেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের এক নতুন রণকৌশলের অংশ। যখন শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর দল অংশ নিতে না পারলে আগামী নির্বাচন বয়কট করা হবে, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি নিজেকে একজন পরাজিত ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হতে দিতে রাজি নন; বরং হাসিনা তাঁর অনুগত কর্মী-সমর্থকদের কাছে বার্তা পাঠাতে চাইছেন, তাঁর লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিজের বয়ান প্রতিষ্ঠা করে তিনি দেশের অভ্যন্তরে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে নিজের প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হলো শেখ হাসিনার শব্দচয়ন। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট যখন তাঁকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না প্রশ্ন করে, তার উত্তর ছিল এক ক্যালকুলেটেড রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট: ‘আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।’
শব্দচয়নের এই রাজনীতিকে বুঝতে হবে। ‘শোক’ একটি নিষ্ক্রিয় ও দূরবর্তী আবেগ, যা যেকোনো নাগরিকই প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু ‘ক্ষমা’ একটি সক্রিয় স্বীকারোক্তি, যা নিজের কৃতকর্মের দায় কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রতীক। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো, যা ঘটেছে তার জন্য নিজেকে নৈতিকভাবে দায়ী বলে স্বীকার করা। শেখ হাসিনা সযত্নে সেই দায় এড়িয়ে গেছেন। এটি প্রমাণ করে, ক্ষমতা হারানোর পরও তাঁর মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আরও পড়ুনএকটি শরীর, একটি বুলেট এবং এক স্বৈরাচারের পতন০২ আগস্ট ২০২৫ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও দায়বদ্ধতার আয়নাএই অস্বীকার ও দায় চাপানোর রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জেনারেলরা গণহত্যার দায় অস্বীকার করে একে ‘মাঠপর্যায়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাৎসি কমান্ডাররা ‘ওপরে হুকুম ছিল’ তত্ত্ব দিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চেয়েছিলেন।
সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, শেখ হাসিনা সরকার দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ‘অধিনায়কত্বের দায়’ বা ‘কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি’-র নীতির ভিত্তিতেই দণ্ডিত করা হয়েছিল। সেদিন ট্রাইব্যুনালের যুক্তি ছিল, শীর্ষ নেতারা সরাসরি গুলি না চালালেও তাঁদের নির্দেশ, নীতি ও নীরবতাই অধস্তনদের অপরাধ করতে উৎসাহিত করেছে। আজ ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, সেই একই ‘অধিনায়কত্বের দায়’-এর নীতি তাঁর বিরুদ্ধেই অকাট্যভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে।
আইসিটির প্রধান অভিযোগকারী আদালতে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ছিলেন এই অপরাধের প্রাণভোমরা অর্থাৎ নিউক্লিয়াস; তাঁর নির্দেশ ছাড়া এমন সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড সম্ভব নয়।’
শেষ পর্যন্ত, শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলো তাঁর রাজনৈতিক দেউলিয়া অবস্থাকেই প্রকাশ করল। যে গণ-অভ্যুত্থান ছিল দেড় দশকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ, তাকে তিনি ‘সহিংস বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তা দমন করাকে তাঁর ‘সাংবিধানিক অধিকার’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে, সত্যের শক্তিই সর্বাধিক। আবু সাঈদের নিরস্ত্র বুক পেতে দেওয়া থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরায় পুলিশের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিকেই আঙুল তোলে।
যে পুলিশ বাহিনীকে শেখ হাসিনা দেড় দশক ধরে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন, আজ সেই বাহিনীর কাঁধে দোষ চাপিয়ে তিনি ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি পাবেন না। কারণ, ২০২৪-এর রক্তপাতের দায় কেবল পুলিশের ট্রিগার-ফিঙ্গারে নয়; বরং সেই আঙুলকে নড়াতে যে নীতিগত নির্দেশ চক্র কাজ করেছে তার কাছেই শেষ পর্যন্ত গিয়েই থামে।
আরিফ রহমান গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব