মস্কো থেকে আমি আজ যাব সেইন্ট পিটার্সবার্গ। এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কেটেছি। দুপুর একটায় ট্রেন। এর আগে কিছু করার নেই বলে আমার হোটেলের আশেপাশের সবুজে মোড়া, গাছপালায় ঘেরা পথ ধরে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। রাশিয়ায় আসার পর প্রতিদিনই কিছু না কিছু দেখে বিস্মিত হচ্ছি। এখনও হলাম। একটা রাস্তা দেখে মনে হলো এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে না। এমনিতেই ফাঁকা তাই আমি ফুটপাত দিয়ে না গিয়ে পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম। পেছনে একটা মৃদু আওয়াজ হলো। এ শহরের এমনিতেই কোনো আওয়াজ নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমি হাঁটছি বলে একটা গাড়ি যাবার পথ পাচ্ছে না। তাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ফুটপাতে উঠে এলাম। এই হলো এদের ভদ্রতা আর সহিষ্ণুতার নমুনা।
হোটেল থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আমি মেট্রো ধরে সোজা চলে এলাম ভোগযাল বা রেলস্টেশনে। ‘ভোগযাল’ শব্দটি আমার কাছে খুব পরিচিত। উজবেকিস্তানে অনেকবার ট্রেনে চড়তে হয়েছে। এখনও সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী রাশিয়ান ভাষায় সব কিছু লেখা আর সাধারণ জনগণও মাতৃভাষা ছাড়াও রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। সে দেশ থেকে দু’টো রুশ শব্দ আমি শিখে এসেছি, ‘স্পাসিবা’ আর ‘ভোগযাল’। এই দিয়ে বিনা রুশ ভাষা জেনে রুশ দেশে দিব্যি কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। তবে কেউই যে ইংরেজি জানে না তা নয়। মস্কোয় তো দেখলাম অর্ধেকের বেশি মানুষ ইংরেজি জানে। ইংরেজি না জানলেও ট্রান্সলেটর দিয়ে বেশ তথ্য আদান-প্রদান করে নেওয়া যায়। আর এ দেশের মানুষ যেমন নম্র-ভদ্র, তেমনি পরোপকারী ও সভ্য।
রেলস্টেশনে আমার ট্রেন যে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চলে এলাম। যাত্রীরা সবাই লাইন ধরে টিকেট আর পাসপোর্ট দেখিয়ে নিজ নিজ কম্পার্টমেন্টে ঢুকছে। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। কাউকে বলতে হচ্ছে না লাইনে দাঁড়াতে। প্লাটফর্ম বা অন্য কোথাও কোনো ময়লা পড়ে নেই। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছে না। আমাদের দেশে রেলস্টেশনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় আর চিৎকার চেঁচামেচি নেই তা ভাবাই যায় না।
আমি যে ট্রেনে করে সেইন্ট পিটার্সবার্গ যাচ্ছি সে ট্রেনটি দোতলা। আশেপাশের দৃশ্য দেখার জন্য আমি দোতলায় একটি সিট বুক করেছি। আমার আগে কিছু যাত্রী এসেছে, পরে বাকিরা এল। ট্রেন ছাড়ার আগে দেখি কোনো সিট খালি নেই। আমি তাহলে ঠিকই শুনে এসেছি যে, গ্রীষ্মকালে ট্রেনের টিকেট পাওয়া বেশ মুশকিল। সেজন্য আগে থেকেই টিকেট করে রাখতে হয়।
আমার পাশের সিটে একটি অপরূপ সুন্দর মেয়ে এসে বসেছে। আমি যে কোনো নতুন দেশ ভ্রমণে মুখে তালা এঁটে বসে থাকতে পারি না। সহযাত্রীদের সাথে বকবক করতে হবেই আমার। ট্রেন ছাড়ার খানিকক্ষণ পরই আমি মেয়েটির সাথে আলাপ জমালাম৷ মেয়েটির নাম ভেরোনিকা। সে পেশায় ডাক্তার। বাড়ি মস্কোতে, কাজ করে সেইন্ট পিটার্সবার্গে। আরও আনন্দের বিষয় হলো ভেরোনিকা ইংরেজি জানে। একটু চুপ থেকে আমি পূর্ণোদ্যমে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেতে থাকলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সে একটুও বিরক্ত হচ্ছে না।
