গণ–অভ্যুত্থানের পর এক বছর কেটে গেছে। ঢাকাসহ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক চর্চা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিবেশের সংস্কার নিয়ে কোনো প্রকার কার্যকর তৎপরতা দেখায়নি। এ ক্ষেত্রে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, ক্যাম্পাস কি রাজনীতি করার জায়গা, নাকি পড়াশোনা করার জায়গা? এর উত্তর হলো, দুটিই।

সারা দুনিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে পড়াশোনা ও রাজনীতি—দুটোই হয়, সমানতালেই হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি তৎপর থাকে, শিক্ষার্থীবান্ধব থাকে, গবেষণাবান্ধব থাকে এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের তোয়াজ করার বদলে মেরুদণ্ডসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রাজনীতির কারণে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজকর্মে কোনো ক্ষতি হয় না; বরং সেই রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা ও সমাজকে দেখার চোখ আরও শাণিত করে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেটা মূল কাজ, অর্থাৎ ‘ক্রিটিক্যাল মাইন্ড’ তৈরি করা, সে ক্ষেত্রে তো অগ্রগতি হয়ই, সেই সঙ্গে উপকার হয় গোটা দেশের।

২.

যাঁরা শিক্ষার্থী রাজনীতিকে একাডেমিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ভাবছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন করা উচিত যে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শিক্ষার্থী রাজনীতি নেই? এর উত্তর হলো, আছে। সেটা কি তাদের একাডেমিক উৎকর্ষে কোনো বাধা বা অসুবিধা সৃষ্টি করেছে? এর উত্তর হলো, করেনি। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন উল্টো চিন্তা?

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলছেন না। কিন্তু তাঁরা হলগুলোতে রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার দাবি করেছেন। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কেন তাঁরা এমনটা বলছেন, সে যুক্তির একটু বিচার–বিবেচনা করা যাক।

গত বছর গণ–অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগ ও সরকারি বাহিনীর হামলার ঘটনায় হলে হলে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের বিতাড়িত করেছিলেন এবং হলগুলোকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। শিক্ষার্থীরা এখন রেফারেন্স হিসেবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার সেই ঘোষণাকে সামনে এনেছেন। লক্ষণীয় হলো ঘোষণাগুলো কেউ যদি ভালো করে পড়েন, তাহলে দেখা যাবে শিক্ষার্থীরা হলে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য মূলত সেসব ছাত্রসংগঠনের কথাই বলেছিলেন, যারা অতীতে সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে সন্ত্রাস ও দখলদারি চালিয়েছে।

আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী নতুন ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে০৫ অক্টোবর ২০২৪

সেসব ঘোষণার মর্মবস্তুটি একই ছিল। আর তা হলো শিক্ষার্থীরা হলের মধ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চান। কারণ, তাঁরা হলে হলে আর কোনো পলিটিক্যাল গণরুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, দখলদারত্ব, আসন–বাণিজ্য বা আসন নিয়ন্ত্রণ দেখতে চান না। এর মানে হলো শিক্ষার্থীরা তখন হলে হলে ‘প্রতিরোধের রাজনীতি’ দিয়ে ‘সন্ত্রাস-দখলদারত্বের রাজনীতির’ বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিলেন।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ওই ঘোষণা সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি প্রবল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল। ফলে এটা বোঝা দরকার যে তাঁদের কর্মকাণ্ড আসলে হলে হলে সন্ত্রাসের রাজনীতিকে বাতিল করেছিল, কিন্তু খোদ রাজনীতিকে বাতিল করেনি।

হলে হলে সন্ত্রাস-দখলদারত্ব-নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধের যে দাবি, সেটি অত্যন্ত ন্যায্য দাবি। কিন্তু খোদ রাজনীতি বন্ধ করা হলে ‘প্রতিরোধের রাজনীতি’ করার সুযোগটিও বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে কি হলের মধ্যে সন্ত্রাস-দখলদারত্বের রাজনীতি করা আদৌ সম্ভব হবে? সেটা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখেছি, গণ–অভ্যুত্থানের পরপরই হলের মধ্যে মব তৈরি করে পিটিয়ে মানুষ মারা হয়েছে, এমনকি ক্যাম্পাস এলাকায় একজন শিক্ষার্থীও খুন হয়েছেন।

গুপ্ত রাজনীতিকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে প্রকাশ্যে সুস্থ রাজনীতিচর্চার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেটি না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েক শ শিক্ষার্থীর দাবির মুখে গভীর রাতে হলগুলোতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ সিদ্ধান্ত থেকে লাভবান হয় কেবল তারাই, যারা ইতমধ্যেই হলে হলে তাদের গুপ্ত রাজনীতির নেটওয়ার্ক বিস্তার করে হলগুলোকে একপ্রকার দখলে রেখেছে।৩.

