অবাধ ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ কি সব সময় ইতিবাচক
Published: 10th, August 2025 GMT
একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে ‘তথ্য’ হয়ে উঠেছে নতুন শক্তি। একসময় যেখানে তথ্য ছিল সীমাবদ্ধ এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রিত, আজ সেখানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সম্প্রসারণ আমাদের তথ্যপ্রবাহকে গতিশীল করেছে সত্য; কিন্তু প্রশ্ন হলো অবাধ ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত প্রবাহ কি সব সময়ই ইতিবাচক? এর সাথে আমাদের দেশে মৌলিক শিক্ষা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সম্পর্ক কীভাবে দাঁড়ায়?
অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুফল ও ঝুঁকির দ্বৈত বাস্তবতাডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ কেবল সংবাদ বা বিনোদনের জন্যই নয়; বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যবসা ও নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা তথ্য নাগরিকেরা চাইতে ও পেতে পারেন—এটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে, যা একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
যেকোনো ধরনের তথ্যপ্রবাহের সবচেয়ে বড় সুফল হলো জ্ঞান ও সুযোগের গণতন্ত্রীকরণ। আগে যেখানে তথ্য পেতে সময়, অর্থ ও সংযোগ প্রয়োজন হতো, এখন কয়েক সেকেন্ডে ইন্টারনেট সার্চ বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা পাওয়া যায়। একজন কৃষক অনলাইনে আবহাওয়া পূর্বাভাস দেখে সেচের সময় নির্ধারণ করেন; কলেজপড়ুয়া কেউ চাইলেই বিনা মূল্যের অনলাইন কোর্সে গ্রাফিক ডিজাইন শিখে আয় শুরু করছেন; কিংবা বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়ে যাওয়া গ্রামের যুবক ভিসা প্রসেসিংয়ের নিয়মাবলি সরকারি ওয়েবসাইটে খুঁজে পাচ্ছেন, এগুলো সবই অবাধ তথ্যপ্রবাহের ইতিবাচক উদাহরণ। তবে একই মাধ্যম নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে।
ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন গুজবের কারণে কোনো এলাকায় অস্থিরতা তৈরি হওয়া। অনেক সময় ডেটা গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়ে ব্যক্তিগত তথ্য অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়, যা প্রতারণা বা সাইবার অপরাধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনে। ডিজিটাল বিভাজনও বড় সমস্যা—শহরের তুলনায় গ্রামে ইন্টারনেটের গতি ও ডিভাইসের প্রাপ্যতা কম হওয়ায় তথ্যের সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায় না। তা ছাড়া অনলাইন প্রতারণা, পরিচয় চুরি, কিংবা ফিশিং আক্রমণের মতো সাইবার অপরাধ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তথ্যপ্রবাহের এই দ্বৈত বাস্তবতা স্পষ্ট: তাই এটি উন্নয়নের ইঞ্জিন হতে পারে, আবার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা ছাড়া অস্থিতিশীলতার কারণও হতে পারে।
মৌলিক শিক্ষার সাথে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সংযোগঅবাধ ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ কোনো দেশের জন্য শক্তিশালী সম্পদ হয়ে উঠতে পারে কেবল তখনই, যখন নাগরিকেরা তা সঠিকভাবে ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মৌলিক শিক্ষা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, যদিও দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি; কিন্তু অধিকাংশ ব্যবহারকারী কেবল বিনোদনমূলক কনটেন্ট ভোগ করেন, খুব কম অংশ মানুষ তথ্য বিশ্লেষণ ও যাচাই করে কাজে লাগান। এর অন্যতম কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো ডিজিটাল তথ্য যাচাই, সমালোচনামূলক চিন্তন এবং প্রযুক্তিভিত্তিক সমস্যা সমাধান দক্ষতার অভাব। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় থাকলেও তা প্রায়ই তাত্ত্বিক এবং বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে সংযোগহীন।
উন্নত দেশগুলোতে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ ফিনল্যান্ডে প্রাইমারি থেকেই শিক্ষার্থীদের ‘মিডিয়া লিটারেসি’ শেখায়, যেখানে তারা ভুয়া খবর চেনা, তথ্যের উৎস যাচাই এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করার কৌশল শেখে। কাছাকাছি দেশ সিঙ্গাপুরে মাধ্যমিক স্তর থেকে ছাত্রছাত্রীরা ‘ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং মডিউল’–এর মাধ্যমে অনলাইন কনটেন্ট যাচাইয়ের প্রশিক্ষণ পায়, যা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের সত্যতা নিরূপণে সাহায্য করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রশিক্ষণ এখনো খুবই সীমিত, ফলে সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেটের ভুয়া খবর, গুজব বা অপপ্রচারে অনেকেই সহজে বিভ্রান্ত হন। আবার, কৃষি, স্বাস্থ্য বা ব্যবসাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনেকের নাগালের মধ্যেও থাকলেও ব্যবহারিক দক্ষতার অভাবে তারা তা কাজে লাগাতে পারেন না। সুতরাং অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুফল পেতে হলে বাংলাদেশকে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তিসক্ষম সমালোচনামূলক চিন্তন, তথ্য যাচাই–পদ্ধতি ও সাইবার নিরাপত্তাসচেতনতা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রাসঙ্গিকতাডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ কেবল ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়; বরং একটি