সাধারণভাবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ‘বরপুত্র’ বলা হয়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বিশেষ অনুগ্রহ করেন। কিন্তু সময় বদলেছে। শুধু ঈশ্বরের অনুগ্রহে বুঝি এখন আর কাজ হয় না। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে চান মানুষ। ক্ষমতার বরপুত্র হতে চান। কিন্তু চাইলে তো হয় না। বরপুত্র হওয়ার জন্য দরকার দালালি-দুর্নীতি-চাটুকারিতা করবার পরম ধৈর্য ও অশেষ সামর্থ্য। সকলের সেই সামর্থ্য থাকে না। তাই শেষ পর্যন্ত দুয়েকজনই হয়ে উঠতে পারেন ক্ষমতার বরপুত্র। মঞ্জু সরকার (১৯৫৩)-এর বরপুত্র (২০১০) উপন্যাসটি বিন্যস্ত হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার আনুকূল্যে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে ওঠা এক সৌভাগ্যের বরপুত্রকে নিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের পরের কয়েক দশকে এরকম বরপুত্রদের দেখা গিয়েছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পুঁজি করে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে কিছু মানুষ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। এই আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে এরকমই একজন মানুষ- আলহাজ শরাফত উল্লাহ মোহন। রাজাকার বাপের সন্তান মোহন এক সময় রাস্তার মাস্তান, হাইজ্যাকার ছিল। ঢাকা নগরীর সন্ত্রাসী নেতা শরীফ বাচ্চুর ক্যাডার ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে শরীফ বাচ্চু শহীদ প্রেসিডেন্টের দল ছেড়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের দলে যোগ দেয়। ঘটনাচক্রে মোহন নতুন প্রেসিডেন্টের নয়নের মণি হয়ে ওঠে। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষদের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হয়ে ওঠে। আর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে অনায়াসে। 

আখ্যানে লেখক প্রেসিডেন্টের নাম বলেননি ঠিকই, কিন্তু লেখকের বর্ণনার গুণে চরিত্রটিকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘উত্থানপর্ব’র দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে এভাবে: ‘কোনো রক্তপাত ছাড়াই সেনাবাহিনী শাসন-ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেছিল সাময়িকভাবে। অতঃপর প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে সেনাবাহিনী প্রধান ভোটের প্রহসন করে বিশ্বকে জানিয়ে দেন, জনগণের রায় আমার পক্ষে। রায়ের জোরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে ক্ষান্ত হননি, দেশে আবারও পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেও দলবল গড়তে শুরু করেছিলেন।’

লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় ঘটনা ও চরিত্রগুলি কাল্পনিক দাবি করলেও এই বর্ণনায় পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারেন বাস্তবের প্রেসিডেন্টটিকে। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক সময়টিকেও নির্দিষ্ট করে চিনে নেওয়া যায়। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার মোহনের বাবাকে মহল্লা ছাড়া করেছিল। কিশোর মোহন সেদিন বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধ বাহিনীকে ঠেকাতে পারেনি। পারিবারিক বিপর্যয়ের এই ঘটনাটি মোহনের পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছে। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকার রাস্তাঘাটে খুন-হাইজ্যাক-ছিনতাই ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। মোহন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভয় দেখিয়ে অন্যের পকেটের টাকা ঘড়ি সোনা লুট করতে শুরু করে। ছিনতাইকারী হিসেবে নিজের জীবন শুরু করে। চমৎকার দক্ষতায় মঞ্জু সরকার মোহন চরিত্রটির বিকাশের প্রতিটি স্তরকে বাস্তবোচিত ভাবে তুলে ধরেছেন। আপাত খলনায়ক মানুষটিও একদিনে এরকম হয়নি। ধীরে ধীরে তাকে হয়ে উঠতে হয়েছে। দুয়েকটি রেখার আঁচড়ে লেখক মোহনের শৈশব-কৈশোরের ঘটনাকে চিত্রিত করেছেন, যা তার পরবর্তী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অনিবার্যভাবে লগ্ন হয়ে রয়েছে। 

