গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় সহায়তা করছে মাইক্রোসফটসহ বহু প্রতিষ্ঠান
Published: 2nd, July 2025 GMT
অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ এক নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এতে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ফিলিস্তিনি জনগণকে বাস্তুচ্যুত করা ও গাজায় চলমান গণহত্যায় ইসরায়েলকে সহায়তা করছে। তাদের এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।
প্রতিবেদনটি আগামী বৃহস্পতিবার জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এতে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ইনকরপোরেটেড (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান) ও অ্যামাজন। এই তদন্তের অংশ হিসেবে এক হাজারের বেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের একটি ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলের এই চিরস্থায়ী দখলদারত্ব অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরীক্ষা–নিরীক্ষার আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সেখানে চাহিদা ও জোগানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে নজরদারির ঘাটতি। নেই কোনো জবাবদিহি। বিনিয়োগকারী ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে।
ইসরায়েল বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ক্রয় কর্মসূচির অংশ হয়ে উঠেছে। যেমন ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ। এই যুদ্ধবিমানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৮টি দেশের ১ হাজার ৬০০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠান।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব বড় প্রতিষ্ঠান এখন আর শুধু ইসরায়েলের দখলদারত্বে যুক্ত নয়, বরং গণহত্যার অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ হয়ে গেছে।
২০২৪ সালে আলবানিজ এক বিশেষ মতামতে বলেছিলেন, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার পর্যায়ে পড়ার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
এই প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, গাজায় কেন ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, অনুসন্ধানে সেটা উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, এই গণহত্যা অনেকের জন্য লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে কোন অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর নাম এসেছে
ইসরায়েল বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ক্রয় কর্মসূচির অংশ হয়ে উঠেছে। যেমন ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ। এই যুদ্ধবিমানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৮টি দেশের ১ হাজার ৬০০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লকহিড মার্টিন। তবে এই যুদ্ধবিমানের বিভিন্ন সরঞ্জাম বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়।
ইতালির লিওনার্দো এসপিএ সামরিক খাতে অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং জাপানের এফএএনইউসি করপোরেশন অস্ত্র তৈরির রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
প্রযুক্তি খাতও ইসরায়েলের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সরকারি ব্যবহারে সহায়তা করে ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তিগুলোর ‘প্রায় পূর্ণাঙ্গ সরকারি ব্যবহারের সুযোগ’ দিয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরকারি ব্যবহারে সহায়তা করে ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তিগুলোর ‘প্রায় পূর্ণাঙ্গ সরকারি ব্যবহারের সুযোগ’ দিয়েছে।প্রতিবেদনটি আরও বলছে, মার্কিন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আইবিএম ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং ইসরায়েলের জনসংখ্যা, অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের (পিআইবিএ) কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ পরিচালনা করছে। এই ডেটাবেজে ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান পালানটির টেকনোলজিস ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এই প্রতিষ্ঠান ‘স্বয়ংক্রিয় পূর্বাভাসমূলক পুলিশি প্রযুক্তি’ সরবরাহ করেছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে টার্গেট তালিকা তৈরি করে। যেমন ‘লেভেন্ডার’, ‘গোসপেল’ ও ‘হোয়ার ইজ ড্যাডি’ নামের এআই সিস্টেম।
ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের জানাজায় অংশ নিতে মানুষের ভিড়। গতকাল মঙ্গলবার রাতে হামলায় তাঁরা নিহত হন। ২ জুলঅই, খান ইউনিস.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ইসর য় ল ইসর য় ল র ব যবহ র গণহত য স গ রহ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্রেটা টুনবার্গসহ গাজা ফ্লোটিরার ২০০ জনকে আটক করেছে ইসরায়েল
গণহত্যার নৃশংসতায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙতে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে ঝঞ্ঝামুখর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে উপকূলে পৌঁছানো গাজা ফ্লোটিলার ২০০ জনকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
