ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ শুক্রবার আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজে বৈঠকে বসছেন।

গত বুধবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বৈঠকের পর ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, যুদ্ধের তিন বছরের বেশি সময় পর যদি পুতিন যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হন, তাহলে ‘কঠিন পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।

বিশ্বের প্রভাবশালী দুই নেতার এ উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হবে আলাস্কার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে। ৬৪ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ ঘাঁটি আর্কটিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়া ও প্রস্তুতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৯ সালে প্রথম মেয়াদে এ ঘাঁটিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, এখানে কর্মরত সেনারা ‘আমাদের দেশের শেষ সীমানায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন’ হিসেবে কাজ করছেন।

তবে একসময় এ আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, রাশিয়ার মালিকানায় ছিল। মাত্র ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল) প্রশস্ত বেরিং প্রণালি আলাস্কা ও রাশিয়াকে আলাদা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ ৯ আগস্ট এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা তো প্রতিবেশী দেশ। তাই বেরিং প্রণালি পেরিয়ে আলাস্কায় বৈঠক করা যৌক্তিক।’

রাশিয়া কখন আলাস্কার নিয়ন্ত্রণ নেয়

১৭২৫ সালে রুশ সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট ডেনিশ নাবিক ভিটাস বেরিংকে অনুসন্ধানের জন্য আলাস্কার উপকূল পাঠান। তখন থেকেই রাশিয়ার ওই অঞ্চলে আগ্রহ ছিল। সেখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে সমুদ্র ওটারের দামি পশম ছিল। আর জনসংখ্যাও ছিল খুব কম।

১৭৯৯ সালে সম্রাট পল প্রথম ‘রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানিকে’ আলাস্কার শাসনের একচেটিয়া অধিকার দেন। এ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠানটি সেখানে বসতি গড়ে তোলে। যেমন ১৮০৪ সালে স্থানীয় লিঙ্গিট উপজাতিকে দমন করে সিটকাকে রুশ উপনিবেশের রাজধানী করা হয়।

কিন্তু দ্রুতই সমস্যা দেখা দেয়। যেমন পিটার্সবার্গ থেকে দূরত্ব, বৈরি আবহাওয়া, সরবরাহের অভাব ও আমেরিকার অভিযাত্রীদের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমে প্রসারিত হতে থাকায় আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রুশ ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হতে থাকেন। রাশিয়ার তখন প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে বড় বসতি ও সেনা মোতায়েন করার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলের ইতিহাসে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর কেন রাশিয়া আলাস্কা বিক্রি করল

রাশিয়া তুরস্কের দানিউব অঞ্চলে (বর্তমান রোমানিয়া) প্রবেশ করার পর ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় যখন। রুশ সম্প্রসারণ ঠেকাতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়া অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধে।

যুদ্ধের প্রধান মঞ্চ হয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনারা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবস্থানগুলোয় হামলা চালান। এ কৃষ্ণসাগর বসফরাস ও দারদানেল প্রণালির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি আগে অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

টানা তিন বছর লড়াই শেষে রাশিয়া যুদ্ধে নিদারুণভাবে হেরে যায়। এরপরই তারা ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকান পিস সোসাইটি প্রকাশিত ‘অ্যাডভোকেট ফর পিস’ পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের জন্য রাশিয়া তখনকার হিসাবে ১৬ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং খরচ করেছিল।

অন্যদিকে অতিরিক্ত শিকার ও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে আলাস্কা থেকে তখন খুব কম লাভ আসছিল। উপরন্তু এ অঞ্চল ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত কানাডার কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন সহজেই ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে নিতে পারবে বলে আশঙ্কা ছিল।

১৮৬০-এর দশকের শুরুতে জার আলেকসান্দার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেন, আলাস্কা বিক্রি করলে টাকা পাওয়া যাবে এবং ব্রিটেনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যুক্তরাষ্ট্র তখন মহাদেশজুড়ে প্রসারিত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তখন আলাস্কা কিনতে রাজি ছিল। এভাবেই ১৮৬৭ সালের আলাস্কা ক্রয়–বিক্রির চুক্তি হয়।

বিক্রির প্রক্রিয়া কেমন ছিল

১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র ৭২ লাখ ডলারে আলাস্কা কিনে নেয়।

এ কেনাবেচায় প্রতি একরের দাম পড়ে ২ সেন্টেরও কম। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার জমি পায়। আলাস্কা ভূখণ্ড কেনার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর প্রান্তে প্রবেশাধিকার সহজ ও নিশ্চিত হয়।

তবে অনেকে এ ভূখণ্ড কেনাকে ‘সিওয়ার্ডের বোকামি’ বা ‘সিওয়ার্ডের বরফবক্স’ বলে উপহাস করেছিলেন।

১৮৬৭ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন লিখেছিল, ‘চুক্তির মাধ্যমে আমরা আসলে শুধু পেয়েছি অনতিক্রম্য তুষারের মরুভূমি, বিস্তীর্ণ বামনগাছের বন.

