Prothomalo:
2025-11-06@16:52:17 GMT

পাগলের মেয়ে

Published: 6th, November 2025 GMT

আমি তৃষা, তৃষা আক্তার। বয়স চব্বিশ। বাবা পাগল আর মায়ের পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু নেই। নামটাও নেই, সবাই তৃষার মা নামেই চেনে। বাবার যে দায়িত্ব, তা তিনি কোনো দিন পালন করেননি। সত্যি বলতে কি, করার মতো অবস্থাও ছিল না। বছরের বেশির ভাগ সময় নিজের সন্তানকেও চিনতে পারত না। বাবা নাকি মায়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকে এমন ছিলেন।

তখন নানা-নানি বেঁচে ছিলেন না। এদিকে মায়ের বিয়ের বয়স পার হচ্ছে। হতদরিদ্র, ছাপোষা মামা যেন আপদ বিদায় করতে পারলে বাঁচেন। এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে সম্বন্ধ আসে। ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই আমার মামা বোনের দায়ভার থেকে মুক্তি নিলেন। মা-ও ভাবলেন, যাক নিজের একটা সংসার হলো। কিন্তু বাবার অস্বাভাবিক আচরণ বিয়ের পরদিন থেকেই মা বুঝতে পারেন।

দাদা মনে করেছিলেন, বিয়ে দিলেই হয়তো বাবার পাগলামো কমে যাবে। মা-ও বোকার মতো বিশ্বাস করতেন হয়তো পাগল বাবা একদিন সুস্থ হবে। লাভের লাভ কিছুই হয়নি, মাঝখান থেকে আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন। আমার ধারণা, বাবা জৈবিক চাহিদা বুঝতেন না। বাচ্চা হলে বাবা হয়তো সুস্থ হবে এই বিশ্বাস থেকেই মায়ের শেষ চেষ্টা ছিল তাঁর সংসার টিকিয়ে রাখার। অতঃপর আমার জন্ম।

আমার জন্মের পর বাবার অবস্থা ভালো হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়ে যায়। বাবার আদর কোনো দিন পাইনি আমি। উপরি পাওনা হিসেবে পেয়েছি মানুষের কাছে অপমান ও উপহাস। মনে পড়ে, যখন স্কুলে পড়তাম, বাচ্চারা আমার সঙ্গে বসতে চাইত না, বাবা পাগল এই কারণে। সেই ছোট বয়সের নিষ্পাপ মনে বোঝার সাধ্য ছিল না আমার অপরাধ কী।

দাদা মারা গেলেন। বাবার দেখাশোনা করতেন ফুপুরা, হয়তো জমি-জমার আশায়। আমার আর আমার মায়ের ঠাঁই হয়নি সেই বাড়িতে। অতঃপর মায়ের সংসারজীবনের ইতি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল আমার মাকে।

তখন আমি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি। অন্যের বাসায় কাজ করে আমার মা আমাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। আমিও মায়ের আদর্শ মেয়ে হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত। এরপর আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক শেষ করে একটি পত্রিকা অফিসের ফ্রন্ট ডেস্ক-এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ শুরু করি।

না, এতে আমার মায়ের দুঃখ ঘোচেনি। আমার ‘মিথ্যেবাদী’ মায়ের কপালে এত সহজে সুখ লেখেননি সৃষ্টিকর্তা। মিথ্যেবাদী কেন বলছি, সেটা বলে নেই।

তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি, রাত জেগে পড়তে হয়। মা অন্যের বাসায় কাজ করে। দিন শেষে সেই বাসার অতিরিক্ত খাবার মায়ের জন্য দেওয়া হলে সারা দিন অভুক্ত মা ‘এখন খিদে নেই পরে খাব’ বলে সেই খাবার আমার জন্য আনত। অভুক্ত আমি সেই খাবার তৃপ্তি নিয়েই খেতাম। যা দেখে মায়ের চোখে পানি এসে যেত। হয়তো এটা ভেবে যে তাঁর একমাত্র মেয়েকে এক বেলা ভালো-মন্দ খেতে দিতে পারছেন না।

মেয়ে হিসেবে আমি খুব সুন্দরী নই, কিন্তু নারী হিসেবে শরীরের গঠন তো পেয়েছি। এই ছোট শরীরটার ওপর নজর পড়ে সেই বাড়ির এক পুরুষ সদস্যের, যেখানে মা কাজ করতেন। মায়ের খোঁজে গিয়েছিলাম কলেজ ছুটির পর, যেমনটা প্রায়ই যেতাম। সেদিন মা মুদিদোকানে কিছু একটা আনতে গিয়েছিলেন। সেই মানুষরূপী পশুটা আমাকে বেডরুমে বসতে বলে। তারপর আদর করার ছলে আমার শরীরে বাজেভাবে হাত দিতে থাকে। খারাপ ছোঁয়া বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছিল আমার। আমি বাধা দিলে জোর করে আমাকে বিছানায় ফেলে দেয়। আসন্ন সর্বনাশের কথা ভেবে আমি সজোরে লাথি মেরে নিজেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। মা ফিরলে দরজা খুলে সেই বাসা থেকে পালিয়ে আসি।

