এই লেখাটির পটভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুরের ‘ওবিই শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়, সমাধান কী’—এই শিরোনামে ৬ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত সম্পাদকীয় কলাম। বলতে পারেন, নিচের লেখাটি ওই কলামটির একটি প্রতিক্রিয়া।
তারিক মনজুর প্রথম আলোর নিয়মিত লেখক। বস্তুতপক্ষে ওবিই-এর মতো সফল একটি শিক্ষা কৌশলকে যখন লেখক ‘স্থগিত’ করে দিতে বলেন , তখন আশা করব বিপরীত দিক থেকে দেখা আমার এই পর্যালোচনাটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত নেবার ভারটুকু পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে।
অধ্যাপক মনজুর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশ কিছু বছর ধরে চলমান ওবিই শিক্ষাক্রমের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সুপারিশ করেছেন, এই কার্যক্রম ‘স্থগিত’ করে দেওয়ার! কারণ হিসেবে উনি কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
প্রথমত, তিনি বলেছেন ‘শিক্ষার একেকটি স্তরে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা’ প্রয়োজন এবং তিনি বলার চেষ্টা করছেন ওবিই-তে সেটা নেই। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, ওবিই শিক্ষাক্রমটি তৈরি করা হয়েছে এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। মানে হলো, ওবিই–র দার্শনিক ভিত্তি কী, সেটা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করেই হয়তো তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
আরও পড়ুনওবিই শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়, সমাধান কী০৬ আগস্ট ২০২৫প্রথমেই বলে নিই, ওবিই হলো এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার কৌশল, যেখানে বিষয়বস্তুর চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেই বিষয়বস্তু থেকে একজন শিক্ষার্থী কী কী দক্ষতা অর্জন করবে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে এবং সেই দক্ষতা অর্জনের পদ্ধতি কী কী উপায়ে মূল্যায়িত হবে। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা প্রোগ্রামগুলো ওবিই কিংবা সমমানের মানদণ্ড অনুসরণ করে থাকে।
এখনকার যুগে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্ট্রাকচারড বা কাঠামোবদ্ধ। ওবিই–পূর্ববর্তী যুগে শিক্ষক ক্লাসে যেতেন কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে। কিন্তু ওবিই–পরবর্তী যুগে শিক্ষককে ক্লাসে যেতে হয় কোনো একটি লক্ষ্য বা ফলাফল অর্জনের উদ্দেশ্যে। ওই নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য উপযোগী বিষয়বস্তু ও শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্বাচন করতে হয়। ধরুন, আপনার যদি উদ্দেশ্য হয় শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারছে কি না, সে ক্ষেত্রে আপনার পড়ানোর পদ্ধতি লেকচার বা বক্তব্যের পরিবর্তে দলগত কাজ বা গ্রুপ ওয়ার্ক নির্ধারণ করতে হবে। আর শিক্ষার্থী সেই দক্ষতা অর্জন করতে পারল কি না, সে অনুযায়ী মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, উপরিউক্ত ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ক্লাস পর্যবেক্ষণ বা অবজারভেশন অথবা সহপাঠী মূল্যায়ন (পিয়ার অ্যাসেসমেন্ট) পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষকের এই প্রতিদিনের স্বপ্নপূরণের সামষ্টিক রূপ হলো একটি কোর্সের সামগ্রিক উদ্দেশ্য পূরণ। সুতরাং ওবিই পদ্ধতিতে প্রধানতম উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীকে একটি বিষয় পড়ানোর নয় বরং তাকে একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দক্ষতাগুলো একজন শিক্ষক কীভাবে বুঝতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সুপারিশ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প সংযোগ রক্ষা করা, উদ্যোক্তা ও চাকরিক্ষেত্রে কী ধরনের দক্ষতা দরকার, সেই অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। মনে রাখা দরকার, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা একটি পরিবর্তনশীল বিষয়। সুতরাং শিক্ষার বিষয়বস্তুও সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যদিও অনেক শিক্ষাবিদ ‘বাজারমুখী’ শিক্ষাকে কটাক্ষ বা সমালোচনা করে থাকেন। আমরা বাজারমুখী নয় এমন বিষয়ে পড়াশোনাকে নিরুৎসাহিত করছি না; কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, যদি সেই বিষয় পড়ে শিক্ষার্থী কোনো দক্ষতা অর্জন করতে না পারে কিংবা স্বাবলম্বী হতে না পারে, তাহলে এত সময় ও অর্থ ব্যয় করে ওই শিক্ষার্থীর ডিগ্রি অর্জন করার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না।