গণ–অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে বিভিন্ন হলে কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলো শুরু করে ‘উপঢৌকনের রাজনীতি’। হলের মধ্যে কেউ পানির ফিল্টার বসিয়েছে, কেউ স্যানিটারি প্যাড বিলি করেছে, আবার কেউ ঝাড়বাতি লাগিয়েছে। হলে হলে উপঢৌকনের রাজনীতি বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেয়নি।

অন্যদিকে হলগুলোতে এখন চলছে ‘গুপ্ত রাজনীতি’র দাপট। গুপ্ত রাজনীতি হলো এমন একধরনের রাজনীতি, যেটাকে নিষিদ্ধ করে কখনো আটকানো যায় না। ফলে যা হওয়ার, তা–ই হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলে একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ছোট ছোট টিম ক্রিয়াশীল রয়েছে বলে অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করছেন। আরও অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠনটিকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে।

এটা এখন স্পষ্ট, গত বছর গণ–অভ্যুত্থানের সময় হলে হলে সন্ত্রাস ও দখলদারত্বের যে রাজনীতি শিক্ষার্থীরা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, সেটার আসলে আর কোনো কার্যকারিতা নেই। কারণ, হলগুলো ইতমধ্যে প্রায় দখল হয়ে আছে একটি কিংবা দুটি রাজনৈতিক সংগঠনের ‘প্রকাশ্য’ কিংবা ‘গুপ্ত’ কর্মীদের দ্বারা।

এ রকম পরিস্থিতিতে ৮ আগস্ট যখন জাতীয়তবাদী ছাত্রদল তাদের হল কমিটি ঘোষণা করে, তখন দেখা গেল যে গভীর রাতে বিভিন্ন হল থেকে কয়েক শ শিক্ষার্থী বিক্ষোভে নেমে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীরা যেমন ছিলেন, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছিলেন।

শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, গণ–অভ্যুত্থানের সময় আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সে ঘোষণার আলোকে ছাত্রদলকে ওই সব হল কমিটি বাতিল করতে হবে। কেউ কেউ ছাত্রদলের কমিটিতে থাকা শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের দাবিও করেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা গুপ্ত রাজনীতি ‘নিষিদ্ধের’ও দাবি তুলেছেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা এল যে হলগুলোতে সব গুপ্ত ও প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।

আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন: ছাত্ররাজনীতির পুনর্জাগরণ নাকি আবার আশার গুড়ে বালি২৯ জুলাই ২০২৫৪.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, যে রাজনীতি গুপ্ত, অর্থাৎ প্রকাশ্য নয়, সেটার ওপর তাদের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে কীভাবে? অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে গুপ্ত রাজনীতিই কেবল বিকশিত হয়। তাহলে প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে কীভাবে গুপ্ত রাজনীতি ঠেকানো যাবে? এটা যে ঠেকানো যায় না, এর প্রমাণ তো ইতিমধ্যে ঢাবির বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন।

গুপ্ত রাজনীতিকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে প্রকাশ্যে সুস্থ রাজনীতিচর্চার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেটি না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েক শ শিক্ষার্থীর দাবির মুখে গভীর রাতে হলগুলোতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ সিদ্ধান্ত থেকে লাভবান হয় কেবল তারাই, যারা ইতমধ্যেই হলে হলে তাদের গুপ্ত রাজনীতির নেটওয়ার্ক বিস্তার করে হলগুলোকে একপ্রকার দখলে রেখেছে। এ প্রশ্ন ওঠা এখন খুবই স্বাভাবিক যে একই সঙ্গে ‘গুপ্ত’ ও ‘প্রকাশ্য’ রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কার্যত গুপ্ত রাজনীতির পালেই হাওয়া দিচ্ছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী থাকেন। তাই এ প্রশ্ন তোলা খুবই ন্যায়সংগত যে মাত্র কয়েক শ শিক্ষার্থীর দাবির মুখে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত কি ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়? অন্যদিকে এ প্রশ্নও খুবই ন্যায্য যে যদি কোনো হলের একজন শিক্ষার্থীও হলের মধ্যে তাঁর রাজনীতি করার অধিকার চর্চা করতে চান, তাহলে সেই অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হবে কেন?