আজ আমি চাকরি করি ঠিকই, কিন্তু স্রষ্টার পরীক্ষা যেন এখনো শেষ হয়নি। মেয়ে হিসেবে জন্ম দিয়েছি, তাই সমাজের রীতি ও মায়ের ইচ্ছাপূরণে নিজের সংসার হওয়াটা দরকার। কিন্তু দুর্ভাগা কপাল একটার পর একটা সম্বন্ধ আসে আর ভেঙে যায়। কারণ সেই ‘পাগল বাবা’। যখনই ছেলেপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আমার বাবা পাগল, তখনই পিছিয়ে যায়।

এরপর আমার বয়স বাড়তে থাকে, মা আরও বুড়ো হতে থাকেন। এখন আমি মায়ের যত্ন নিই। সারা জীবন কষ্ট করেছেন আমার এই মা, আমার এই প্রিয় মানুষটা তাই এখন আমি চাই, মা যেন মনের আনন্দে বাঁচেন। মা-মেয়ের ছোট সংসার। আমরা সুখেই আছি।

নিয়মিত অফিস করি, তেমনি একদিন অফিসে কাজে ব্যস্ত। এক ভদ্রলোক এলেন চশমা পরা, সাদা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ। একটি লাইভ প্রোগ্রামে অংশ নিতে। নিজেকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দিলেন। কথায় কথায় আমার নাম ও বাড়ি কোথায় জানতে পেরে থমকে গেলেন। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন ‘তোমার নাম—তৃষা আক্তার?’ তোমার বাবা মফিজুর রহমান! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম।

তিনি বললেন আমি একসময় তোমার বাবার চিকিৎসক ছিলাম। আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। তিনি বললেন, তোমার বাবা কোনো দিনই পাগল ছিলেন না। তাঁকে পাগল বানানো হয়েছিল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তিনি আরও বললেন, জমিজমার লোভে তোমার ফুপু আর গ্রামের কয়েকজন মিলে নিয়মিত ওষুধ খাইয়ে তাঁকে পাগল বানিয়ে রাখত। আমিও সত্যিটা কাউকে জানাতে পারিনি, কারণ তখন আমি টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলাম, সঙ্গে প্রাণের ভয়ও ছিল।

আমার চারপাশ হঠাৎ দুলে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই মানুষটা, যাঁর পরিচয় সারা জীবন লজ্জায় লুকিয়েছি। আমার পাগল বাবা! যিনি আসলে পাগল ছিলেন না, বরং ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার!

আমি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি, বাইরে সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। বুকে হঠাৎ এক অদ্ভুত ভারী শূন্যতা অনুভব করছি। জীবনে এত দিন যে মানুষটাকে ঘৃণার প্রতীক ভেবেছি, তিনিই ছিলেন সবচেয়ে অসহায় এক শিকার। সেদিনই প্রথমবার বাবার ছবিটার সামনে গিয়ে অঝোরে কাঁদলাম, বাবা তুমি কখনো পাগল ছিলে না, তোমাকে পাগল বানিয়েছে সমাজের কিছু নিকৃষ্ট মানুষ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র আম র আম র ম প গল ব বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

তালেবানের নিষেধাজ্ঞায় আফগানিস্তানে ব্যাপকভাবে কমেছে আফিম চাষ

২০২২ সালে তালেবান সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আফগানিস্তানে আফিম চাষ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বরাত দিয়ে বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর এক জরিপে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় পপি চাষের মোট জমির পরিমাণ ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে আফিমের পরিমাণ ৩২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

আফগানিস্তান বিশ্বের ৮০ শতাংশেরও বেশি আফিম উৎপাদন করত। আফগানিস্তানের আফিম থেকে তৈরি হেরোইন ইউরোপের বাজারের ৯৫ শতাংশ ছিল।

কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তালেবান ২০২২ সালের এপ্রিলে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করে। তারা কৃষকদের জানায়, আফিম ক্ষতিকারক এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ জানিয়েছে যে ‘গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ সত্ত্বেও বেশিরভাগ কৃষক নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছেন। বর্তমানে অনেক আফগান কৃষক শস্য চাষ করছেন।

লাভজনক বিকল্পের অভাব, সীমিত কৃষি উৎপাদন এবং প্রতিকূল জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে উপলব্ধ কৃষিজমির ৪০ শতাংশেরও বেশি পতিত রয়ে গেছে। চলতি বছর আফিম পপি চাষের আওতাভুক্ত মোট জমি ১০ হাজার ২০০ হেক্টর বলে অনুমান করা হয়েছিল, যার বেশিরভাগই দেশের উত্তর-পূর্বে। এর মধ্যে বাদাখশান প্রদেশ সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালের নিষেধাজ্ঞার আগে, আফগানিস্তানে দুই লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে পপি চাষ করা হত।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