শ্রীপুরে জুলাই যোদ্ধাদের তালিকায় নাম না থাকায় বঞ্চিতদের মহাসড়ক অব
Published: 10th, August 2025 GMT
গাজীপুরের শ্রীপুরের পল্লীবিদ্যুৎ মোড় এলাকায় জুলাই যোদ্ধাদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির দাবিতে বঞ্চিতরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন।
রবিবার (১০ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলা অবরোধের কারণে মহাসড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি করে, দুর্ভোগে পড়েন কয়েক হাজার যাত্রী।
পরে শ্রীপুর থানা পুলিশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা সমাধানের আশ্বাস দেয়। আশ্বাস পেয়ে আন্দোলনকারীরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
আরো পড়ুন:
শ্রমিকদের সড়ক জিম্মির খেলা বন্ধের আহ্বান যাত্রী কল্যাণ সমিতির
স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের দাবিতে বরিশালের সড়কে জুমার নামাজ আদায়
বিক্ষোভকারীদের একজন নিলয় মৃধা জানান, শ্রীপুরে জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা ত্রুটিপূর্ণভাবে তৈরি হয়েছে। তালিকায় অনেককেই ইচ্ছামতো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অথচ প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের নাম বাদ পড়েছে। পাশাপাশি আন্দোলনে না গিয়েও যাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়েছিলেন, তাদের নামও তালিকায় আছে।
তিনি দাবি করেন, তালিকায় থাকা ৪২ জনের নাম যাচাই-বাছাই করে ভূয়া নাম বাদ দিয়ে প্রকৃত জুলাই যোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহম্মদ আব্দুল বারিক বলেন, “জুলাই যোদ্ধাদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছিল। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও সমাধানের আশ্বাস দেওয়ার পর তারা অবরোধ তুলে নেন। এজন্য যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।”
ঢাকা/রফিক/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অবর ধ অবর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
মধ্যরাতে
‘এক্সকিউজ মি? হাউ মাচ দিস ওয়ান?’
‘ফাইভ রিঙ্গিত অনলি।’
খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই উত্তম, বিদেশ বলে কথা! বিপদে পড়লে অচেনা স্থানে কে এসে সমাধান দেবে? অনীকের বৈশিষ্ট্যও তা–ই। কেনার আগে পণ্যের মূল্য জিজ্ঞেস করে নেওয়া। তাতে শঙ্কা থাকে না। দাম জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। অনীকের কাছে আছে ৩০ রিঙ্গিত। সদ্য মালয়েশিয়াফেরত বান্ধবী ইয়াসমিন রীমা। যাত্রার দুই দিন আগে ওর কাছ থেকে সে রিঙ্গিত নিয়ে এসেছে। বিমানে ওঠার পথের পাশেই সুসজ্জিত হালকা খাবারের দোকান। দোকানের কিশোরকে সে অর্থ পরিশোধ করল। তারপর ওভেনে গরম করা ভেজিটেবল নুডলস ও পানীয়ের বোতলটা নিয়ে খাবার চেয়ারে বসল। টেবিলে রাখা সস খাবারে মিলিয়ে নিল অনীক। খুব খিদে পেয়েছে। ফ্লাইট অবতরণের পরপর ক্ষীণকায়া গৌরবর্ণের তরুণী ক্রু রুটি, সবজি, সেদ্ধ ডিম ও আপেল জুস যা দিয়েছে, তা পরিমাণে কমই ছিল। নির্ঘুম রাতে অনীকের খিদে পায় বেশি। পুরুষদের রিফ্রেশমেন্ট রুম থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধ মনোরম প্যাসেঞ্জার্স লাউঞ্জের আসনে এসে বসল সে। মাঝখানের আসনটি ফাঁকা। সে আসনে আরাম করে বসা মধ্যবয়সী এক থাই নারী বই পড়ছিলেন। অনীকের অ্যাটাচিটা হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে বোর্ডিংয়ের সময় লাগেজ বেল্টে দেওয়া হয়েছে। তাই ভারী বোঝা বহনের ঝামেলা নেই। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করল সে। তারপর বিভিন্ন ফোল্ডারে রাখা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র দেখতে লাগল।
