৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন পাবনার সাইকেল মেকানিক শফিকুল ইসলামের ছেলে মো. আশিকুর রহমান (২৮)। এ সাফল্যের পেছনে বাবা ও ভাইয়ের অবদান আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

বিসিএস পরীক্ষায় ভাল ফল করতে আশিকুর রহমানের পরামর্শ—‌সব সময় সৎ ও ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আনা যাবে না।

আশিকুর রহমানের বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া ইউনিয়নের গোকুলনগর গ্রামে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি।

আশিকু রহমান বলেছেন,“আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা সাইকেল মেকানিক ছিলেন। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেশকিছু দূরে খিদিরপুর বাজারে গিয়ে সাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। যা আয় করতেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলত। আমাদের ভাই-বোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে ২০০২ সালে মা মারা যান। তখন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবা আমাকে আগলে রাখতেন। কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেননি।”

আটঘরিয়া উপজেলার খিদিরপুর শহীদ আব্দুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি, ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন আশিকুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ২০১৯ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।

এর পর থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতির পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন আশিকুর রহমান। ২০২৪ সালের ২০ জুন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এবার ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

এই সাফল্যের পেছনে কার অবদান বেশি, জানতে চাইলে আশিকুর রহমান বলেন, “আমার সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান বাবার। সাইকেল মেরামতের কাজ করে আমার পড়ালেখার সব খরচ যুগিয়েছেন। কোনো অভাব রাখেননি। মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আর একজন আমার মেঝো ভাই আমিরুল ইসলাম সবুজ। ডিপ্লোমা শেষ করে তিনি ঢাকায় চলে যান অভাবী সংসারের হাল ধরতে। নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এই দুইজন মানুষ আমার সাফল্যের পেছনে মূল কারিগর।”

বাবার সঙ্গে ভাল লাগার স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আশিকুর বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। আবার আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। বাবা সারাদিন কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফিরতেন। আমার যেদিন শ্বাসকষ্ট হতো, তখন কিভাবে যেন তিনি টের পেতেন। তখন রসুন দিয়ে সরিষার তেল গরম করে আমার বুকে মালিশ করে দিতেন বাবা। আমি সুস্থ হয়ে যেতাম।”

তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমার লেখাপড়ার বিষয়ে বাবাকে কখনো কিছু ভুলে যেতে দেখিনি। খাতা, কলম যখন যেটা আনতে বলতাম, তিনি ঠিকই নিয়ে আসতেন। তিনি বাড়ির প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আনতে ভুলে গেলেও আমার লেখাপড়ার কোনো জিনিস আনতে তাকে কখনো ভুলে যেতে দেখিনি। এটা আমার খুবই অবাক লাগে।”

চাকরিপ্রত্যাশীদের পরামর্শ দিতে গিয়ে আশিকুর রহমান বলেন, “সব সময় সৎ আর পজিটিভ চিন্তা করতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, আমি পারবই, আমাকে পারতেই হবে। নেগেটিভ কোনো চিন্তা মাথায় আনা যাবে না।”

বাবা সাইকেল মেকানিক ছিলেন, এ পরিচয় দিতে কখনো সংকোচ বোধ করেন না আশিকুর রহমান। দেশের জন্য, দরিদ্র মানুষদের জন্য কাজ করতে চান তিনি। এজন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন আশিকুর রহমান।

ঢাকা/শাহীন/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ক ষ য় স ফল য ব স এস

এছাড়াও পড়ুন:

