ফোনে বন্যার আগাম বার্তা কমছে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি
Published: 29th, June 2025 GMT
নদী, পাহাড় ও প্রকৃতির মিতালিতে ছবির মতো সুন্দর জনপদ সিলেটের গোয়াইনঘাট। এ উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সারি, গোয়াইন ও পিয়ান নদী। এখানকার মানুষের জীবিকার উৎস নদী আর প্রকৃতি। তবে সেই প্রকৃতি মাঝেমধ্যে ধারণ করে রুদ্রমূর্তি। প্রতিবছর উজানে ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢলে অকস্মাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় জীবন-জীবিকা। তবে সেলফোনে বন্যার আগাম বার্তা উপজেলাবাসীর ক্ষয়ক্ষতি এখন অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ২৬ বছরের সুলতানা বেগম জানান, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর চার বছর আছেন বাবার বাড়িতে। বাবার মৃত্যুর পর উপার্জনক্ষম একমাত্র ছোট ভাই থাকেন প্রবাসে। মা ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন সুলতানা। ২০২২ সালের মে মাসে বন্যায় মুহূর্তে তলিয়ে যায় বসতবাড়ির চারপাশ। ভেসে যায় হাঁস-মুরগিসহ গবাদি পশু। তড়িঘড়ি পরিবারের সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে প্রাণ বাঁচে।
ভয়াল সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সুলতানা বলেন, ‘হঠাৎ নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। বন্যার আগাম কোনো তথ্য না থাকায় বিপদে পড়তে হয়। সময়ের সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন মোবাইল ফোনের ভয়েস কলে বন্যার অন্তত ১০ দিন আগে পূর্বাভাস জানতে পারি। প্রস্তুতির সুযোগ পাওয়া যায়।’
একই কথা ইউনিয়নের চার সন্তানের জননী রাজিয়া বেগম ও গৃহিণী সজনা বেগমের। বললেন, মোবাইল ফোনে বন্যার আগাম তথ্য আসায় কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকতে পারি। আকস্মিক বন্যা নিয়ে ভয় আগের মতো নেই।
সুফল প্রকল্পের পক্ষ থেকে উপজেলার রুস্তমপুর ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাসিন্দার ফোন নম্বরে ১০ দিন আগে বন্যার আগাম সতর্কবার্তা (ভয়েস মেসেজ) পাঠানো হয়। আকস্মিক বন্যার ক্ষেত্রে বার্তা এক সপ্তাহ আগে দেওয়া হয়।
আকস্মিক বন্যাপ্রবণ সিলেটের গোয়াইনঘাটে ঝুঁকিতে থাকা প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কেয়ার বাংলাদেশ, কনসার্নসহ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে ‘সুফল (স্কেলিং-আপ ফোরকাস্টবেজড অ্যাকশন অ্যান্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশ)’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের স্থানীয় বাস্তবায়ন সহযোগী উন্নয়ন সংস্থা এফআইভিডিবি।
প্রকল্পের ইউনিয়ন মবিলাইজার এফআইভিডিবি কর্মকর্তা মিন্টু রঞ্জন আচার্য্য জানান, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তারা বন্যার আগাম বার্তা ও প্রস্তুতির বিষয়ে বার্তা সহায়তা দিচ্ছেন। মুখে মুখে ছাড়াও মসজিদ এবং মাইকিং করে বন্যার পূর্বাভাস জানিয়ে দেওয়া হয়। পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে হতদরিদ্রদের আর্থিক অনুদানও দেওয়া হয়। গত বছর রুস্তমপুর ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নে ৮৬৮ হতদরিদ্র পরিবার যথাক্রমে ৫ হাজার ও ৭ হাজার টাকা করে পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দুটি ইউনিয়নে নারী, তরুণ ও কৃষকদের নিয়ে পৃথকভাবে একটি করে ছয়টি কমিউনিটি গ্রুপ করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হলেও কমিউনিটি গ্রুপগুলো দুর্যোগ থেকে এলাকাবাসীকে সুরক্ষার উদ্যোগ চলমান রাখবে।’
লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহেদ আহমেদ বলেন, ‘সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়ার্ডবাসী উপকৃত হচ্ছেন। শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত ও বন্যার আগাম তথ্য হাতে আসছে। বাসিন্দাদের জানাচ্ছি। সবাই সতর্ক ও প্রস্তুতি নিতে পারায় গত দুই বছর বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি।
পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।
আরো পড়ুন:
রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ
আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।
চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”
তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”
যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।
৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত
তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।
তৌকির বিশ্বাস করেন, “স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”
তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।
তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।
তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন
ঢাকা/মাসুদ