ইসরায়েলের চেয়ে ‘সহনশীল’ ইরানকেই চায় আরব বিশ্ব
Published: 27th, June 2025 GMT
গত ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিচ্ছি’। তারা প্রতিরোধ অক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে একাধিক ফ্রন্টে আঘাত হানেন। নেতানিয়াহুর ‘পরিবর্তন’ শুরু হয় তিন দিন আগে তেহরান, এর সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় তীব্র হামলা এবং শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পারমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যার মাধ্যমে। তেহরানের সঙ্গে তেল আবিবের সরাসরি সংঘর্ষের উদ্দেশ্য ছিল, অঞ্চলটিকে বৃহত্তর যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে স্থগিত রয়েছে।
গত বুধবার দ্য ক্র্যাডলের বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে বলা হয়, পারস্য উপসাগরের আরব দেশগুলোর জন্য, বিশেষ করে ওয়াশিংটনের মিত্র যারা, তাদের সামনে একটি কঠোর বাস্তবতাকে উন্মোচিত করে–যদি তেল আবিব এ লড়াইয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তাহলে আরব বিশ্ব তার শেষ অর্থপূর্ণ প্রভাব হারাবে।
গাজা, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরান ও তার মিত্রদের ওপর ইসরায়েলের একটি নির্ণায়ক বিজয় এসব দেশ ও অঞ্চলে তেল আবিবের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ নির্বিঘ্ন করবে। ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ, যা আরব সরকারগুলোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি কৌশলগত চাপের কার্ড, রাতারাতি ভেঙে ফেলা হবে। এক সময় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মগ্ন থাকা উপসাগরীয় শাসকরা নিজেদের একটি সাহসী দখলদার রাষ্ট্রের অধীনে যেতে বাধ্য হবেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাত আপাতত স্থগিত হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়েছে। তবে প্রথমে তেল আবিব ও পরে ওয়াশিংটনের গোয়েন্দারা বলছেন, তেহরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ চক্রকে মাত্র কয়েক মাস বিলম্বিত করা সম্ভব হয়েছে; গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো অক্ষত আছে। কারণ, হামলার আগেই ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশির ভাগ অংশ স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়।
নেতানিয়াহুর যুদ্ধ-পরবর্তী উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের অনেক আগে ইসরায়েলের বিশিষ্ট মন্ত্রীরা অধিকৃত পশ্চিম তীরের আনুষ্ঠানিক সংযুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা গাজার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন, ১৯৬৭ সালের গ্রিন লাইন মুছে ফেলার মানচিত্র বিতরণ করেছিলেন এবং বসতি নির্মাণ ত্বরান্বিত করেছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর চালানো হামাসের অভিযানের আগেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা পশ্চিম তীর আনুষ্ঠানিকভাবে দখলের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে।
ইসরায়েলের বিশ্বাস ছিল, যদি ইরানকে একপাশে সরিয়ে রাখা যায়, হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়বে। সিরিয়া এখন পশ্চিমা-প্রতিষ্ঠিত প্রশাসন দ্বারা শাসিত হয়, যার শিকড় আল কায়দার গভীরে। তাহলে তেল আবিব সীমানা পুনর্নির্মাণ, বসতি স্থাপন ও ন্যূনতম প্রতিরোধের মাধ্যমে গণস্থানান্তরের জন্য নির্ভার হবে। এমনকি ইসরায়েলের ডানপন্থি সরকারি কর্মকর্তাদের মনে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার হুমকিও কমে গেছে। প্রতিরোধের অক্ষের পরাজয় বা প্রান্তিকীকরণ ইসরায়েলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর শেষ অর্থপূর্ণ বাধা দূর করবে। ফলে তেল আবিবকে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’-এর ইহুদিবাদী লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক ভূগোল পুনর্গঠন করতে সক্ষম করবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী স্কুল ‘সামরিক বিজয়ের সুবিধা’ নামে একটি ধারণা প্রস্তাব করে, যা সত্যিই বেশ সহজ– যখন একটি দল একটি বড় যুদ্ধে জয়লাভ করে, তখন তারা তার নতুন অর্জিত ক্ষমতা ও খ্যাতি ব্যবহার করে আগের অসম্ভব নীতিগত পরিবর্তনের জন্য চাপ দিতে পারে। বিজয়ী সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ইসরায়েল সত্যিকার অর্থে বিজয়ী হলে পশ্চিম এশিয়ার শক্তি ও সীমানার ভারসাম্য বহু যুগের জন্য বদলে যেত। যদি ইরানের পতন হতো, তাহলে এক সময় দেশটির সঙ্গে সংঘাতে থাকা আরব দেশগুলো তাদের শেষ প্রতিরোধের স্পেসও হারাত।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল আরব দ শ ইসর য় ল র কর ছ ল ন মন ত র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
যন্ত্র নয়—উন্নত, সহনশীল, মানবিক মানুষের কাছে নিবেদন
এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আদিবাসীরা প্রাচীন জ্ঞানের অভিভাবক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক এবং জীববৈচিত্র্যের লালন–পালনকারী, যা সবার ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।’