গণ–অভ্যুত্থানের সময় হলে হলে সমন্বয়কেরা ছিলেন। তাঁরা তখন সমন্বয়ক হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন, সেটা কি রাজনীতি নয়? গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও হলে হলে সমন্বয়কদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান ছিল। তাহলে প্রশ্ন করা যায়, রাজনীতি করার অধিকার কি শুধু তাঁদের জন্যই ‘সংরক্ষিত’ ছিল? এটা কি বৈষম্যমূলক নয়?

সত্যিকারের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এটা বুঝতে হবে যে হলে হলে সন্ত্রাস–দখলদারত্ব ঠেকাতে হলে তাঁদের এ সন্ত্রাস ও দখলদারত্বের আসল পাওয়ারহাউস, অর্থাৎ দলীয় প্রশাসনকে সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করতে হবে। সেটি করার জন্য দরকার হলে হলে পাল্টা রাজনৈতিক তৎপরতা, দরকার সব হলে, সব বিভাগে এবং ক্যাম্পাসের সর্বত্র প্রতিরোধের রাজনীতি গড়ে তোলা।৫.

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে কমিটি দিয়ে আলোচনা–সমালোচনার মুখে পড়েছে ছাত্রদল। এটা ঠিক যে ছাত্রদলের অতীত রেকর্ড খুব ভালো নয়। তারা সন্ত্রাস ও দখলদারত্বের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল, যেমনটা যুক্ত ছিল ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রশিবির। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন অভিযোগ করেছেন যে শিবির হলে হলে ‘গুপ্ত টিম’ দিয়ে রাজনীতি চালাচ্ছে এবং সেটা জানার পরও প্রশাসন সেটা চালাতে দিচ্ছে, তাহলে বড় ছাত্রসংগঠন হয়ে সেখানে ছাত্রদল সেটা মেনে নেবে কেন? একই সঙ্গে এ প্রশ্নটা ওঠাও খুবই ন্যায়সংগত যে এত দিন ধরে হলগুলোতে চলমান গুপ্ত রাজনীতি বা উপঢৌকন রাজনীতির বিরুদ্ধে ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীরা কেন রাস্তায় নামেননি কিংবা কথা বলেননি?

ক্রিয়াশীল বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠন ঢাবি প্রশাসনের ঢালাওভাবে হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এ ঘোষণার সমালোচনা করেছে। এ রকমভাবে যে হলে ছাত্ররাজনীতি ঠেকানো যাবে না, সে ব্যাপারে একমত হয়েও একমাত্র ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রকার বিরোধিতা বা সমালোচনা করেনি। ফলে যেসব সত্যিকারের সাধারণ শিক্ষার্থী হলে রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলছেন, তাঁদের ভেবে দেখা জরুরি যে তাঁরা কোনো ছাত্রসংগঠনের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন কি না।

সন্ত্রাস ও দখলদারত্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে যেসব সত্যিকারের সাধারণ শিক্ষার্থী হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন, তাঁদের জানতে হবে যে হলে হলে সন্ত্রাস-দখলদারত্ব চালানোর মূল ‘পাওয়ারহাউস’ বা শক্তি আসলে কারা? এই পাওয়ারহাউস হলো দলীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে ছাত্রদল, শিবির কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতাবান ছাত্রসংগঠনের হল কমিটি যদি না–ও থাকে, তারপরও তারা দলীয় প্রশাসনের সহায়তায় হলে দখলদারত্ব–সন্ত্রাস ঠিকই চালাতে পারবে। হলে কমিটি না থাকলে উল্টো তাদের যে সুবিধা হবে, সেটি হলো হলে সন্ত্রাস আর দখলদারত্ব চালালে তাদের দলীয়ভাবে কোনোরকম জবাবদিহি করতে হবে না। কোনো কোনো ছাত্রসংগঠন এখন সেভাবেই কাজ করছে, হলের আসনও নিয়ন্ত্রণ করছে।

আরও পড়ুন‘গুপ্ত রাজনীতি’র নামে নয়া আধিপত্যবাদী শক্তির বিকাশ ঘটছে কি১৩ আগস্ট ২০২৫৬.