..পেয়েছি সিটকা আর প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপপুঞ্জ। বাকি সবই অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকা।’

তবে ১৮৯৬ সালে ক্লনডাইক অঞ্চলে সোনার খনি আবিষ্কারের পর সমালোচকেরাও বুঝতে পারেন, আলাস্কা আসলে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কৌশলগত গুরুত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানে অর্থনীতি কেমন

বিশ শতকের শুরুতে আলাস্কার অর্থনীতি কেবল সোনার খনিতে সীমাবদ্ধ। এরপরই অর্থনীতিতে নানা বৈচিত্র্য আসতে থাকে। মাছ ধরা, বিশেষ করে স্যামন মাছ ও হ্যালিবাট মাছের অর্থনীতি বড় হতে থাকে। এরপর তামার খনি আবিষ্কার অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলাস্কায় সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার ফলে সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রথম চোখে পড়ে। সেখানে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৬৮ সালে, যখন প্রুডহো বে-তে বিশাল তেলের খনি আবিষ্কার হয়।

তেলের রাজস্ব আয়ে সরকারি খরচ চলে এবং আলাস্কায় স্থায়ী তহবিল গড়ে ওঠে। শেয়ার, বন্ড, আবাসনসহ নানা বিনিয়োগের মুনাফা থেকে নাগরিকদের বার্ষিক ভাতা দেওয়া শুরু হয়।

এই তহবিল ‘পার্মানেন্ট ফান্ড ডিভিডেন্ড’ নামে পরিচিত। ফলে রাজ্যে তেলের মজুদ শেষ হলেও আলাস্কার মানুষ তেলের আয় থেকে সুবিধা পাবে। এ কারণে আলাস্কায় কোনো রাজ্য আয়কর বা বিক্রয়কর নেই, যা যুক্তরাষ্ট্রে খুবই বিরল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলাস্কায় পর্যটনও দ্রুত বেড়েছে। জাতীয় উদ্যান ও হিমবাহ দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আলাস্কায় যান। একসময় আলাস্কাকে উপহাসের কেনাকাটা বলা হতো। আজ সেটা বদলে পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও পর্যটনভিত্তিক সমৃদ্ধ রাজ্য।

তবে আলাস্কার ইতিহাসে জমি কেনাবেচা নতুন কিছু না হলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অবশ্যই আশা করছেন, আজ শুক্রবার ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক যেন তাঁদের ভূখণ্ডের বিনিময়ে শেষ না হয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র প আল স ক র আল স ক য় আম র ক শ শতক প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়া কেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করেছিল

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ শুক্রবার আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজে বৈঠকে বসছেন।

গত বুধবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বৈঠকের পর ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, যুদ্ধের তিন বছরের বেশি সময় পর যদি পুতিন যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হন, তাহলে ‘কঠিন পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।

বিশ্বের প্রভাবশালী দুই নেতার এ উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হবে আলাস্কার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে। ৬৪ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ ঘাঁটি আর্কটিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়া ও প্রস্তুতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৯ সালে প্রথম মেয়াদে এ ঘাঁটিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, এখানে কর্মরত সেনারা ‘আমাদের দেশের শেষ সীমানায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন’ হিসেবে কাজ করছেন।

তবে একসময় এ আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, রাশিয়ার মালিকানায় ছিল। মাত্র ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল) প্রশস্ত বেরিং প্রণালি আলাস্কা ও রাশিয়াকে আলাদা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ ৯ আগস্ট এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা তো প্রতিবেশী দেশ। তাই বেরিং প্রণালি পেরিয়ে আলাস্কায় বৈঠক করা যৌক্তিক।’

রাশিয়া কখন আলাস্কার নিয়ন্ত্রণ নেয়

১৭২৫ সালে রুশ সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট ডেনিশ নাবিক ভিটাস বেরিংকে অনুসন্ধানের জন্য আলাস্কার উপকূল পাঠান। তখন থেকেই রাশিয়ার ওই অঞ্চলে আগ্রহ ছিল। সেখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে সমুদ্র ওটারের দামি পশম ছিল। আর জনসংখ্যাও ছিল খুব কম।

১৭৯৯ সালে সম্রাট পল প্রথম ‘রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানিকে’ আলাস্কার শাসনের একচেটিয়া অধিকার দেন। এ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠানটি সেখানে বসতি গড়ে তোলে। যেমন ১৮০৪ সালে স্থানীয় লিঙ্গিট উপজাতিকে দমন করে সিটকাকে রুশ উপনিবেশের রাজধানী করা হয়।

কিন্তু দ্রুতই সমস্যা দেখা দেয়। যেমন পিটার্সবার্গ থেকে দূরত্ব, বৈরি আবহাওয়া, সরবরাহের অভাব ও আমেরিকার অভিযাত্রীদের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমে প্রসারিত হতে থাকায় আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রুশ ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হতে থাকেন। রাশিয়ার তখন প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে বড় বসতি ও সেনা মোতায়েন করার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলের ইতিহাসে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর কেন রাশিয়া আলাস্কা বিক্রি করল