তিনি আরও বলেছেন, এ বছরের যে মূল সুর, আদিবাসী জনগণ ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ভবিষ্যৎ গঠনে এর ভূমিকা, যাতে একদিকে নানা ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ রয়েছে, অন্যদিকে উপকারিতাও রয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই বিপন্ন ভাষাগুলো পুনরুদ্ধার, ওরাল সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমির ম্যাপিং, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রাচীন জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারে। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নতুন এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তারে আদিবাসী এক্সপার্ট ও গবেষকদের সক্রিয় ও যথাযথ অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। যদি তাদের এ প্রক্রিয়ায় বাইরে রাখা হয়, তাহলে তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে।
আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এআই প্রযুক্তি তৈরি ও পরিচালনা যেন ইনক্লুসিভ, নৈতিকতাসম্পন্ন ও ন্যায্য হয়। এর অর্থ হলো ডেটা সার্বভৌমত্ব, মেধাস্বত্ব অধিকার ও আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি এআই প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আদিবাসীদের মানবাধিকার, ভূমির অধিকার, বন, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় তাদের অবদান, অ্যাডভোকেসিসহ নানা বিষয়ে কাজ করতে পারি।
এবার ভিন্ন রকম পরিবেশে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্যাপন করছি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম, সব বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসানে দেশ এগিয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। এটি জাতিসংঘও স্বীকার করে। এই কারণে জাতিসংঘ ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ বা ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ স্লোগান নিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছে, যেখানে ইন্ডিজিনাস পিপলস বা আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা উদ্যাপনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়।
এসব জাতির জীবনধারা, মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি, সব মিলিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বাড়ানোই হলো এই দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আমাদের দেশে এসব কাজ বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী সদিচ্ছা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী মানুষের বাস। তারা সাত হাজার ভাষায় কথা বলে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতি। তারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ ভাগ। অথচ তারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ সংরক্ষণ করে।
আমাদের দেশেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চল—সর্বত্র আদিবাসী মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি হারিয়েছে। তাদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছে, সমীক্ষায় পাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। ভাষাগুলো হলো: খাড়িয়া, কোরা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিপন্ন ভাষার সংখ্যা আরও বেশি হবে। কমপক্ষে ২৫টি ভাষা ঝুঁকিপূর্ণ।
এখন আমরা কী করতে পারি, এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, জাতিসংঘের এজেন্সি, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার মিলে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পথ তৈরি করতে পারে। শুধু আলোচনা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বাজেট বরাদ্দসহ, যাতে অ্যাকশন বা কাজ হয়। জাতিসংঘের অবশ্যই এখানে বিশেষ দায়িত্ব আছে। জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র আছে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এখন মানবাধিকার হাইকমিশনের নতুন অফিস হয়েছে ঢাকায়। তারা কাজ করতে পারে।
আমি দেখলাম, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উন্নত দেশে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কানসাস ইউনিভার্সিটি, এডিনবরা ইউনিভার্সিটিসহ পশ্চিমে অনেক গবেষণা, সেমিনার, লেখালেখি হয়েছে এআই ও ইন্ডিজিনাস পিপলস বিষয়ে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে কাজ হচ্ছে। আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসতে পারে।
সব মিলিয়ে এআইয়ের প্রয়োগ নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় প্রযুক্তি বা মেশিন ভুল তথ্য ছড়ায়, যা খুব বিপজ্জনক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণে আদিবাসী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এআইয়ের পক্ষে আদিবাসী মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সংস্কৃতি ও ওয়ার্ল্ডভিউ, ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক, নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার বেদনা—এই সব ধারণা করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ—এই তিন পক্ষের ‘ত্রিপক্ষীয় সংলাপ’ ও শ্রদ্ধাবোধ অতি জরুরি। একটা রিকনসিলিয়েশন দরকার, যেখানে পারস্পরিক সম্মান ও স্বীকৃতি জরুরি। এআই বা মেশিন হয়তো সঠিকভাবে মানুষের হাহাকার ও কষ্ট অনুভব করতে পারবে না, কিন্তু মানুষ তো পারে। আমরা পারি। সেই উন্নত, সভ্য, সহনশীল, মানবিক, সাংস্কৃতিক চরিত্রে উঁচু, সূক্ষ্ম সহানুভূতিশীল ও হৃদয়বান মানুষের কাছে আজকের নিবেদন।
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী