জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন আবেগ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ হঠাৎ খুব রেগে যায়, খুব ছোট কোনো ব্যাপারে ভেঙে পড়ে, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম শুরু করে বা না ভেবে আত্মহত্যার মতো কাজ করতে যায়। এক–দুবার এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বারবার যদি এমনটা হতে থাকে; যদি এটা আমাদের সিদ্ধান্ত, সম্পর্ক বা নিজের পরিচয় নিয়েই সন্দেহ তৈরি করে, তাহলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। এর পেছনে থাকতে পারে একধরনের মানসিক সমস্যা, যাকে বলে ইমোশনাল ডিজরেগুলেশন, অর্থাৎ আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা।
এই সমস্যার কিছু লক্ষণইমোশনাল ডিজরেগুলেশন হলে ব্যক্তির আবেগ ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বাইরে থেকে তাঁকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে তিনি অস্থিরতায় ভোগেন। ছোট একটা ঘটনাও তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিতে পারে। সামান্য চাপেই ভেঙে পড়তে পারেন।
এর সঙ্গে দেখা যেতে পারে
অতিরিক্ত উদ্বেগ বা লজ্জা
হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া
মাদক বা নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্তি
বিপজ্জনক যৌন আচরণ
সম্পর্কের টানাপোড়েন
খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন
আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা
সময়মতো এই সমস্যা ধরা না পড়লে এটা ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি কর্মস্থল বা শিক্ষাজীবনেও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। চিকিৎসা না করালে দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যার প্রভাব আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুনদেখুন উল্কাবৃষ্টির চোখধাঁধানো ১০টি ছবি৪ ঘণ্টা আগেইমোশনাল ডিজরেগুলেশনের কারণআবেগ তো আমাদের সবারই থাকে। তবে সেগুলো যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন এর পেছনে কিছু গভীর কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় সেই কারণগুলো আমাদের শৈশব থেকেই শুরু হয়।
১.
শৈশবের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
শৈশবে কোনো ভয়ংকর বা নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনা—যেমন শারীরিক নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা বা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে গেলে তার প্রভাব দীর্ঘদিন থেকে যায়। কারণ, এই সময়টিই মানুষের মানসিক আর আবেগগত বিকাশের সবচেয়ে সংবেদনশীল ধাপ। এ সময়ের ট্রমা–পরবর্তী জীবনে আবেগের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
২. অবহেলা আর উপেক্ষা
শিশুর প্রতি অবহেলাও একধরনের নির্যাতন। যখন মা–বাবা বা অভিভাবক শিশুর প্রয়োজনীয় যত্ন, নিরাপত্তা, ভালোবাসা বা সঠিক দিকনির্দেশনা দেন না, তখন সেটি শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলে। পোশাক, খাবার, শিক্ষা বা আবেগগত চাহিদা—সবকিছু থেকেই সে বঞ্চিত হয়। এর প্রভাব পড়ে তার মানসিক গঠনে।
কারও ভাবনা, অনুভূতি বা কথাকে বারবার গুরুত্ব না দেওয়া বা তুচ্ছ করে দেখা একসময় মানসিক অবমূল্যায়নের রূপ নেয়উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয়
শ্রীলঙ্কার মাঠে সেদিন দুপুরটা ছিল অস্বস্তিকর গরমের। এর সঙ্গে যোগ হলো ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই লঙ্কান ব্যাটারের তাণ্ডব। দুজনের ভাবভঙ্গিতে যেন ফুটে উঠল না–বলা কথা—‘আমরা থামব না।’ দ্রুত বাউন্ডারি আসছিল, রানের চাকা ঘুরছিল। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ দলের বোলাররা।
এরপর হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়। দেড় শ রানের অটল জুটি ভেঙে দিয়ে খেলার গল্প বদলে দেন যে ছেলেটি—তিনি নাঈম হাসান।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নিয়ে নাঈম যেন মাঠে এক ‘ঘূর্ণিঝড়’ বইয়ে দেন। বাংলাদেশের দল হঠাৎ পায় নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ। সেই ম্যাচ ড্র হয়; কিন্তু নাঈমের বোলিংয়ের জাদু থেকে যায় গ্যালারির গুঞ্জনে, ভক্তদের আলোচনায়। এ বছরের জুনে শ্রীলঙ্কার গলে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন নাঈম। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ওভার বল করেন তিনি। দেন সবচেয়ে কম রান।