আর ভালো লাগছে না একা একা। কেলিয়ায় আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা। ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর। অফিসের প্রতিনিধি হিসেবে কস্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর এক ওয়ার্কশপে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনীকের একা সফর। কুয়ালালামপুর ট্রানজিট। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসেই সিঙ্গাপুর যেতে হবে।
‘ক্যায়া মে আপকে পাস বেট সাকতা হু?’ সন্ন্যাসিনীর মতো তুষারধবল পোশাকে মধ্যবয়সী একজন নারী অনীককে প্রশ্ন করলেন! ল্যাপটপটার পাওয়ার বন্ধ করতে করতে তাকাল সে। বলল,
‘শিওর, ম্যাম।’
হিন্দি কথা শুনে মনে হলো, ভদ্রমহিলা ভারতীয়। কিন্তু তাঁর চাহনি নিশ্চল। অপলক। বিস্ময়ের ঢেউ ঝাপটা মারে অনীকের চোখমুখে। লজ্জাও পেল সে।
কী মহিলারে বাবা! অনীক লক্ষ করল, সন্ন্যাসিনীর চোখ ভারি সুন্দর। মনে হলো, কী জানি ভাবছেন তাকে নিয়ে। না হলে চোখের মায়াজাল তৈরি করবেন কেন? অতি উৎসাহী হয়ে মহিলা বললেন,
‘আপনি কি বাংলাদেশি, স্যার? কোথায় যাচ্ছেন?’ মহিলার প্রশ্ন শুনে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে অনীক। মহিলা বাংলা বলেছেন স্পষ্ট করে। তাহলে ওনার দেশও কি বাংলাদেশ?
‘ঠিক ধরেছেন, যাচ্ছি সিঙ্গাপুর।’
মহিলার বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠটা চেনা চেনা মনে হলো অনীকের। সাহস হলো না তা বলার। বরং অনীককে হতবাক করে দিয়ে সন্ন্যাসিনী বললেন,
‘বাংলাদেশে আপনার বাড়ি কি কুমিল্লায়?’
এবার আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে অনীক!
অনীকের মুখোমুখি মহিলা। তর্জনী তাক করে বললেন,
‘আপনার নাম পালা? কান্দিরপাড় রামঘাট বাড়ি?’ অনীক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘আপনার নাম কি নন্দা?’
মহিলা অনীকের হাত স্পর্শ করে বললেন,
‘আমায় চিনতে পারলে না পালা?’ হাত ধরল অনীকও!
‘আপনি কি এলেন, না যাচ্ছেন?’
‘আপনি আপনি করছ কেন?’ অনীকের জড়তা ভাঙে এবার। অনুরোধের সুরে বলল,
‘গন্তব্য কোথায় তোমার?’
‘মুম্বাই! এলাম ব্যাংকক থেকে। হোমসের কাজে গিয়েছিলাম।’
‘চলো ওই কফি শপটায় গিয়ে বসি।’ নন্দাকে পালার অনুরোধ।
এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটে করে নন্দা থাইল্যান্ড থেকে ভারত যাচ্ছে। ওরও কুয়ালালামপুর ট্রানজিট। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আড়াই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি তাঁর। নন্দিতা রায়ের এয়ার এশিয়ার একে–১৭৭৮ ফ্লাইটে ওঠার নির্গমন গেট জি–১০। বিমান ছাড়ার মালয়েশিয়ার সময় রাত ২টা ১০ মিনিট। অনীক মুখার্জির মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের এমএইচ–৫৭৮ ফ্লাইটটি সিঙ্গাপুর যাত্রা করবে রাত সাড়ে ৩টায়। অনীক লক্ষ করল, এখন বাজছে রাত ১টা ৫ মিনিট। সামনেই কফি শপ। পালা নন্দাকে নিয়ে ঢুকল সেখানে। দুজনে মুখোমুখি বসে একটি টেবিলে। পেমেন্ট দিয়ে ড্রাই কেক ও কফির অর্ডার দিল নন্দা। ভ্রু কুঁচকে বিস্ময়ের সঙ্গে পালা বলল,
‘তা কত বছর পর দেখা হলো?’
