অধ্যাপক যতীন সরকার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু একটা দুঃখবোধ রয়েই গেল। ২০২৫ সালের ৯ আগস্ট আমি সাংগঠনিক কাজে ময়মনসিংহ শহরেই ছিলাম। কবি সরোজ মোস্তফাও ছিলেন সঙ্গে। দুপুরে সরোজ বললেন, বিকেলে তিনি এক জায়গায় নিয়ে যাবেন। পরে খোলাসা করে জানালেন, অধ্যাপক যতীন সরকার হাসপাতালে ভর্তি। সম্ভবত এটাই তাঁকে দেখার শেষ সুযোগ। সেদিন বৃষ্টি ছিল। পরে বিকাল সন্ধ্যায় সরোজও কিছু বললেন না, আমিও হয়তো ভুলে গেলাম। সেদিন সন্ধ্যায় সরোজ নেত্রকোনা আর আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। আজ তাঁর মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে এমন একজন বিরল মনীষীকে শেষ দেখার সুযোগ পেয়েও দেখতে যেতে পারিনি।

অধ্যাপক যতীন সরকারের নাম শুনি আশির দশকের প্রথমার্ধে। আমি তখন ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে প্রথম বর্ষে ভতি হই। কোন কলেজে কারা নামকরা শিক্ষক, তা জানার জন্য সেই সময়ে আমরা খুব কৌতূহলী ছিলাম। তখনই জানতে পারি, নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে এক জাঁদরেল শিক্ষক আছেন। তাঁর নাম যতীন সরকার। বলতে গেলে, সর্বত্রই যতীন সরকারের নামডাক ও যশখ্যাতি।

কোন কলেজে কারা নামকরা শিক্ষক, তা জানার জন্য সেই সময়ে আমরা খুব কৌতূহলী ছিলাম। তখনই জানতে পারি, নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে এক জাঁদরেল শিক্ষক আছেন। তাঁর নাম যতীন সরকার।

পরবর্তী সময়ে আব্বার মুখে তাঁর নাম শুনতে পাই। জানতে পারি, কলেজে যোগদানের আগে তিনি বারহাট্টা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ও আমার আব্বা একই স্কুলে সহকর্মী ছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁদের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাড়িও নেত্রকোনাতেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যতীন সরকারকে বামপন্থী লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানতে পারি এবং তাঁর কিছু প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হই। সেসব রচনায় তখন খুব নিবিষ্ট মনোযোগ দিতে পারিনি। বেশ কঠিন মনে হতো। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভিন্নধর্মী চিন্তা ও লেখার ভক্ত হয়ে পড়ি।

যতীন সরকার বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অনুসন্ধান, মুক্তবুদ্ধি ও লৌকিক সংস্কৃতির দর্শন তুলে ধরে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। গণমানুষ ও প্রান্তজনের জীবনের প্রতি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির ছাপ রেখে গেছেন তাঁর বিভিন্ন রচনায়।

২০০৫ সালের ৩ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উদ্‌যাপন করি ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে। অনুষ্ঠানে যতীন সরকার ছিলেন প্রধান আলোচক। ঢাকা থেকে আমি ও সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল গিয়েছিলাম। সেদিন গণমাধ্যম নিয়ে যতীন সরকারের নিরেট আলোচনা শুনে তাঁর স্পষ্টবাদিতার বিষয়ে আরও জানতে পারি।

পরবর্তী সময়ে যতীন স্যারের সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। বিশেষ করে নেত্রকোনার সাহিত্য সমাজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে তিনি থাকতেন মধ্যমণি। তাঁকে ছাড়া বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসব কল্পনা করাই যেত না। তিনি ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা। প্রায় সময়ই একই মঞ্চে বসেছি আমরা। কিন্তু আমি তাঁর সামনে সব সময়ই কাচুমাচু হয়েই থাকতাম। বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞানের সামনে নিজেকে সব সময়ই ‘নাবালক’ মনে হতো আমার। তাঁকে আমরা সবাই সমীহ করতাম।

২.

অধ্যাপক যতীন সরকার বিরলপ্রজ চিন্তকদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। ১৯৩৬ সালে ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর চিরপ্রস্থানও হয় আগস্ট মাসেই। ১৩ আগস্ট ২০২৫, বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজেই দীর্ঘ চার দশক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি ছিলেন দেশের খ্যাতনামা লেখক ও বুদ্ধিজীবী। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তাঁর কথার ও লেখার ধার ছিল তীক্ষ্ম ছুরির মতো। সত্যের পথে ছিলেন অবিচল, নিরাপসকামী।

যতীন সরকার ছিলেন সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অধিকারী। সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনবদ্য আত্মজীবনী ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’ ২০০৫ সালে প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কারে সম্মানিত হন।