চট্টগ্রামের আলো–বাতাস গায়ে মেখে বড় হওয়া ছেলে নাঈম। পাড়ার মাঠ থেকে উঠে এসে আপন আলোয় জ্বলে ওঠা অদম্য স্পিনার। স্পটলাইট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিজের খেলাটাকে নিখুঁত করে তুলতে যাঁরা চেষ্টা করেন—নাঈম তাঁদের একজন। দলে থাকেন, পারফর্ম করেন, আবার নিঃশব্দে সরে যান। আলোচনার কেন্দ্রে তিনি থাকেন না, কিন্তু তাঁর বোলিংয়ের ঘূর্ণি মাঠের বাইরের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেয়।
শুরুটা সেই গলির মাঠেনাঈমের ক্রিকেটে হাতেখড়ি কৈশোরে। টেপ টেনিসের উচ্ছ্বাস, গলির ক্রিকেটের পাগলামি; যেখানেই ব্যাট-বল, সেখানেই ছুটে যাওয়া। খেলাপাগল ছেলেটির ব্যাটে জোর ছিল, বোলিংয়েও তেমন দাপুটে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট থেকে বলের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেলেন তিনি।
পাহাড়-সাগর-হ্রদে ঘেরা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফরিদারপাড়া এলাকা। নাঈমের ছোটবেলার পথচলা শুরু হয়েছিল এই এলাকাতেই। তাঁদের বাড়িটি একসময় লোকের কাছে ‘মাহবুব কাউন্সিলরের’ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সময়ের স্রোতে সেই নাম পাল্টে গেছে। এখন মানুষ চেনে ক্রিকেটার ‘নাঈম হাসানের বাড়ি’ হিসেবে।
জাতীয় দলের খেলা হলে ফরিদারপাড়ার মানুষ বসে যান টিভির সামনে। যখন নাঈম বল হাতে এগিয়ে আসেন, এলাকাবাসীর উচ্ছ্বাস–উত্তেজনা বেড়ে যায়। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে শুনতে পাওয়া যায় সম্মিলিত ফিসফাস—‘উইকেট চাই নাঈম, উইকেট চাই’। নাঈমের ছোট সাফল্য-ব্যর্থতাতেও মানুষের অনুভূতির ছায়া লেগে থাকে এ এলাকায়।
সমুদ্রপাড়ে লেখা ইতিহাস২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর। চট্টগ্রামের সমুদ্রঘেঁষা সাগরিকা স্টেডিয়ামের সকালটা যেন একটু উজ্জ্বল ছিল সেদিন। নাঈমের চোখে আলো, মনে উত্তেজনা। হয়তো তার চেয়েও বেশি ছিল একধরনের নীরবতা, যেটা বড় দিনে বড় খেলোয়াড়ের মনেই জন্ম নেয়। জাতীয় টেস্ট দলের জার্সিটি প্রথমবার তাঁর গায়ে ওঠে সেদিন। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ২৮৩ দিন। শুরুর দিনেই তিনি ইতিহাস লিখে ফেললেন। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে টেস্ট অভিষেকেই রেকর্ড গড়েন চট্টগ্রামের এই সন্তান। মাঠে তখন উৎসব।
স্টেডিয়াম পেরিয়ে উৎসব শুরু হয় ফরিদারপাড়ার বাড়িতেও। নাঈমের মা মমতাজ বেগম পরে বলেছিলেন, ‘চোখে পানি এসে গিয়েছিল। গর্বে, আনন্দে, বিস্ময়ে।’ টিভিতে তাঁর ছেলেকে বল করতে দেখে নীরবে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা জাতীয় দলে খেলছে।’
হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়।সাগরিকা স্টেডিয়াম সেই থেকে নাঈমের কাছে শুধু একটা মাঠ নয়, এটাই তাঁর আত্মবিশ্বাসের ঘর। এখানে পাঁচ উইকেটের পর অন্য ম্যাচে ৬ উইকেটও নিয়েছেন। এই মাঠেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজের ছন্দ, নিজের সত্তা।
তবু আফসোসনাঈমের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে একধরনের বৈপরীত্য চোখে পড়ে। সাত বছরে তিনি খেলেছেন মাত্র ১৪ টেস্ট। এর মধ্যে চারবার নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছবি। ৬৯ ম্যাচে ২৭৬ উইকেট। ১৮ বার ৫ উইকেট ও ৩ বার নিয়েছেন ১০ উইকেট।
বিপিএলে নাঈমের নামের পাশে আছে ৩০ উইকেট। চিটাগং ভাইকিংস, কুমিল্লা ভিকটোরিয়ানস, ফরচুন বরিশাল, সিলেট থান্ডার্স—এসব দলে খেলে তিনি হয়ে উঠেছেন পরের প্রজন্মের অফস্পিনের প্রতিশ্রুতি।
প্রতিটি ম্যাচেই দেখা যায়—নাঈম নিজের খেলা নিয়ে কতটা মনোযোগী। তিনি নিজের স্পেল নিয়ে ভাবেন, চক্র ভেঙে কীভাবে ব্যাটসম্যানকে ভুল করানো যায়, তা নিয়েই থাকেন।
যে স্পিনার এতটা ধারাবাহিক, তাঁকে আরও বেশি সুযোগ না দেওয়ার আক্ষেপ থেকেই যায়। নাঈমের বাবা মাহবুবুল আলমের চোখের কোণে সেই আক্ষেপ জমে আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাঈমকে নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। কিন্তু সে সুযোগ পায় কম। আরও সুযোগ পেলে নামের পাশে উইকেটের সংখ্যা ভিন্ন হতো।’
নাঈম হাসান