‘৩০ বছর তো হবেই!’
‘স্বামী–সন্তান ঘর–সংসার? জীবন, সুখ ইত্যাদি?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নন্দা! কফির মগের প্রান্তে সে ভারী ঠোঁট স্পর্শ করে। নিশ্চল চোখের পাতা। সরাসরি নিবিড়ভাবে তাকায় পালার চোখে। ভেতরটা ঝড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে নন্দিতার। আড়াই যুগের এ মনোবেদনা। ৩০ বছর ধরে পালার জন্য অনেক প্রশ্ন জমা ছিল নন্দার। ভাবেনি পালার সঙ্গে দেখা হবে কোনো দিন। সে কষ্ট তার ভেতরেই ছিল। আজ এ মুহূর্তে ওর কাঠগড়ায় অনীক! অভিযোগের সুরে অনীকের উদ্দেশে নানা প্রশ্ন।
‘সুখ কাকে বলে? জীবনের সংজ্ঞা তুমি জানো? সুখ মানে কি ভালোবাসায় আকুল কাউকে এড়িয়ে যাওয়া? সারাক্ষণ বইমুখী হয়ে থাকা। সুখ মানে কি শুধুই বিদ্যার ভারবাহী প্রাণী। তুমি তো সুখ বোঝোনি। জীবনের মানে তুমি বুঝতে চেষ্টাও করোনি। একটি মনের অতলে আরেকটি মন থাকে। সেটা হোক মেয়ে কিংবা ছেলে। মন কী চায়, সেটাও জানা প্রয়োজন! তোমার ভালোবাসার মন কখনোই ছিল না।’
বাঁ গালে হাত রেখে অনীক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কফির পেয়ালা থেকে মুখ সরিয়ে নেয় সে। তারপর নন্দিতার উদ্দেশে সে ধীরে ক্ষুদ্র একটি বাক্য নিক্ষেপ করে।
‘তুমি কি সত্যি আমায় পছন্দ করতে?’
‘বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের সেই সময়গুলো কি মিথ্যে? রবীন্দ্র, নজরুল ও সুকান্তজয়ন্তীতে আমার নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান? মনে পড়ে, তোমাকে দেখার অজুহাতে আমার বান্ধবী; অর্থাৎ তোমার ছোট বোন অনিন্দিতার কাছে কত্ত গিয়েছি, রামঘাটের পাড়েই আমাদের বাসা। পাশেই লাগোয়া। তোমাদেরও ছিল টিনের ঘর।’
অনীকের এখন সব মনে পড়ছে। গানবাজনায় বেশ পারদর্শী ছিল নন্দিতা। ওর প্রায় অনুষ্ঠানেই ছোট বোন অনুর সঙ্গে সে টাউন হলে যেত।
তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। বৈশাখী ঝড়ের আগে সে বিকেলে বসে অঙ্ক করছিল পালা। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আরেক ঘরে সবাই। একটা কাগজের ওপর লাল রং আঁকা গোলাপ ফুল ও গাছ। ফুলের পাশে ইংরেজি বর্ণমালা ‘এন’ আর গাছের সঙ্গে ‘পি’! আঁকা সে টুকরা কাগজটা কে যেন জানালা দিয়ে ছুড়ে পালাল। ওটা এসে পড়ল পালার কোলের ওপর। বৃষ্টি থামার পর হারিকেনের আলোতে মোড়ানো কাগজটা খুলে পালা বুঝতে পারেনি এটা কার কাণ্ড, অনু মানে অনিন্দিতাকে পালা জিজ্ঞাসাও করেছিল। অনু পালাকে বলেছিল, ‘তুই কিছু বুঝিসনি ছোড়দা?’ নন্দা অনুর কাছে প্রায়ই আসত। ছোট বোনের সঙ্গে প্রায় সব বিষয়েই কথা বলত পালা। পড়াশোনা, টিউশনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবত না সে। অনু প্রায়ই নন্দার নানা গল্প করত ছোড়দার কাছে। পালাদের টিনের পাঁচিলে বিভিন্ন স্থানে খড়িমাটির সাদা চকে লেখা ‘এন’ যোগ ‘পি’! তা দেখিয়ে অনু বলত, ‘ছোড়দা, এর অর্থ জানিস?’ বোকার মতো পালার উত্তর, ‘না রে।’ অনু রেগে পালাকে বলেছিল, ‘তুই আসলেই একটা হাঁদারাম।’
পরে অনুকে সঙ্গে নিয়ে নন্দা একদিন দুপুরে পালার কাছে আসে! পালার থেকে দুই বছরের ছোট। অনু ও নন্দা সহপাঠী! পড়ামগ্ন পালাকে বলে তোমার সঙ্গে কথা আছে। পাশে দাঁড়ানো অনু তখন মিটিমিটি হাসছিল।
পালার অনাগ্রহ বুঝতে পেরে নন্দা ওদের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। অনু পরে জানিয়েছিল, ওকে লেখা নন্দার চিঠিটির কথা। কিন্তু বিষয়টি তখন গায়েই মাখেনি পালা। জিলা স্কুল থেকে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা কলেজে এসে ভর্তি হয় পালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অনার্সে ভর্তি হয়ে বাড়িতে যায় অনীক। অনুর কাছে জানতে পারে, নন্দিতাদের পুরো পরিবার চলে গেছে নেপাল। ওর বাবার কর্মস্থল কাঠমান্ডু।
পালার মগের মধ্যে কফির অবশিষ্ট ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওর কেকের বাকি অংশটুকু নন্দার সামনে ঠেলে দেয় সে।
‘নষ্ট কোরো না, নাও! তোমার প্রস্তাব আমাকে সরাসরি বলতে?’
‘অনেকবার চেষ্টা করেছি তা বলার! তুমি আমলই দাওনি। চিঠিও দিয়েছি একাধিকবার। তোমাকে লেখা আমার সর্বশেষ চিরকুটটা তুমি দেখোনি বলে অনু আমাকে তা ফেরত দিয়েছিল! আজও সেই স্মৃতিচিহ্ন রেখে দিয়েছি! প্রমাণগুলো বয়ে যাচ্ছি অনন্তকালের গন্তব্যে। জানি, এর কোনো সুখ–ঠিকানা নেই।’ চোখ ছলছল নন্দিতা রায় ওর পার্সটা টেনে নেয় ওর তুফান–বিধ্বস্ত বুকে! কম্পিত হাত! তা ঢুকিয়ে বের করে আনে পালার একটি রঙিন ছবি আর একটি চিঠি।
‘এই দেখো! সুদর্শন এই তরুণকে চেনো?’
হকচকিত হয়ে যায় পালা! ছবিটা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে!
‘আরে, এইটা তো আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফরম ফিলাপের আগে তোলা ছবি! তুমি পেলে কোথায়?’