শহরের সব সন্ত্রাসী-বদমাশ, সরকারি দলের সব ক্যাডার আর ঘুষখোর পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী-সচিব মোহনকে গডফাদার হিসেবে মান্য করে। একবার যা তার পছন্দ হয়, তা অনায়াসে চলে আসে হাতের মুঠোয়। মাস্তানী করবার সময় যে সাথীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল, বিয়ে করবার ইচ্ছে হলে সেই উদ্ধত মেয়েটির কথা মনে পড়ে মোহনের। মেয়েটির সমস্ত খবর সংগ্রহ করে। সাথীর প্রেমিক পলাশকে খুন করে কৌশলে তাকে তার কাছে নিয়ে আসে। বুদ্ধিমতী সাথীরও বুঝতে সময় লাগে না যে, মোহন তাকে পাওয়ার জন্য তার প্রেমিককে খুন করেছে। আর প্রেমিকের খুনের প্রতিশোধ নেবে বলে সাথী সাগ্রহে রাজি হয়ে যায় বিয়েতে।  

‘বরপুত্র’ ঘটনাকেন্দ্রিক উপন্যাস। এখানে চরিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আখ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র সাথী। প্রথম থেকেই স্বামীর কাজকর্ম চিন্তাভাবনার বিরোধী সে। মোহনের এবং প্রেসিডেন্টসহ তার দলের তীব্র বিরোধিতা করে সাথী। মোহন আবেগ বিহ্বল হয়ে বলে ‘তোমাকে পেয়ে জীবন আজ আমার ধন্য, মানে পূর্ণ হলো।’ সঙ্গে সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে সাথীর উত্তর, ‘আমি যে তোমাকে, তোমার ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট, এক কথায় তোমার সবকিছুকেই কী ভীষণ ঘৃণা করি, তুমি জানতে না?’ 

অবশ্যই মোহন জানত। সে বলেছে, ‘হ্যাঁ জানতাম। তুমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে, শহীদ বাবার তেজ যাকে বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তোমার মধ্যে ষোলোআনা। অন্যদিকে আমি তোমাদের ভাষায় রাজাকারের পোলা, নিজেও মেলা সন্ত্রাসী-বদমাইসি করছি, এখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থেকে মেলা কালো টাকার মালিক হয়েছি, আমাদের ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যারা আন্দোলন করছে, তুমি তাদের সঙ্গে আছ। সবই জানি আমি।’ 

মোহনের এই সংলাপে দুজনের মানসিকতার ভিন্নতা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সংলাপ চরিত্র বিকাশের প্রধান অস্ত্র হিসেবে এসেছে আখ্যানে। তীক্ষ্ণ সংলাপের কারণে কাহিনিতে শেষ পর্যন্ত একটা উত্তেজনা এবং আকর্ষণ বজায় থেকেছে।  

রাজাকারের ছেলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে। দুজনের মধ্যে মেরুবিন্দুর ব্যবধান। এই বিসদৃশ দাম্পত্য আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। সাথীকে দিনের পর দিন ধর্ষিতা হতে হয়েছে স্বামীর কাছে। এ এক অবর্ণনীয় রোমহর্ষক অনুভূতি। সাথীর স্বামী-সাহচর্যের প্রতিটি দিন কেটেছে প্রতিশোধ স্পৃহাকে জাগিয়ে রেখে। সাথী যে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সরকারি দলের বড়ো পাণ্ডা আলহাজ শরাফত উল্লাহ মোহনের বিবাহিত স্ত্রী- এই সামাজিক সত্যটাকে মোহনের বাড়িতে থেকেও ভুলে যেতে চেয়েছে। কিন্ত ভুলতে দেয়নি চারপাশের পরিবেশ। মোহনের প্রভাব প্রতিপত্তির ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। নানান পরিকল্পনা করেছে স্বামীকে শাস্তি দেওয়ার। মোহনের কালো টাকাকে এই কাজে লাগাতে চেয়েছে। মোহনকে হত্যা করবার কথাও ভেবেছে। বাগান বাড়িতে যাওয়ার সময় সাথী ভেবেছিল, গাজীপুরের সুবিশাল বাগান বাড়ির নির্জনতায় মোহন ভালোবাসার নামে ধর্ষণ করার সুযোগ যেমন পাবে, তেমনি সাথীও প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পাবে। চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সে তা পারেনি। সাথী একসময় চেয়েছিল রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতার পাঁক থেকে মোহনকে উদ্ধার করতে। তাও পারেনি। দাম্পত্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের আগুনটুকুই জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছে শুধু। 