দেশের সামাজিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্যপ্রবাহ সমাজে আস্থা ও ঐক্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে (যেমন বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়) দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ ক্ষয়ক্ষতি কমায় এবং উদ্ধার তৎপরতাকে ত্বরান্বিত করে। উন্নত দেশ যেমন জাপান ভূমিকম্পের সময়ও জনগণকে রিয়েল-টাইম সতর্কবার্তা পাঠায়, যার ফলে মানুষের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমে যায়। বাংলাদেশেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মুঠোফোন এসএমএস সতর্কবার্তা চালু হয়েছে, তবে অনেক সময় তা সবার কাছে সময়মতো পৌঁছায় না, বিশেষ করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অনগ্রসর এলাকায়। এ ছাড়া ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক বিভাজন ও সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গুজবের কারণে গণপিটুনি বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা ঘটেছে, যা প্রমাণ করে যে নিরাপদ ও যাচাই করা তথ্যপ্রবাহ না থাকলে সামাজিক স্থিতি নষ্ট হয়।
আবার এখনকার আধুনিক অর্থনীতিও তথ্যের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। উন্নত দেশগুলোতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার বিশ্লেষণ, চাহিদা পূর্বাভাস ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের জন্য বিগ ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার করে।
উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির কৃষি খাত স্যাটেলাইট ইমেজ ও আবহাওয়ার ডেটা বিশ্লেষণ করে উৎপাদন বাড়ায় এবং ক্ষতির আশঙ্কা কমায়। বাংলাদেশেও এ ধরনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যেমন কিছু স্টার্টআপ কৃষকদের বাজারদর ও আবহাওয়ার তথ্য সরবরাহ করছে কিংবা অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবসায়ীদের আর্থিক লেনদেন সহজ করছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রবাহের সীমাবদ্ধতা বা ভুল তথ্যের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি বা রপ্তানি পণ্যের চাহিদা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পেলে উদ্যোক্তারা ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ ছাড়া অনলাইন প্রতারণা ও সাইবার হামলা সরাসরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। উন্নত দেশগুলো যেখানে ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি বা সেন্ট্রালাইজড থ্রেট ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম দ্বারা এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে, বাংলাদেশে এখনো সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে বেশ নাজুক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের সচেতনতা কম।
ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশকে সঠিক ও নিরাপদ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে অবাধ তথ্যপ্রবাহ উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে, অস্থিতিশীলতার নয়।
নীতিগত করণীয়: একজন আইটি–বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকেঅবাধ ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহকে নিরাপদ, কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাখতে হলে সমন্বিত প্রযুক্তিগত, শিক্ষামূলক ও নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, জাতীয় পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রোগ্রাম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা প্রাথমিক শিক্ষায় যুক্ত থাকবে। এতে থাকবে অনলাইনে তথ্য যাচাই, সাইবার নিরাপত্তা, ডেটা গোপনীয়তা ও প্রযুক্তিভিত্তিক সমস্যা সমাধানের বাস্তব প্রশিক্ষণ। দ্বিতীয়ত, ডেটা প্রোটেকশন আইন কার্যকর ও প্রযুক্তি-সহায়কভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ডেটা ব্যবস্থাপনা নীতি আন্তর্জাতিক মান (যেমন জিডিপিআর) অনুসারে তৈরি হতে হবে এবং ডেটা এনক্রিপশন, অ্যাকসেস কন্ট্রোল, ও থ্রেট মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।
এরপর গ্রামাঞ্চলসহ দেশের অনগ্রসর এলাকায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে—যাতে শহর-গ্রামের ডিজিটাল বিভাজন দূর হয়। এর জন্য সাশ্রয়ী স্মার্টফোন ও লো-ডেটা ব্যবহারযোগ্য অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়নকে উৎসাহিত করা খুব জরুরি। তা ছাড়া ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ও এআইভিত্তিক কনটেন্ট মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা ভুয়া খবর দ্রুত শনাক্ত করে সতর্কবার্তা দিতে পারবে। এ কাজে বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানি, গণমাধ্যম ও সরকারি সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। ফাইনালি দেশের সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে, যার মধ্যে জাতীয় সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম, রিয়েল টাইম থ্রেট ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং এবং নাগরিকদের জন্য সহজ অভিযোগ জানানোর প্ল্যাটফর্ম অন্তর্ভুক্ত থাকবে; এবং অবশ্যই নীতি প্রণয়নের সময় প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনপ্রণেতা ও সাধারণ নাগরিকের যৌথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তথ্যপ্রবাহ নিরাপদ থাকার পাশাপাশি সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়।