ওবিই-তে এই সমস্যার একটা ভালো সমাধান রয়েছে। ওবিই-ভিত্তিক প্রোগ্রামে একজন শিক্ষার্থীকে নিজ ডিসিপ্লিনের প্রধান কোর্সগুলোর বাইরে ‘সাধারণ শিক্ষা উন্নয়ন’ (জিইডি) কোর্স নিতে উৎসাহিত করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক মৌলিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাকে মানবিক গুণনির্ভর এবং তার প্রায়োগিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, সর্বোপরি তার সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট করা।
আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থী যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর, অন্য কোনো বিষয়ে কাজ করতে চায়, সেই পথ উন্মুক্ত করা। বর্তমানে কর্মসংস্থানের চাহিদা ও সুযোগ বিবেচনায় এ ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য অনস্বীকার্য। ওবিই প্রকৃতপক্ষে শুধু শিক্ষক নন, বরং একজন শিক্ষার্থীকে জানার সুযোগ দেয় কোন বিষয়বস্তু পড়ানো হবে, কীভাবে পড়ানো হবে এবং তার মাধ্যমে কী লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং মূল্যায়নের প্রশ্নে শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের প্রত্যাশা কী। সুতরাং ওবিই শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই শিক্ষণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, উনি বলেছেন, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও মূল্যায়নের পদ্ধতি উল্লেখ করতে। মজার ব্যাপার, ওবিই-র একটা বড় বিষয় হলো শিক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির যৌক্তিককরণ। তার অর্থ দাঁড়ায় উনি প্রধানত ওবিই-র সমালোচনা করতে গিয়ে ওবিই-কেই সুপারিশ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগটি তিনি যা করেছেন, তা অনেকাংশে বাস্তব। উনি বলেছেন, ওবিই শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছে, সিলেবাস পরিবর্তন ঘটায়নি! এটি একটি সত্য বাচন, প্রায় বিশ্ববিদ্যালয় ও তার প্রোগ্রামগুলোর জন্য এটি সত্য। কিন্তু এর জন্য ওবিই পদ্ধতিকে দোষারোপ করাটা সমীচীন কি না ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, সিলেবাস তৈরি করার কাজ ওবিই–র নয়। এটির কাজ সংশ্লিষ্ট বিভাগের এবং তা করতে হবে বিভাগের একাডেমিক কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ম মেনে।
ওবিই আপনাকে বলে দেবে সেই সিলেবাস কীভাবে কাঠামোবদ্ধ করতে হবে, আপনার শিক্ষণ উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে এবং কী পদ্ধতিতে আপনি তা মূল্যায়ন করবেন। অর্থ দাঁড়ায়, একজন শিক্ষক হিসেবে আপনাকেই ঠিক করতে হবে এই পদ্ধতি আপনি কীভাবে কাজে লাগাতে চান। সুতরাং ওবিই-কে লেখকের কথামতো শুধু একটা ‘টেমপ্লেট’ ভাবলে আপনি ভুল করবেন। আবার নিজের কাজ ওবিই-র ওপর চাপিয়ে দিলে ভুল করবেন।
ওবিই সঠিকভাবে প্রয়োগের দিকটা হলো, পাঠ্যক্রম তৈরির পূর্বে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষার্থীর দক্ষতাসংশ্লিষ্ট বিষয়টি ও কর্মবাজারের প্রয়োজনীয়তা গবেষণার মাধ্যমে বের করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান এত কোর্স ও তার সিলেবাস রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই নতুন একটি কোর্স ডিজাইন ও প্রণয়নে যত সহজে ওবিই প্রয়োগ করা সম্ভব, চলমান কোর্সের ক্ষেত্রে সেটা একটু ব্যতিক্রম বৈকি।
এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিয়োজনের প্রয়োজন হতে পারে। প্রক্রিয়াটির জটিলতা হেতু অনেক শিক্ষক চলমান কোর্সের কাঠামোটি শুধু পরিবর্তন করে ফেলেন; কিন্তু বিষয়বস্তু ও প্রায়োগিক পদ্ধতির বাস্তবিক পরিবর্তন করেন না। সুতরাং সে ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে ওবিই পদ্ধতির পরিবর্তনগুলো অনেকের কাছে তেমন স্পষ্ট হয় না, যেমনটা আমি ধারণা করি অধ্যাপক মনজুরের কাছেও হয়েছে। ওবিই–র প্রায়োগিক ব্যবহারে দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ও মানসিকতার বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে জড়িত।
চতুর্থত, উনি বলেছেন, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এটা বোঝেন না। যদি না বোঝেন, তার দায় কি এই পদ্ধতির নাকি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের? যেমন আমি কোয়ান্টাম মেকানিকস বুঝি না। তার মানে কি আমি বলব, কোয়ান্টাম মেকানিকস ভুল!!
