ভি এস নাইপলের জীবনবোধ ও মৃত্যুচিন্তা
Published: 11th, August 2025 GMT
দুটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ৫ হাজার ১৮০ বর্গ কিলোমিটারের ক্ষুদ্র এক দেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগো। আয়তনে ক্ষুদ্র এই দেশেরই এক বড় মাপের লেখক ভি এস নাইপল। ২০০১ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য যিনি নোবেল পুরস্কার পান এবং পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের কাছে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ভি এস নাইপলের বেশ কিছু উপন্যাস।
ভি এস নাইপলের উপন্যাসগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলায় অনূদিত হয়েছিল ‘আ হাউজ ফর মি.
২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিটারেরি ফেস্টিভ্যালে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ভগ্ন ও রুগ্ন স্বাস্থ্যের বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল যাঁকে সংক্ষেপে সবাই চেনে ‘ভি এস নাইপল’ নামে। মঞ্চে তিনি হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন, পাশে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া সাংবাদিক নাদিরা খানম আলভি। সেদিন সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে। এর কিছুদিন পরই ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই প্রখর জীবনবোধসম্পন্ন শক্তিশালী লেখক।
নাইপলের সাহিত্যকর্মে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট মিলে গড়ে উঠেছে এক স্বতন্ত্র সৃজনভুবন। তাঁর লেখা উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ও প্রবন্ধে প্রায়ই দেখা যায় মানুষ ও সংস্কৃতির সংঘাত, পরিচয়ের সন্ধান এবং ঔপনিবেশিক অতীতের ছায়া।ত্রিনিদাদে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ লেখক ভি এস নাইপলের পিতা সিপারসাদ নাইপল ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ত্রিনিদাদ ও টোবাগো একসময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল। তাই নাইপল তাঁর সাহিত্যজীবনে ঔপনিবেশিক ইতিহাস, অভিবাসী জীবনের জটিলতা ও মানুষের অস্তিত্বগত সংকটকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য হলো সুনির্দিষ্ট ভাষা, মিতব্যয়ী বর্ণনা এবং এক গভীর বাস্তববোধ, যা পাঠককে একদিকে মুগ্ধ করে, অন্যদিকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যায় ভাবনার গভীর অলিন্দে।
নাইপলের সাহিত্যকর্মে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট মিলে গড়ে উঠেছে এক স্বতন্ত্র সৃজনভুবন। তাঁর লেখা উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ও প্রবন্ধে প্রায়ই দেখা যায় মানুষ ও সংস্কৃতির সংঘাত, পরিচয়ের সন্ধান এবং ঔপনিবেশিক অতীতের ছায়া।
‘দ্য এনিগমা অব অ্যারাইভাল’ নাইপলের সাহিত্যজীবনের একটি অনন্য মাইলফলক। এটি মূলত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেখানে লেখক তাঁর ইংল্যান্ডে বসবাসের অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার যাত্রা তুলে ধরেছেন। এখানে প্রকৃতি, সময়ের প্রবাহ ও পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি এত সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে যে এটি কেবল লেখকের ব্যক্তিগত কাহিনি নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রা ও মানসিক অভিযাত্রার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। উপন্যাসটি যেন পাঠককে আমন্ত্রণ জানায় নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করতে।
নাইপলের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর নিরপেক্ষ ও নির্মম সত্যবাদিতা। বাস্তবতা, মানুষের জীবনসংগ্রাম ও জীবনের নানা দ্বন্দ্বকে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন নির্মোহ ও স্পষ্টভাবে। সমাজের জটিলতা, ক্ষমতার অসমতা ও মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে তিনি কখনোই আড়াল করেননি।নাইপলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর নিরপেক্ষ ও নির্মম সত্যবাদিতা। বাস্তবতা, মানুষের জীবনসংগ্রাম ও জীবনের নানা দ্বন্দ্বকে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন নির্মোহ ও স্পষ্টভাবে। সমাজের জটিলতা, ক্ষমতার অসমতা ও মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে তিনি কখনোই আড়াল করেননি। তাঁর গদ্যে ব্যক্তিগত আবেগ ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির এমন এক মিশ্রণ রয়েছে যা একদিকে সাহিত্যিক শৈলীকে সমৃদ্ধ করে, অন্যদিকে পাঠককে ঠেলে দেয় গভীর আত্মসমালোচনার দিকে।
২০০১ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে নাইপল বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থান আরও দৃঢ় করেন। নোবেল কমিটি তাঁকে ‘অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা ও নির্ভুল বর্ণনাভঙ্গির এক অবিস্মরণীয় শিল্পী’ বলে অভিহিত করে। সত্যিই, তাঁর রচনার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই এক দীর্ঘ যাত্রা—ত্রিনিদাদ থেকে ব্রিটিশ সাহিত্যজগৎ, ব্যক্তিগত অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ।