রাশিয়া তুরস্কের দানিউব অঞ্চলে (বর্তমান রোমানিয়া) প্রবেশ করার পর ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় যখন। রুশ সম্প্রসারণ ঠেকাতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়া অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধে।

যুদ্ধের প্রধান মঞ্চ হয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনারা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবস্থানগুলোয় হামলা চালান। এ কৃষ্ণসাগর বসফরাস ও দারদানেল প্রণালির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি আগে অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

টানা তিন বছর লড়াই শেষে রাশিয়া যুদ্ধে নিদারুণভাবে হেরে যায়। এরপরই তারা ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকান পিস সোসাইটি প্রকাশিত ‘অ্যাডভোকেট ফর পিস’ পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের জন্য রাশিয়া তখনকার হিসাবে ১৬ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং খরচ করেছিল।

অন্যদিকে অতিরিক্ত শিকার ও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে আলাস্কা থেকে তখন খুব কম লাভ আসছিল। উপরন্তু এ অঞ্চল ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত কানাডার কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন সহজেই ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে নিতে পারবে বলে আশঙ্কা ছিল।

১৮৬০-এর দশকের শুরুতে জার আলেকসান্দার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেন, আলাস্কা বিক্রি করলে টাকা পাওয়া যাবে এবং ব্রিটেনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যুক্তরাষ্ট্র তখন মহাদেশজুড়ে প্রসারিত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তখন আলাস্কা কিনতে রাজি ছিল। এভাবেই ১৮৬৭ সালের আলাস্কা ক্রয়–বিক্রির চুক্তি হয়।

বিক্রির প্রক্রিয়া কেমন ছিল

১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র ৭২ লাখ ডলারে আলাস্কা কিনে নেয়।

এ কেনাবেচায় প্রতি একরের দাম পড়ে ২ সেন্টেরও কম। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার জমি পায়। আলাস্কা ভূখণ্ড কেনার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর প্রান্তে প্রবেশাধিকার সহজ ও নিশ্চিত হয়।

তবে অনেকে এ ভূখণ্ড কেনাকে ‘সিওয়ার্ডের বোকামি’ বা ‘সিওয়ার্ডের বরফবক্স’ বলে উপহাস করেছিলেন।

১৮৬৭ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন লিখেছিল, ‘চুক্তির মাধ্যমে আমরা আসলে শুধু পেয়েছি অনতিক্রম্য তুষারের মরুভূমি, বিস্তীর্ণ বামনগাছের বন...পেয়েছি সিটকা আর প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপপুঞ্জ। বাকি সবই অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকা।’

তবে ১৮৯৬ সালে ক্লনডাইক অঞ্চলে সোনার খনি আবিষ্কারের পর সমালোচকেরাও বুঝতে পারেন, আলাস্কা আসলে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কৌশলগত গুরুত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানে অর্থনীতি কেমন

বিশ শতকের শুরুতে আলাস্কার অর্থনীতি কেবল সোনার খনিতে সীমাবদ্ধ। এরপরই অর্থনীতিতে নানা বৈচিত্র্য আসতে থাকে। মাছ ধরা, বিশেষ করে স্যামন মাছ ও হ্যালিবাট মাছের অর্থনীতি বড় হতে থাকে। এরপর তামার খনি আবিষ্কার অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলাস্কায় সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার ফলে সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রথম চোখে পড়ে। সেখানে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৬৮ সালে, যখন প্রুডহো বে-তে বিশাল তেলের খনি আবিষ্কার হয়।

তেলের রাজস্ব আয়ে সরকারি খরচ চলে এবং আলাস্কায় স্থায়ী তহবিল গড়ে ওঠে। শেয়ার, বন্ড, আবাসনসহ নানা বিনিয়োগের মুনাফা থেকে নাগরিকদের বার্ষিক ভাতা দেওয়া শুরু হয়।

এই তহবিল ‘পার্মানেন্ট ফান্ড ডিভিডেন্ড’ নামে পরিচিত। ফলে রাজ্যে তেলের মজুদ শেষ হলেও আলাস্কার মানুষ তেলের আয় থেকে সুবিধা পাবে। এ কারণে আলাস্কায় কোনো রাজ্য আয়কর বা বিক্রয়কর নেই, যা যুক্তরাষ্ট্রে খুবই বিরল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলাস্কায় পর্যটনও দ্রুত বেড়েছে। জাতীয় উদ্যান ও হিমবাহ দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আলাস্কায় যান। একসময় আলাস্কাকে উপহাসের কেনাকাটা বলা হতো। আজ সেটা বদলে পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও পর্যটনভিত্তিক সমৃদ্ধ রাজ্য।

তবে আলাস্কার ইতিহাসে জমি কেনাবেচা নতুন কিছু না হলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অবশ্যই আশা করছেন, আজ শুক্রবার ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক যেন তাঁদের ভূখণ্ডের বিনিময়ে শেষ না হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