সব বাধা পেরোনো উল্লাস

জন্ম থেকেই দুই হাত ও দুই পা বাঁকা। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারতেন না। শৈশবে স্কুলে যেতেন বাবার কোলে চড়ে। সহপাঠীরা মাঠে খেলতেন, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে দেখতেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যেন বারবার পথরোধ করেছে তাঁর। তবু দমে যাননি উল্লাস পাল। অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নকে সঙ্গী করে অবশেষে ছুঁয়ে ফেলেছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এই জীবনযোদ্ধা। এর আগে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল ও আন্না রানী দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। 
জন্মগ্রহণের পর দুই পায়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখা হয়নি। দুই হাত দিয়েও স্বাভাবিক কাজ করতে পারতেন না। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেন উল্লাস। ভারতে গিয়ে অস্ত্রোপচারের পর ডান পায়ের কিছুটা উন্নতি হয়। তাহলেও স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেননি কখনোই।
উল্লাসের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু ১৯৯৯ সালে, কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা প্রতিদিন তাঁকে কোলে করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। লেখার কাজ করতেন বাম হাতে। এসএসসি পাস করেন ২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, পান জিপিএ ৫। এরপর যান ঢাকায়। ইচ্ছা ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে সুযোগ পাননি। ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে ২০১২ সালে জিপিএ ৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে বিবিএ এবং পরে এমবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর ৪০তম ও ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। ৪০তম বিসিএসে পাস করলেও কোনো পদে সুপারিশ পাননি। তবে ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। লক্ষ্য ছিল প্রশাসন ক্যাডার।  ৪৪তম বিসিএসে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।
উল্লাস পাল বলেন, ‘আমি রেজাল্ট দেওয়ার কথা শুনে প্রশাসন ক্যাডারে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার মিলাচ্ছিলাম। যখনই আমার নম্বরটি মিলে যায়, আনন্দে চোখ দিয়ে জল বের হয়ে যায়। আমার পরিবারের সবাই দারুণ খুশি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় সমাজের অনেকেই ঠাট্টা-মশকরা করেছে। আবার অনেকেই প্রচণ্ড ভালোবেসেছে। আমি কখনও দমে যাইনি। লক্ষ্য স্থির রেখে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি।’
যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, সমাজ চাইলেই তাদের জন্য সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন উল্লাস। তিনি বলেন, ‘আমি চাই, যারা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্ম নিয়েছে, সমাজের কেউ যেন তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব না দেখায়।’
উল্লাসের মা আন্না রানী পাল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই উল্লাস অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। সে পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী ছিল। সবাই ওকে নিয়ে গর্বিত।’
ছেলেকে বড় করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি জানিয়ে উত্তম কুমার পাল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই উল্লাসকে বিশেষভাবে যত্ন করে বড় করেছি। লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহের জন্য আজ সে এই সাফল্য অর্জন করেছে।’
উল্লাসের মেধাবী। তাঁর মতো সৎ, আত্মমর্যাদাশীল ছেলে সত্যিই কম দেখেছেন মন্তব্য করে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি চাই, ও (উল্লাস) ওর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আরও এগিয়ে যাক।’
উল্লাস পালের বন্ধু অসীম পাল। একসঙ্গে স্কুলে যেতেন। বললেন, উল্লাসের চলাফেরায় যে প্রতিবন্ধিতা ছিল, সেটি কখনোই তার মনের জোরকে দুর্বল করতে পারেনি। ক্লাসে সবসময় সবার আগে থাকত। কেউ একটি বিষয় এক ঘণ্টা পড়লে উল্লাস সেটি তিন ঘণ্টা পড়ত। 
অসীম বলেন, ‘আমি কাছ থেকে দেখেছি, ওর (উল্লাস) জেদ, স্বপ্ন, আর লড়াই। আমি গর্ব করে বলি, উল্লাস শুধু আমার বন্ধু না, ও আমাদের সময়ের এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।’
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত পাবনার আশিক-গৌরব-ধ্রুব
  • সব বাধা পেরোনো উল্লাস
  • শিক্ষাজীবনে কোটা নেননি শারীরিক প্রতিবন্ধী উল্লাস, বিসিএসে পেলেন প্রশাসন ক্যাডার
  • ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ, ক্যাডার হলেন ১৬৯০ জন
  • ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, ক্যাডার হলেন ১৬৯০ জন
  • ৪৪তম বিসিএসে ১৬৯০ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করল পিএসসি
  • ৪৪তম বিসিএসের পদ বৃদ্ধির দাবিতে যমুনামুখী বিক্ষোভ, পুলিশের বাধা