ভি এস নাইপলের সাহিত্য আমাদের শিখিয়ে দেয় যে জীবন সব সময় সরল পথে চলে না। পরিবর্তন, হারিয়ে যাওয়া, নতুন করে শুরু করা—এসবই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমনটা দেখা যায় ‘দ্য এনিগমা অব অ্যারাইভাল’-এ, ঠিক তেমনি প্রতিটি আগমন আসলে একটি নতুন যাত্রার সূচনা ঘটায় শেষ পর্যন্ত। তাঁর লেখা পাঠককে শুধু গল্পের ভেতর ভ্রমণই করায় না, বরং নিজের জীবনকেও নতুনভাবে দেখার আহ্বান জানায়।
২০১৮ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন এই অসাধারণ গুণী লেখক। কেমন ছিল ভি এস নাইপলের মৃত্যুবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি? তাঁর লেখা ও ব্যক্তিগত প্রতিফলনে স্পষ্ট ছিল মৃত্যু নিয়ে তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি। ছিল গভীর আত্মসমালোচনা এবং মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতাকে মেনে নেওয়ার এক পরিপূর্ণ উপলব্ধি। বিশেষ করে জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি মৃত্যুর ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে লড়াই করেছেন; তাঁর ভেতরে জন্ম নিয়েছে একধরনের বিষণ্নতা এবং মৃত্যুচেতনার তীব্রতা। তাঁর রচনায় ইঙ্গিত মেলে, মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে সরাসরি মুখোমুখি হওয়াই জীবনে অধিক অর্থ খুঁজে পাওয়ার পথ হতে পারে, যা মানুষকে আরও পূর্ণ ও নৈতিকভাবে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করে।
অসুস্থতার একটি সময় পার করার পর নাইপলের লেখায় এক স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি ক্রমেই মৃত্যুর অনিবার্যতা ও সমাপ্তির দিকে বেশি মনোনিবেশ করতে শুরু করেন। এটি কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধাবন ছিল না, বরং গভীর এক বিষণ্ন অনুভূতি যা তাঁর দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল।
তবে মৃত্যুভয়ের কাছে নতি স্বীকার না করে নাইপল বরং মৃত্যুর প্রতি একটি সক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, জাগতিক ক্ষয়ক্ষতি মানুষকে উত্তরাধিকার রেখে যেতে অনুপ্রাণিত করে এবং শোকও মানবজীবনের এক অমূল্য সম্পদ, যেটার জন্য এর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করা উচিত মানুষের; এমনটাই মনে করতেন তিনি।
নাইপলের কাছে মৃত্যুচিন্তা কোনো হতাশার কারণ নয়; বরং এটি সাহসী ও নৈতিকভাবে বেঁচে থাকার এক প্রেরণা। তাঁর দৃষ্টিতে, এটি বর্তমান মুহূর্তকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানোর জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে। তিনি মনে করিয়ে দেন যে মৃত্যুর সময় অনিশ্চিত; তাই লক্ষ্যপূরণের প্রচেষ্টা এখনই শুরু করা উচিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বাঁচা জরুরি। কারণ, ভবিষ্যতে যে আপনি দ্বিতীয় সুযোগ পাবেন, সেটা কিন্তু নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।
নাইপলের লেখায় মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ ও আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্বও উঠে আসে। তিনি দেখিয়েছেন, এই সব কর্মকাণ্ড আমাদের প্রয়াত মানুষদের সঙ্গে এক অদৃশ্য সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং কেবল মৃত্যুই মানুষকে বিস্মৃত হতে দেয় না।
নাইপলের রচনায় প্রায়ই আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে মিশে যায়। নাইপলের মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা আসলে জীবনের প্রতিই এক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন যেখানে তিনি আহ্বান জানান পূর্ণভাবে, নৈতিকভাবে এবং জীবনের সীমানা সম্পর্কে সচেতন থেকে বেঁচে থাকতে; সর্বোপরি এই জীবনকে এগিয়ে নিতে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ইপল র স হ ত য ঔপন ব শ ক উপন য স জ বন র র ভ তর প ঠকক
এছাড়াও পড়ুন:
ডিমে শিশুর অ্যালার্জি কেন হয়, কীভাবে বুঝবেন, সমাধান কী
কেন হয়
শিশুদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা পুরোপুরি গড়ে না ওঠায় অনেক সময় ডিমের প্রোটিনকে শরীর ‘অচেনা’ বা ক্ষতিকর হিসেবে ভুলভাবে শনাক্ত করে। ফলে ঠিক যেভাবে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করে, একই ধরনের প্রতিক্রিয়া এখানে সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবেও হতে পারে, আবার অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পরেও দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ● ত্বকে লাল লাল চাকা, একজিমা।
● পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব বা মুখের চারপাশে চুলকানো।
● সর্দি, শ্বাস নেওয়ার সময় শোঁ শোঁ শব্দ, শ্বাসকষ্ট হওয়া।
● দ্রুত হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ কমে যাওয়া।
● অ্যানাফাইলেকসিস শক।
আরও পড়ুনডিম দিনে কয়টি ও কীভাবে খাবেন০৫ জুলাই ২০২৫রোগনির্ণয়● শিশুকে প্রথম ডিম খাওয়ানোর সময় অ্যালার্জি উপসর্গ বোঝা যায়।
● চিকিৎসক যদি মনে করেন ডিম বা ডিমযুক্ত খাবার খেলে অ্যালার্জি হয়, তবে তা স্কিন টেস্ট করে নিশ্চিত হতে পারেন।
চিকিৎসা● ডিম ও ডিমযুক্ত খাবার না খাওয়া।
● অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া দমনে অ্যান্টি হিস্টামিন, মারাত্মক অ্যানাফাইলেকসিসে শক ইনজেকশন এপিনেফ্রিন ব্যবহার।
● ডিমে অ্যালার্জি থাকলে কিছু খাদ্য উপাদান পরিহার করা যেমন—এলবুমিন, গ্লোবুলিন ইত্যাদি।
অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
আরও পড়ুনডিমের কমলা, না হলুদ কুসুম—কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর৩১ অক্টোবর ২০২৫