পরিশেষে পরিপূর্ণ ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি হলো অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ। তবে এই শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে মৌলিক শিক্ষা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে এর সেতুবন্ধ অপরিহার্য। তথ্যপ্রযুক্তির সুফল যেন কেবল শহরকেন্দ্রিক বা শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও যেন সমানভাবে উপকৃত হয়, এটাই হবে নীতিনির্ধারক ও নাগরিক সমাজের মূল চ্যালেঞ্জ। তথ্যকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে তাকে সঠিক, নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় অবাধ তথ্যপ্রবাহ আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য তাই সময় এসেছে একটি ‘ডিজিটাল শিক্ষানিরাপত্তা সংস্কৃতি’ গড়ে তোলা, যেখানে তথ্য হবে উন্নয়নের হাতিয়ার, বিভ্রান্তির নয়।
অধ্যাপক ইকবাল আহমেদ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র ক প রব হ ক ব যবস থ এল ক য় ত ম লক র জন য আম দ র ক ত গত ন র পদ র স ফল সরক র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতির পর্বে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।
চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দপ্তরে প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান মুনির সাতোরি।
মুনির সাতোরি বলেন, ‘আমাদের সফরের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রায় বিস্মৃত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা। রোহিঙ্গা সংকট যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য এটি ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় আবারও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজ নিয়ে মুনির সাতোরি বলেন, ‘এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করেছি।’
প্রতিনিধিদলের সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, যখন বিশ্বে নাটকীয়ভাবে গণতন্ত্র অবনতির পথে, তখন বাংলাদেশ পথ পরিবর্তন করে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রের পথে যাওয়া যায়। তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার। আর এ জন্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা আশা করা জরুরি যে সামনে নির্বাচন হবে এবং তা প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এ জন্য চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইজাবেল বলেন, ‘কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ সংকট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, মিয়ানমার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আর বাংলাদেশও দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের নিজেরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে নেওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমানে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে অবস্থায় রয়েছে।’
প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক অনুদান আসে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে, যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি খুবই নগণ্য, এটি আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বদলে অনেক দূরে থাকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে এর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় অংশগ্রহণকারী হওয়া উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ, বর্তমানে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে দর–কষাকষি করছি।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য ক্যাটারিনা ভিয়েরা বলেন, এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ইতিহাসে দেশটি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি সুযোগ সত্যিকারের অগ্রগতির। শিগগিরই হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবাই নির্বাচনটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে আসেনি, এসেছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকেও, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তারা নিজেদের মধ্যে সংলাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও অনুতাপের বিষয় হচ্ছে ধর্মীয়, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ নেই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজ গঠনে এখানে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
আরকাদিউজ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারে উৎসাহ, যারা সংস্কারে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গঠনমূলক সহযোগিতা করে ইইউ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব যখন গণতন্ত্রের উল্টো পথে যাত্রা করছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশা করার অবকাশ রয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ সামনে দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। এটি এখন নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।’
১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ সংগঠন, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।
এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শন করে।