‘মনোহরপুর আজহার স্টুডিও থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। তোমার ছবিটি দীর্ঘদিন সেই দোতলার স্টুডিওতে বাঁধাই করা কাচের ফ্রেমে টাঙানো ছিল। আমি ছবিটা ওয়াশ করে নিয়েছিলাম।’
বুকপকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে পরে নিল অনীক। চিঠির সাদা রংটি ধূসর হয়ে গেছে! হালকা হলুদ রঙের দিকে যাচ্ছে স্মৃতিবাহী লিপিটা। কালিতে আঙুলের স্পর্শে লেখা শব্দগুলো মলিন। অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। হৃদয়ঘাতকের আঘাতে নন্দিতা রায়ের বিক্ষত মৃত মনের মতো এ চিরকুট একদিন নষ্ট হয়ে যাবে। এসব ভাবতে লাগল অনীক। হাত দিয়ে চোখ মুছতে লাগল সে। দেখল, কাগজের মাঝখানে মাত্র দুটি বাক্য লেখা। চিঠির পুরো সম্বোধন নেই! শুধু ‘পি’ বলে আহ্বান, সমাপ্ত ‘এন’ দিয়ে। ‘তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটি নীড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর আমি। অপেক্ষায় থাকব শেষনিশ্বাস অবধি।’ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে অনীক। চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মোছে সে আবার। চিঠিটা অনীকের কাছ থেকে নিয়ে নন্দিতা তা পার্সে রাখে। অপরাধীর মতো নতমুখে অনীক বলে,
‘আমায় ক্ষমা করে দিয়ো নন্দিতা! জীবন–সংসারে এক ব্যর্থ পুরুষ আমি।’
নন্দিতা কৌতূহলী মন নিয়ে অনীকের মুখের দিকে তাকায়।
‘তোমার কয় ছেলেমেয়ে? গিন্নি?’
‘দুই ছেলে, এক মেয়ে। ওরা একজন অস্ট্রেলিয়া ও দুজন কানাডায় বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করছে। স্ত্রী চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। তোমার তো কিছুই জানা হলো না।’
‘আমার ছেলেমেয়ে অনেক! সহস্রাধিক। ওরা এখন মুম্বাইয়ে মাহের অনাথ হোমসে আছে। ওদের সঙ্গে থাকি আমি দুই যুগ ধরে।’
‘বাট ইয়োর হাজব্যান্ড? ওয়াটস হি?’
‘হিজ নেম ইজ পি। লিভস ইন দ্য হেভেন ডার্ক। মাই লেটার্স রেসিপ্যান্ট। হুইচ লেটার আই হ্যাভ বিন ক্যারিং অল দ্য টাইম, স্যার।’
নন্দিতা রায় উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে হেঁটে যায় ১০ নম্বর ডেপারচার প্যাসেজের সামনে। পেছনে অনীক। পাশের যাত্রীর লাউঞ্জের আসনে বসে ওরা। মুম্বাইয়ে ফ্লাইটের জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের চেকিং শুরু হবে। অনীক নন্দিতার কাছ থেকে ওর যোগাযোগ নম্বর ও ঠিকানা চেয়ে নেয়। আর ওর অফিসের নেম কার্ড ওর হাতে গুঁজে দেয়। তারপর ক্লোজ হয়ে অনীক ওর আইফোন সেটে কয়েকটা সেলফি তুলে রাখে।
‘আসি তাহলে! এসো আমাদের মাহের আশ্রমে।’
‘তোমার আর কিছুই বলার নেই নন্দা?’
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর স্নাতক নন্দিতা রায় বলে ওঠে,
‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে! সূর্য অস্তাচলে।’ সুললিত কণ্ঠে আবৃত্তির ঢঙে বলে,
‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস—/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!’
নন্দিতার নরম হাতটা আবারও স্পর্শ করল অনীক!
‘গুডবাই!’ চশমা খুলে চোখের জল মোছে সে। পেছন দিকে তাকাচ্ছিল নন্দিতা। দূর থেকে লক্ষ করল ওর পদযাত্রার গতিটা! নন্দিতা রায়ের ছায়াটাও যাত্রীদের ভিড়ে একসময় মিলিয়ে যায়।