স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে চারিদিকে যে হরতাল আন্দোলন হয়েছিল তার শরিক ছিল সাথীও। সাথী চাইত প্রেসিডেন্টের পতন এবং সেই সঙ্গে মোহনেরও পতন হোক। কিন্তু মোহনদের পতন হয় না। সাথীকে সে বলেছে বিরোধী জোটের এবং বি দলের নেত্রী যদি ক্ষমতায় আসেন তখনও তাঁদের সঙ্গে মোহনের একই রকম ঘনিষ্টতা থাকবে। সে যেন সৌভাগ্যের বরপুত্র হয়ে জন্মেছে। চিরকাল তার এই সৌভাগ্যকে রক্ষা করতে যতটা নিচে নামা সম্ভব নামবে। মোহনের মতো মানুষেরা ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে নিজেদেরও বদলে ফেলতে পারে। আদর্শ বলে কিছু নেই। 

প্রেসিডেন্ট চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন না- এই ব্যাপারে সচেতন ছিল মোহন। তাই বিদেশি ব্যাংকেও প্রচুর টাকা জমিয়েছিল। প্রেসিডেন্টের বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল। 

সাথী মোহনের টাকায় নিরপেক্ষ একটা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে দেখেছে শুধু মোহন নয়, ক্ষমতার কাঙাল সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও। মিডিয়ার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে মোহনের বক্তব্যে। সাথীকে সে বলেছে, ‘দেশে যতগুলো কাগজ আছে, সবাই কারও না কারও পারপাস সার্ভ করেই টিকে আছে। প্রত্যেকটি পেপার যেমন, তেমনি প্রত্যেকটি সাংবাদিকও। কেউ কোনো বিশেষ বড় রাজনৈতিক দল, এনজিও, বড় ব্যবসায়ী, আমলা- প্রত্যেকে নানাভাবে কারো না কারো পারপাস সার্ভ করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করছে।’

ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক নেতারা কত রকম প্রচেষ্টাই না করেন। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বের বাংলাদেশের কূটনৈতিক মানচিত্রটিকে দক্ষতার সঙ্গে প্রতিভাত করেছেন লেখক। মানুষের জীবন গুরুত্বহীন নেতাদের কাছে। পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকে। সাধারণ মানুষ তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। প্রেসিডেন্টের একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করতে পারি। ‘ওরা আন্দোলন বাড়াবার জন্য লাশ চাইছে। এখন বিরোধীদের লাশই উপহার দেব যদি, তাহলে দুই বড় দলের অনেক নেতাকেই এত সুযোগ-সুবিধা দিলাম কেন? যে করেই হোক, দুই বড় দলকে এক হতে দেওয়া যাবে না। অন্তত এক জোটকে পক্ষে নিয়ে, ক্ষমতার শেয়ার দিয়ে আমাকে আগামী সংসদ নির্বাচন সফল করতে হবে।’ এ তো শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র নয়, ভারতেরও। হয়তো বা তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়। 

