নবুয়ত লাভের বছর তিনেক পরেও নবীজি (সা.) ও সাহাবিরা নীরবেই কাজ করে গেছেন। গোপনে গোপনে চলেছে ইসলামের দাওয়াত। তখন মক্কায় মুসলিমদের লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ পড়তে হতো, যাতে মুশরিকরা টের না পায়।
এত লুকোচুরির পরেও কাফেররা জেনে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে। সেই ধর্মের ইবাদত পদ্ধতিও আলাদা৷ ফলে তেতে ওঠে মুশরিকরা। মুসলিমদের যেখানে ইবাদত করতে দেখত, শুরু করে দিত মারধর। তাদের এমন বাড়াবাড়ির কারণে মুসলিমদের প্রকাশ্য ইবাদত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
নবীজি (সা.
নবীজি (সা.) তার প্রস্তাবে ভারি খুশি হন৷ তার জন্য দোয়া করেন৷ এভাবেই ঘরটা মুসলিমের জন্য বিদ্যানিকেতন, তাবলিগি মারকাজ, একইসাথে অস্থায়ী মসজিদ হিসেবেও ব্যবহার হতে থাকে।
কে সেই মেজবান সাহাবি? তিনি আবু আব্দুল্লাহ আরকাম ইবনে আবিল আরাকাম (রা.)।
সবার আগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাদেরই একজন৷ প্রথম ইসলামগ্রহণকারীদের তালিকায় তার অবস্থান এগারো কী বারো। তিনি ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের লোক। বনু মাখজুম ছিল কুরাইশেরই একটি সম্ভ্রান্ত শাখা৷
আরকাম (রা.) হিজরতের ২৩ বছর আগে জন্মলাভ করেন। নবীজি (সা.) যখন নবুওয়তের ঘোষণা দেন, তার বয়স তখন ১৮’র কাছাকাছি। শিয়াবে আবু তালিবে (আবু তালিবের উপত্যকা) নির্বাসিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলিমরা সেখানে ইবাদত করতে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলেও দারুল আরকাম ছিল তার ঠিকানা। দরজার বাইরে থেকে কেউ একজন নিচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করতেন, আল্লাহর রাসুল আছেন? তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে? উত্তর দেওয়া হতো, দারুল আরকামে।
হজরত উমরকেও তার ভগ্নিপতি সাঈদ ইবনে যায়েদ এই দারুল আরকামে নিয়ে এসেছিলেন। নবীজি (সা.) নবুওয়ত লাভের ৭ বছর পরেও এই ঘরটা ছিল ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
হিজরতের আদেশ পেলে মদিনা সফর করেন আরকাম (রা.)। নবীজি (সা.) আবু তালহা যায়েদ ইবনে সাহল আনসারিকে তার মুসলিম ভাই বানিয়ে দেন৷ আবু তালহা তাকে মদিনায় এক খণ্ড জমিও দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় হিজরি থেকে গাযওয়ার (বড় যুদ্ধের) ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। বদর, উহুদ, খন্দক,খায়বার ও হুনাইন যুদ্ধে বীরত্বের সাক্ষর রাখেন আরকাম (রা.)। নবীজি (সা.) তাকে একটি তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে সবগুলো যুদ্ধ করেছেন তিনি৷ তাকে গোত্রে গোত্রে জাকাত উত্তোলনের দায়িত্বও দিয়েছিলেন নবীজি। তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই করেছেন এই কাজ।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরত: ইসলামের ৬টি মাইলফলক০২ জুলাই ২০২৫নবীজি (সা.)-এর মৃত্যুর পর মোটামুটি ৪৪ বছর জীবিত ছিলেন আরকাম (রা.)। ছিলেন খুলাফায়ে রাশেদার সময়কালের সাক্ষী। ৫৫ হিজরিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোনো বর্ণনায় ৫৩ হিজরির কথাও পাওয়া যায়।
তিনি অসিয়ত করেছিলেন, তার জানাজা যেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) পড়ান। পরবর্তীতে সাদ (রা.)-ই তার জানাযা পড়িয়েছিলেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ছিলেন আরকাম (রা.)।
১৪০ হিজরি। তখন আব্বাসি খেলাফতের শাসনামল। খলিফা ছিলেন আবু জাফর মনসুর। আরকাম (রা.)-এর ঘর দারুল আরকামকে তিনি তারই নাতি আব্দুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আরকাম থেকে কিনে নেন। কিন্তু ঘরটি দারুল আরকাম নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। বর্তমানে যদিও মসজিদে হারামের সীমানায় ঢুকে ঘরটি বিলীন হয়ে গেছে। ইতিহাসে তবু দারুল আরকাম নামেই তার প্রসিদ্ধি। আর দারুল আরকামের মতোই ইসলামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে আবু আব্দুল্লাহ আরকাম ইবনে আবিল আরাকাম (রা.)-এর প্রথম মেজবানির গল্পও।
সূত্র: রওশন সিতারে, আব্দুল্লাহ ফারানি, পৃষ্ঠা: ৮২
জাবির মাহমুদ: লেখক, অনুবাদক
আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ল আরক ম ন আরক ম ইসল ম র
এছাড়াও পড়ুন:
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি।
পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।
আরো পড়ুন:
রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ
আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।
চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”
তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”
যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।
৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত
তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।
তৌকির বিশ্বাস করেন, “স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”
তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।
তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।
তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন
ঢাকা/মাসুদ