আলজাজিরা লিখেছে, গাজা ফ্লোটিলা অর্থাৎ গাজার উদ্দেশে রওনা হওয়া নৌকার বহরে রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও জলবায়ুকর্মীরা।
আরো পড়ুন:
বুকে আবু সাঈদ হাতে বাংলাদেশ, গাজার পথে শহিদুল আলম
গাজার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে চান ট্রাম্প
এই অধিকারকর্মীদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত গ্রেটা টুনবার্গ রয়েছেন, যাকে আটক করেছে ইসরায়েলি হানাদারা বাহিনী। তাকে গ্রেপ্তারের মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
এই ফ্লেটিলায় অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী ও অধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি এখনো আটক হননি বলে মনে করা হচ্ছে।
গাজামুখী নৌকার বহরের নাম ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা‘। এই বহরের মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক ইনস্টাগ্রামের পোস্টে ‘মিশন আপডেট’ শিরোনামে সবশেষ তথ্য দিচ্ছেন।
আবুকেশেক তার সবশেষ পোস্টে নিশ্চিত করেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী সমুদ্রে ১৩টি নৌকা তাদের কব্জায় নিয়েছে।
তিনি বলেছেন, এসব নৌকায় ৩৭টি দেশের ২০০ জনের বেশি অধিকারকর্মী ছিলেন। এর মধ্যে স্পেন থেকে ৩০ জন, ইতালি থেকে ২২ জন, তুরস্ক থেকে ২১ জন এবং মালয়েশিয়া থেকে ১২ জন অংশ নিয়েছেন।
গ্রেপ্তার সত্ত্বেও মিশন এখনো চলছে বলে জানিয়েছেন আবুকেশেক। তিনি লিখেছেন, গ্রেপ্তার সত্ত্বেও নৌকাগুলো গাজার অবরোধ ভাঙার জন্য ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রায় ৩০টি নৌকা আছে, যারা এখনো দখলদার বাহিনীর সামরিক জাহাজগুলোর কাছ থেকে লড়াই করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং গাজার উপকূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তারা অনুপ্রাণিত এবং তারা যা কিছু সম্ভব তা করছেন; যেন ভোরের মধ্যে একসঙ্গে এই অবরোধ ভাঙতে পারেন এবং গাজায় পৌঁছাতে পারেন।”
এদিকে গাজা ফ্লোটিলা থেকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক ওয়ালে মাঝে মাঝে পোস্ট দিচ্ছিলেন শহিদুল আলম। সবশেষ তিন ঘণ্টা আগে এক বার্তায় তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত এই লড়াই চলবে বলে দৃঢ় ভাষ্য উচ্চারণ করেছেন।
অবশ্য পাঁচ ঘণ্টা আগে দেওয়া আরেক পোস্টে শহিদুল আলম লেখেন, “আজ (বুধবার) রাতে সমুদ্র ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, আর আমরা বজ্রপাত ও ঝড়ের আগে আগে যেতে লড়াই করেছি।”
একই পোস্টে তিনি লেখেন, “আমাদের দ্রুত চলার আরেকটি কারণ ছিল, খবর এসেছে যে ইসরায়েলি জলদস্যুরা সামনের জাহাজ ‘আলমা’র দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই তাদের কৌশল। আমাদেরটা সবচেয়ে বড নৌকা, আর আলমাকে আক্রমণ করে তারা আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু আমরা ভীত হব না।”
“আমরা এই ঝড়ো রাতে বের হয়েছি একটি বার্তা দেওয়ার জন্য এবং গান গাওয়ার মাধ্যমে আমাদের সংহতি প্রকাশ করার জন্য। আমরা জানি আপনিও আমাদের পাশে আছেন। উঠে দাঁড়ান। প্রতিরোধ করুন। ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে আমরা হাল ছাড়তে পারি না,” বলেন শহিদুল আলম।
নৌকা বহরের একেবারে শেষটাতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন শহিদুল আলম। আর ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে সামনের কয়েকটি। ফলে তিনি আটক হয়েছেন কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ইসরায়েলের গণহত্যা অভিযানে গাজার অন্তত ৬৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, গুরুতর আহত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ছেন প্রায় দেড় লাখ। বহু শিশু অনাহার-অর্ধাহারে মায়ের কোলে মারা যাচ্ছে, কঙ্কালসার সন্তান প্রসব করছেন গাজার মায়েরা। আর সব বয়সি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে ধুকছে।
শুরুর দিকে বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চুপ থাকলেও কয়েক মাস হলো ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিক ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সহ অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থনে এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। বিশ্বের অধিকারকর্মীরা যখন গাজা ফ্লোটিয়া নিয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন এবং অধিকাংশ দেশ যখন এই ফ্লোটিলার পক্ষে রয়েছে, তখনো গাজায় নরহত্যা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরায়েল।
আলজাজিরার সবশেষ খবরে বলা হয়েছে, বুধবারও (১ অক্টোবর) গাজায় ৪৫ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
অবশ্য গাজা ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হানার প্রতিবাদে দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা ও ইতালিতে বিশাল র্যালি হয়েছে। মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ইসরায়েলের নিন্দা করে অধিকারকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা/রাসেল