প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর স্ত্রী- দুজনের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। উপন্যাসের শেষ দিকে দেখা যাবে ফার্স্ট লেডি নিজের আখের গোছাতে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করবার চক্রান্তও করেছেন। নির্বাচনে জেতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন নেতারা। প্রেসিডেন্ট মোহনকে পরামর্শ দিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে। মোহনও মসজিদ সফরকে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছে। নিজেকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে জাহির করতে চেয়েছে। মসজিদের উন্নয়ন ফান্ডে টাকা দিয়েছে। সকলকে বলেছে, ‘আল্লাহ যেন আপনাদের সেবা করার ক্ষমতা আমাকে দেয়।’

স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন। তার ঢেউ এসে পড়ে মোহনের উপরেও। তার বাড়িতে আক্রমণ হয়। রাতারাতি মোহন সস্ত্রীক দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। কিন্তু সাথী কিছুতেই রাজি হয় না। বাধ্য হয়ে একাই দেশ ছাড়ে মোহন। বিদেশে থেকে সাথীর থেকেও বেশি দেশের খবর রাখে সে। সাথী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে মোহনের বাড়িতেই থেকে যায়। যে প্রতিশোধ সাথী নিতে চেয়েছিল মোহনের উপরে, সেই প্রতিশোধ নেয় আন্দোলনকারীরা। কিন্তু সে যে স্বৈরাচারবিরোধী মানুষ ছিল, তা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তার পত্রিকাকে সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত মোহনের স্ত্রী এবং স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে তাকেও হয়তো জেলে ঢুকতে হবে। এই আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সাথী মোহনের বাড়ি ছেড়ে যায়নি। আপোষহীন, জেদি, লড়াকু এই মেয়েটাকে পাঠক সহজে ভুলতে পারেন না। 

মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরির প্রসঙ্গ এসেছে সাথীর বাবার সূত্রে। স্বপ্ন আর বিশ্বাসের জোরে তাঁরা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন বিশ্বাস সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল সাথীর মধ্যেও। ‘একবার দিনদুপুরে তালা ভেঙে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, তখন সাথীর মনে হয়েছিল, বাবা এরকম স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করেনি। একবার পরীক্ষায় নকল করেও একটি মেয়ে অঙ্কে লেটার নম্বর পেয়েছিল, তখন সাথীর মনে হয়েছিল, বাবা এরকম বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেনি। একবার রাস্তায় এক হাইজ্যাকার মহিলার গলার চেন খুলে নিয়েছিল, এবং সাথীর মনে হয়েছিল, বাবা.

..। একবার কাগজে বেআব্রু হাড্ডিসার মানুষের ছবি বের হয়েছিল এবং সাথীর মনে হয়েছিল, বাবা...। একবার দুর্ভিক্ষের সময় অনেকগুলো ভিখারি হাত এড়িয়ে স্বর্ণালঙ্কারে ঝলমল এক মেমসাহেবকে দামি গাড়িতে উঠতে দেখেছিল এবং সাথীর...।’

সমসময়ের রাজনৈতিক আখ্যানে মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শের এহেন বর্ণনায় কাহিনির গতি কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়নি। মোহনের বিপরীতে সাথীর অবস্থান। সাথী চরিত্রটিকে পরিপূর্ণ করবার জন্য প্রয়োজন ছিল এই প্রসঙ্গগুলির। সাথী চরিত্রটির মানসিকতা এবং কার্যকলাপের সঙ্গে তার এই পারিবারিক আদর্শ ও ঐতিহ্যের বৃত্তান্তের একটা সমন্বয় রয়েছে। 

আখ্যানে যা যা এসেছে তার কোনোটাই প্রধান দুটি চরিত্র মোহন ও সাথীর দাবিকে ছাড়িয়ে যায়নি। দুই চরিত্রের পূর্বপুরুষের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং জীবনযাপন প্রণালীর পরিচয় পাঠক পেয়েছেন। তাই দুজনের প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে নিষ্পাণ মনে হয়নি। সাথীর কৌলীন্য-আভিজাত্য তার অন্তরঙ্গে, মানসিক দৃঢ়তায়; আর মোহনের ঐশ্বর্য বহিরঙ্গে ক্ষমতার বৈভবে, প্রাচুর্যে। এই বিরোধের বৃত্তান্তটি কথা সাহিত্যের শিল্পকৌশলে বিবৃত হয়েছে।