প্রকৃতপক্ষে ওবিই প্রচলনের দিক থেকে আমরা অনেক নতুন। মোটামুটি ২০০৯-২০১০ সালের দিক থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের পর থেকে এর সম্প্রসারণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রোগ্রাম ওবিই-ভিত্তিক পাঠদান চালু করেছে। স্বাভাবিকভাবেই ওবিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্র্যাডিশনাল পাঠদান প্রক্রিয়ায় একটি বিকল্প (ডিসরাপটিভ) কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে অভ্যস্ত কারও জন্য নতুন পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়, শ্রম, অর্থ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনীহা বা বিরোধিতাও থাকতে পারে। কিন্তু যখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের লক্ষ্য বৈশ্বিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা, সে ক্ষেত্রে ওবিই পদ্ধতি স্থগিত বা তার অগ্রযাত্রা রদ করা কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে তা ভেবে দেখতে হবে বৈকি।
তাই গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতি থেকে ওবিই–ভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা শিক্ষকের মানসিকতা, আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও যথোপযুক্ত জ্ঞানের ঘাটতি, প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা। তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেক শিক্ষক বেশ কিছু প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরও, নিজ ক্লাসে তার প্রয়োগ করেন না, এমনকি প্রশ্নপত্র প্রণয়নে ওবিই মূলনীতি প্রয়োগ করেন না। সুতরাং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সমন্বিত আগ্রহ ও অঙ্গীকার ব্যতীত এ দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে অধ্যাপক মনজুর যে বিষয়গুলো সুপারিশ করেছেন, তা ইতিমধ্যেই ওবিই আউটকাম বেইজড কারিকুলামে লিপিবদ্ধ করা আছে। সুতরাং সারা বিশ্বব্যাপী চলমান এই পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যতটুকু সফলতা অর্জন হয়েছে তাকে বন্ধ না করে, অধিকতর উন্নয়ন কীভাবে করা সম্ভব সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। না হলে, এটা অনেকটা পেছনের দিকে হাঁটার মতো অবস্থা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও তার প্রোগ্রামগুলো যদি এই কাঠামো মেনে চলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের চলতে সমস্যা কোথায়? তা ছাড়া সিলেবাস পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাজার চাহিদা, গ্র্যাজুয়েট প্রোফাইল অনুযায়ী তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে হতে পারে; কিন্তু সে ব্যাপারে প্রধানতম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের। উপরন্তু প্রতিটি কোর্স একইভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, ব্যাপারটি এ রকম নয়। কোর্সের উদ্দেশ্য আর তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে আউটকাম এবং মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়ে থাকে।
ওবিই সেই উদ্দেশ্য পূরণে আপনাকে সহায়তা করে।
অধ্যাপক মো.
মাহবুবুল আলম
কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ এবং অতিরিক্ত পরিচালক, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স সেল (আইকিউএসি) শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একজন শ ক ষ ব ষয়বস ত প রক র য় র সমস য ক মনজ র র জন য লক ষ য অন য য় কর ছ ন বল ছ ন ন করত চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
সংবেদনশীল না হলে কেউ ভালো শিল্পী হতে পারে না: জুয়েল আইচ
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো ‘লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় একাদশতম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘শিল্প, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতার সংমিশ্রণে গঠিত এক অনন্য লিগ্যাসি’।
‘মানুষ তার আশার সমান সুন্দর, বিশ্বাসের সমান বড় এবং কাজের সমান সফল। কাজই মুক্তি। তবে আশাও বড় রাখতে হবে। আশা না থাকলে কাজ হবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেন জুয়েল আইচ। পডকাস্ট শোর এ পর্ব প্রচারিত হয় গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে প্রথম যেদিন জাদু দেখালেন, সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সব বাদ দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিই। আমরাই খুব সম্ভবত প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করি। আমি শৈশব থেকেই জাদু দেখাই। তবে মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে জাদু দেখানোর সেই অনুভূতিটি ছিল একেবারেই ম্যাজিক্যাল।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, শিল্পকে সাহস করে অস্ত্রতে পরিণত করার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এটা আত্মবিশ্বাস নয়। আমি অসম্মান সহ্য করতে পারি না। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছিলাম, তারা (পাকিস্তান) আমাদের বিভিন্নভাবে অসম্মান করে আসছে। কখনো গানে, কখনো ছবি এঁকে কিংবা কবিতার ভাষায় আমরা সব সময় এর প্রতিবাদ করে এসেছি। এভাবে করেই শেষ পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেমে গেলাম।’
জুয়েল আইচকে কেউ বলেন ম্যাজিশিয়ান, আবার কেউ বলেন মিউজিশিয়ান। তবে জুয়েল আইচ একজন দার্শনিকও বটে। জাদুর মোহনীয়তা আর বাস্তবতার যে রূঢ় চিত্র—এই দুটো আপনার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘বাস্তবতাকে আমরা বলে থাকি “কঠিন” আর স্বপ্ন তো আমরা আকাশসমান ভাবতে পারি। একদম রংধনুর মতো সাত রং। এই দুটোকে যদি কেউ আয়ত্ত না করতে পারে, তবে তার জীবন কিন্তু সেখানেই শেষ। সে বেঁচে থাকবে কিন্তু মরার মতো।’ তিনি বলেন, ‘সে জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দরকার। যেমন আপনি কোনোভাবেই আমাকে দুঃখী বানাতে পারবেন না। আমি দুঃখ পাই না, তবে বারবার আমাকে খ্যাপাতে থাকলে আমি রুখে দাঁড়াই।’
জুয়েল আইচ কখনোই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া স্টেজে ওঠেন না। সঞ্চালক জানতে চান, এর পেছনে কারণ কী?