সত্যিকারের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এটা বুঝতে হবে যে হলে হলে সন্ত্রাস–দখলদারত্ব ঠেকাতে হলে তাঁদের এ সন্ত্রাস ও দখলদারত্বের আসল পাওয়ারহাউস, অর্থাৎ দলীয় প্রশাসনকে সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করতে হবে। সেটি করার জন্য দরকার হলে হলে পাল্টা রাজনৈতিক তৎপরতা, দরকার সব হলে, সব বিভাগে এবং ক্যাম্পাসের সর্বত্র প্রতিরোধের রাজনীতি গড়ে তোলা।

এ জন্য হলে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বদলে দরকার একটা ক্যাম্পাস চার্টার ঘোষণা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাধ্য করা এবং সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা। ক্যাম্পাস চার্টারে এই বিধান থাকবে যে কোনো ছাত্রসংগঠনের কোনো সদস্য যদি হলে, বিভাগে কিংবা ক্যাম্পাসের কোথাও কোনো প্রকার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, আসন নিয়ন্ত্রণ কিংবা কোনো প্রকার নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত হন কিংবা জোর করে কাউকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়ে যান কিংবা কাউকে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বা আন্দোলনে যেতে বাধা দেন, তাহলে নির্দিষ্ট মেয়াদে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল হবে এবং একই সঙ্গে সেই সংগঠনও নির্দিষ্ট মেয়াদে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ হবে।

চার্টারে এটাও থাকবে যে নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। যদি তারা নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে তা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপাচার্য ও প্রক্টর পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকবেন। আসন–বাণিজ্য ও আসন নিয়ন্ত্রণ নিরসনে ক্যাম্পাস চার্টারে এটাও থাকবে যে ভর্তির ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আসন ও রুম বরাদ্দের তালিকা দেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ রকম একটি ‘ক্যাম্পাস চার্টার’ বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ধারণা করা যায়, ক্যাম্পাস চার্টারের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির প্রত্যাশিত সংস্কার সম্ভব হবে।

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ গবেষক; সদস্য, সর্বজনকথা ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কয় ক শ শ ক ষ র থ গ প ত র জন ত ক ন গ প ত র জন ত ন ষ দ ধ কর র জন ত র প রক শ য স গঠন র ছ ত রদল হলগ ল ত ন র পর কর র জ র জন য পর ব শ প রক র অর থ ৎ কর ছ ন ধ কর র দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘গুপ্ত সংগঠনকে’ সুযোগ করে দিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সব প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রকৃতপক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবিরের মতো কিছু গুপ্ত সংগঠনকে দখলদারি ও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধের সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ কথা বলে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি তামজিদ হায়দার, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান, ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসুসহ অনেকে। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছায়েদুল হক নিশান।

সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, হলগুলোতে দখলদারি বন্ধের অজুহাতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করবে। প্রশাসনের মদদপুষ্ট সংগঠনকে ক্যাম্পাস এবং হলে একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ করে দিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এ ধরনের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মূল আশঙ্কা ক্ষমতাসীন ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নতুন করে গণরুম-নির্যাতন চালুর সুযোগ তৈরি হবে কি না, উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কিন্তু এই সংকট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সংস্কার, আবাসন সংকট নিরসন, প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য বন্ধসহ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গিয়ে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো জনতুষ্টিবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

গণ–অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো চর দখলের মতো করে রাজনৈতিক দলগুলো দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘এ ক্ষেত্রে নিয়ম ও যোগ্যতা মানদণ্ড হিসেবে কাজ করেনি। প্রশাসনিক এই কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের নয়, নির্দিষ্ট দল ও সংগঠনের স্বার্থ দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একই ভূমিকা আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতা দৃশ্যমান।’

অতীতের মতো ছাত্রশিবির এখনো গোপন রাজনীতিতেই বিশ্বাস করে বলে অভিযোগ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বলা হয়, ‘এতে ছাত্রশিবিরকে সংগঠনগতভাবে তাদের নেতা-কর্মীদের অপকর্মের দায় নিতে হয় না। এমনকি যারা অতীতে ছাত্রলীগের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ছিল, তাদেরও প্রকাশ্যে আনতে হয় না। তথাকথিত সামাজিক কাজ এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মুখোশে তারা অনায়াসে নিজেদের সাংগঠনিক কাজ চালায় এবং বিরোধী মতকে দমন করতে পারে।’

আসন সংকটকে কেন্দ্র করে হলগুলোতে দখলের অপরাজনীতি চলে উল্লেখ করে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট এই সংকট দূর করে এবং প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আসন বরাদ্দ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বা সীমিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত আরেকটি ফ্যাসিস্ট প্রক্রিয়া, সংস্কৃতি ও শক্তির উদ্ভব ঘটাবে বলে সতর্ক করেছেন গণতান্ত্রিক বাম জোটের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, ‘ছাত্ররাজনীতি না থাকলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্ট কোনো শক্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকবে না। তাই শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, বরং সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই জরুরি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘গুপ্ত সংগঠনকে’ সুযোগ করে দিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা
  • বেলাই বিল ভরাটে হাইকোর্টের স্থিতাবস্থা