প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে রাষ্ট্রশক্তি পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক ক্ষেত্রে যে দুর্বিষহ শোষণ-নিপীড়ন চালিয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও সেরকমটা ঘটেছে একাধিবার। আলোচ্য আখ্যানে তার পরিচয় রয়েছে। এই প্রেসিডেন্ট কিছু স্বার্থপর মানুষের লক্ষ্য পূরণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এরকমটা চললে দেশ যে অন্তঃসারশূন্যতার দিকে চলে যাবে তার আভাস আখ্যানের পরতে পরতে অনুভূত হয়েছে। এই অবস্থায় প্রতি-আক্রমণ, বিদ্রোহ, অসন্তোষ দানা বাঁধবে স্বাভাবিকভাবেই। 
    
সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিল্পী মঞ্জু সরকার। পারিপার্শ্বের সমাজ-রাজনৈতিক মানসের নিখুঁত চিত্রায়ন তাঁর সাহিত্য। রাজনীতির কেন্দ্র, রাজধানী ঢাকা শহরের প্রতিটি স্তরের সমাজ বিন্যাসকে শিল্পিতরূপে চিত্রিত করেছে ‘বরপুত্র’ উপন্যাসে। তিনি ভাষ্যকারের মতো নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠাতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন আখ্যানের। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা সংকটময় সময় পর্বকে এখানে তথ্যসমৃদ্ধভাবে তুলে ধরেছেন মঞ্জু সরকার। এই আখ্যানের সবচেয়ে বড়ো জোরের জায়গা এটাই। লেখকের অভিজ্ঞতার জোর উপন্যাসটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে।

‘বরপুত্র’র সাহিত্য মূল্যের পাশাপাশি একটা তথ্য মূল্যও রয়েছে। সমসময়, রাজনৈতিক ইতিহাস আখ্যানের জমি তৈরি করেছে। শেষ পর্যন্ত বরপুত্র সাহিত্য হয়েও বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক দলিল হয়ে উঠেছে। এখানে মোহন শুধু একটি মাত্র চরিত্র নয়, সে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুর্বিত্তদের প্রতিনিধি। এরকম মোহনেরা বাংলাদেশে একজন নয়, অনেকেই ছিল। আজও রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত বলেই বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। আসলে এই মোহনেরা সব দেশেই আছে। সব দেশেই থাকে। সেদিক থেকে মঞ্জু সরকারের বরপুত্রকে সর্বকালীন সাম্প্রতিকের আখ্যান বলা যায়।  

উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.। মূল্য  ২৪০ টাকা।  

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ শ র র জন ত র বরপ ত র ম হন র ব স ব ধ নত র জন ত ক র জন ত র স থ র মন ক ষমত র র ক ষমত উপন য স ন র পর কর ছ ল হয় ছ ল র ম হন দ জন র ত কর ছ ত হয় ছ ত র পর কর ছ ন চর ত র করব র সরক র একব র ম হনক

এছাড়াও পড়ুন:

দুদক সংস্কার আইন এক-দুই মাসের মধ্যে প্রণয়ন: আসিফ নজরুল

দুর্নীতি দমন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত আইন আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শে‌ষে সাংবা‌দিক‌দের এ কথা ব‌লেন তি‌নি।

আসিফ নজরুল বলেন, “দুদক সংস্কার কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রণয়ন করা হবে।এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।”

আরো পড়ুন:

মুন্নী সাহা ও তার স্বামীকে সম্পদ বিবরণীর নো‌টিশ

সন্দেহজনক লেনদেন, জ‌য়ের বিরু‌দ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দুদ‌কের

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