জুয়েল আইচ বলেন, প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ সুন্দরমতো হয় না। প্রস্তুতি ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেগুলো অনেক নিম্নমানের হবে। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বাঁশি দিয়ে সব রাগ বাজাতে পারি। এটা কি এক দিনেই সম্ভব!’
আপনার পারফরম্যান্সের সময় আপনি মাঝেমধ্যে নিঃশব্দ হয়ে যান। যেখানে কোনো উদ্যম নেই। এই ‘সাইলেন্স’-এর কারণটা কী?
সঞ্চালক জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, শব্দের চেয়ে নিঃশব্দের ভাষা বেশি গভীর। একটি পেইন্টিং, যেখানে কোনো শব্দ থাকে না কিন্তু কত কিছু বলে দেয়! দেখবেন কেউ অনেক খেপে গেলে নীরব হয়ে যায়। আসলে শব্দে যা বলা যায়, নিঃশব্দে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব।
বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে সবকিছুই হাতের নাগালে, এমনকি জাদুও। জাদু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসার পর এর আবেদন কিছুটা কমে যাচ্ছে কি না? জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, খালি চোখে দেখলে তা আসলেই কমে যাচ্ছে। কারণ, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে যে জাদুগুলো দেখানো হচ্ছে, তা দেখে মানুষ বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘তারা ভাবছে, আমরা আগে যেসব জাদু দেখেছি, এগুলো তো তার থেকেও বিস্ময়কর। কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারছে না, এখন সবকিছুর সঙ্গে মিশে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’
সঞ্চালক এরপর প্রশ্ন করেন, আপনি একসময় ‘পালস স্টপিং’ ধরনের ইলিউশন বন্ধ করেছিলেন। এর পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এই পালস স্টপিংয়ের মাধ্যমে আমি পুরো দেশজুড়ে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলাম। দলে দলে মানুষ এটি দেখতে আসত। কিন্তু এসব দেখে মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কিত হতো, অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ত। একবার একজন অনেক বড় পালোয়ান এটি দেখতে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সেদিন শো শেষ করেই আমি আমার টিমকে বলি, এই ম্যাজিক আর হবে না। কারণ, এই ম্যাজিক এত এত মানুষকে ডেকে আনছে বটে কিন্তু এটি মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে। যা মোটেও ঠিক নয়।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, তাহলে কি একজন শিল্পীকে সংবেদনশীলও হতে হয়?
‘অবশ্যই।’ জুয়েল আইচ বলেন, একজন শিল্পীকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। সংবেদনশীল না হলে তিনি ভালো শিল্পী হতে পারবেন না।
আপনি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সামনে পারফর্ম করেছেন, তেমনি এমন শিশুদের জন্যও জাদু দেখিয়েছেন, যারা কখনো টিকিট কিনে শো দেখতে পারে না। আপনার চোখে আসল মর্যাদা কোথায়—বৃহৎ মঞ্চে, নাকি একটিমাত্র বিস্মিত মুখে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল আইচ বলেন, ‘আসলে মঞ্চ ব্যাপার নয়। আমি আমার জাদুতে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে থাকা দেখতে ভালোবাসি। শুধু বিস্ময় নয়, বিস্ময়ের সঙ্গে মুগ্ধতা আমার ভালো লাগে।’
আরও পড়ুননীতি আর মূল্যবোধ শক্ত থাকলে কেউ থামাতে পারবে না: রুবাবা দৌলা১২ অক্টোবর ২০২৫পডকাস্টের শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক জানতে চান, আমরা আরেকজন জুয়েল আইচ কবে পাব?
মুচকি হেসে জুয়েল আইচ বলেন, ‘যখন সেই উদ্যম নিয়ে কেউ কাজ করবে, ঠিক তখন। সে হয়তো আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ম্যাজিকে নয়, সব দিক দিয়েই।’
আরও পড়ুনবাবা প্রথমে আমাকে অফিস সহকারীর কাজ দিয়েছিলেন: হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান০৫ অক্টোবর ২০২৫