অধ্যাপক যতীন সরকার ছিলেন গভীর মনীষার অধিকারী। মননশীল লেখক, সমালোচক ও মুক্তচিন্তক ছিলেন তিনি। তাঁর ছিল নিজস্ত চিন্তার ধারা। নিজস্ব ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিলন। তিনি আজীবন কুসংস্কারের সঙ্গে লড়েছেন। আধুনিকতার কুসংস্কার নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা শিক্ষিত মানুষজন আসলে কতগুলো দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এগুলো আধুনিকতার কুসংস্কার। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাই আমাদের মস্তিষ্ককোষে সেই সব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে নিদারুণ মানস-প্রতিবন্ধের সৃষ্টি করেছে। সে রকম মানস প্রতিবেন্ধর দরুনই আমাদের সাহিত্য–সংস্কৃতির ইতিহাসকেও আমরা খণ্ডিত করে ফেলেছি, একটা খণ্ডিত অংশকেই সমগ্রের মর্যাদা দিয়েছি। বাংলা সাহিত্যের মূলধারা বলে আমরা ধরে নিয়েছি ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সৃষ্ট সাহিত্যকে। এর বাইরে বিশাল বাংলায় গ্রামীণ কৃষিজীবী বা অন্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন যেসব কবি, শতকরা নব্বই জন মানুষ যাঁদের কবিতা বা গান তথা সাহিত্যের উপভোক্তা, তাঁদের তো আমরা গণনীয়ই বিবেচনা করিনি। অথচ এঁরাই আবহমান বাংলার গণকবিতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের এক অদ্ভুত ইতিহাস আমরা রচনা করেছি। এবং এ রকম অদ্ভুতত্ব কেবল সাহিত্যের ইতিহাসে নয়, অন্যত্রও। ইতিহাসে “আধুনিক” যুগ বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটির অবস্থান যেন সকল প্রকার ধারাবাহিকতার বাইরে। দেশের মাটিতে তার কোনো শিকড় বা উৎস নেই, দেশের বাইরে থেকে আনা কলমের চারা যেন তা। এই “আধুনিক যুগ” যেন এক “বৃন্তহীন পুষ্প”।’ (সূত্র: বাংলা কবিতার মূলধারা ও জালাল উদ্দীন খাঁ)

ইতিহাসে ‘আধুনিক’ যুগ বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটির অবস্থান যেন সকল প্রকার ধারাবাহিকতার বাইরে। দেশের মাটিতে তার কোনো শিকড় বা উৎস নেই, দেশের বাইরে থেকে আনা কলমের চারা যেন তা। এই ‘আধুনিক যুগ’ যেন এক ‘বৃন্তহীন পুষ্প’।যতীন সরকার

যতীন সরকারের অন্যান্য রচনাশৈলীতেও তাঁর নিজস্ব চিন্তার ছাপ ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ হচ্ছে ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘ভাবনার মুক্ত বাতায়ন’সহ ৫৫টির বেশি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন।

যতীন সরকার বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অনুসন্ধান, মুক্তবুদ্ধি ও লৌকিক সংস্কৃতির দর্শন তুলে ধরে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। গণমানুষ ও প্রান্তজনের জীবনের প্রতি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির ছাপ রেখে গেছেন তাঁর বিভিন্ন রচনায়। কেবল একজন লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবেই নয়, একজন শিল্পসংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ছিলেন এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মানবাধিকার, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। শিল্পপ্রেমী সমাজচিন্তকদের কাছে তিনি অবিস্মরণীয় প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: যত ন সরক র র ন ত রক ন প রস ক র ন র জন আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

৩ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত উড়োজাহাজসহ আরও যা যা পান একজন মিস ইউনিভার্স

থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও ফুকেটে চলছে মিস ইউনিভার্সের ৭৪তম আসর। সেখানে ইতিমধ্যে আলোচনায় আছেন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ তানজিয়া জামান মিথিলা। মিস ইউনিভার্সের বার্ষিক বাজেট ১০০ মিলিয়ন ডলার। বিজয়ী হওয়ার পরবর্তী এক বছর মিস ইউনিভার্সের সব খরচ বহন করে মিস ইউনিভার্স কর্তৃপক্ষ। চলুন দেখে নেওয়া যাক, প্রতিযোগিতার বিজয়ী কী পান।

১. নগদ টাকা

মিস ইউনিভার্সকে এক বছরের বেতন হিসেবে নগদ আড়াই লাখ ডলারের চেক দেওয়া হয়, টাকার অঙ্কে যা ৩ কোটির বেশি।

মিস ইউনিভার্সকে এক বছরের বেতন হিসেবে নগদ আড়াই লাখ ডলারের চেক দেওয়া হয়, টাকার অঙ্কে যা ৩ কোটির বেশি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এপস্টেইনের নথি প্রকাশের পক্ষে হঠাৎ কেন অবস্থান নিলেন ট্রাম্প
  • ময়মনসিংহে ইউনিয়ন পরিষদের কাছের ঝোপ থেকে গভীর রাতে ককটেল উদ্ধার
  • এশিয়ার প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী কারা, কীসের ব্যবসা তাঁদের
  • করদাতা মারা গেলেও যে কারণে কর দিতে হয়, কীভাবে দেওয়া হয়
  • ৩ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত উড়োজাহাজসহ আরও যা যা পান একজন মিস ইউনিভার্স
  • উচ্চশিক্ষিত ভারসাম্যহীন নারী তিন দিন পর ম্যানহোল থেকে উদ্ধার
  • একাদশ জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার ফলাফল প্রকাশ
  • ময়মনসিংহে দুষ্কৃতকারীদের আগুনে পুড়ল কাভার্ডভ্যান
  • ময়মনসিংহে তিন প্রজন্ম ধরে মহিষের দুধের বিখ্যাত ‘সেনবাড়ির দই’
  • সরকারের টাকায় সচিবের বাড়ির কবরস্থান উন্নয়ন, বরাদ্দ ২৪ লাখ টাকা