মাঝে কিছুক্ষণ আমি বকবক থামিয়ে জানালায় সরে সরে যাওয়া সবুজের আলোড়ন দেখি। এ দেশটা সবুজে ডুবে যাওয়া এক দ্বীপ বলে মনে হচ্ছে। আর মাঝখান দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠছে লাল ছাদের দোচালা ঘর— স্বপ্নেই এমন দেখা সম্ভব। রেললাইনের দু’ধারে ফুটেছে অজস্র হলুদ, গোলাপি বুনোফুল। পুরো ঝোপজঙ্গল কোথাও গোলাপি, কোথাও হলুদ, কোথাও বেগুনি হয়ে গিয়েছে। আর এর পেছনে পাইন আর বার্চ গাছের ঘন জঙ্গল। মাথার উপরে গাঢ় নীল আকাশ। প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে— এখানে এসো, এই হরিৎ সমুদ্রে ডুব দিয়ে যাও৷
আমার ধ্যানভঙ্গ হলো ট্রেন অ্যাটেন্ডেন্টের ডাকে। জিজ্ঞেস করতে এসেছিল আমার কিছু লাগবে কিনা। আমি কফি চাইলাম। এদিকে ভেরোনিকা বরাবরই লক্ষী মেয়ে হয়ে চুপ করে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে বসে আছে। আমিই কিছুক্ষণ পরপর এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে জ্বালাচ্ছি। ট্রেনের অন্যান্য যাত্রীদেরও দেখি শব্দহীনভাবে হয় ট্যাবে মুভি দেখছে বা গান শুনছে বা বই পড়ছে। রাশিয়ায় অনেক আশ্চর্যের একটা হলো এখনও মানুষ বই পড়ে। এই তো ভেরোনিকাও একটা বই খুলে বসেছে।
সবুজ গ্রাম আর জঙ্গল পেরিয়ে এক সময় সেইন্ট পিটার্সবার্গে ট্রেন এসে থামল। আমি আর ভেরোনিকা এক সাথে নামলাম। এখন বাজে বিকেল ছয়টা। এক্সপ্রেস ট্রেন ছিল তাই পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছাতে পেরেছি। ভেরোনিকাকে আমার হোটেলের ঠিকানা আগেই দেখিয়েছি। ও নিজেও মেট্রো ধরে বাড়ি যাবে। তাই দু’জন রেলস্টেশন থেকে মেট্রো স্টেশনের দিকে আসলাম। এ দেশের সবচেয়ে সুবিধা হলো যে কোনো বাস স্টেশন বা রেলস্টেশনের সাথেই মেট্রো স্টেশন থাকে। আমাকে ভেরোনিকা মেট্রো স্টেশনে নিয়ে গেল কিন্তু টিকেট কিনতে দিল না। নিজের মেট্রো কার্ড সোয়াইপ করে ফেলল৷
এ শহরের মেট্রোকে পাতালরেল বলা চলে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের নদীর মাঝখান দিয়ে এই পাতাল মেট্রো দিব্যি চলাচল করে। এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। একে তো নদীর মাঝ দিয়ে মেট্রোরেল যাবে, তার উপর এই এস্কেলেটর কোথাও থামার নাম করছে না। নিচে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই৷ ভেরোনিকা বলল, ‘সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেট্রো হলো রাশিয়ার সবচেয়ে গভীর নিচু মেট্রোস্টেশন।’ মস্কোর মেট্রোরেলও এমনই পাতালে, তবে সেইন্ট পিটার্সবার্গের স্টেশন বেশি পাতালে।
যতই গভীরে হোক না কেন এক সময় আমরা প্লাটফর্মে এসে পৌঁছালাম। দুই মিনিটের মধ্যে মেট্রো এসে গেল। আমার হোটেল এখান থেকে তিন স্টেশন পর। আমার স্টেশন আসতেই ভেরোনিকা নিজের ঢাউস স্যুটকেস নিয়ে আমার সাথে নেমে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা তো তোমার স্টেশন নয়। তুমি নামলে কেন?’ আমাকে অবাক করে বলল, ‘এসো তোমাকে স্টেশনের বাইরে অবধি পৌঁছে দেই।’ এই মেয়েটিকে আমি পুরো ট্রেনে জ্বালিয়েছি। এখন আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও ভেরোনিকা আমাকে স্টেশন থেকে বের হবার পথ দেখিয়ে দিল। আসলে ভেরোনিকা না থাকলে আমি এত সহজে বাইরে যাবার পথও খুঁজে পেতাম না। কারণ এই স্টেশন একটা গোলক ধাঁধার মতো। একটা এস্কেলেটর পেরিয়ে, অনেকটা হেঁটে ডানে ঘুরে তারপর বের হবার পথ। আমি ভেরোনিকাকে ধন্যবাদ দিয়ে জোর করে বিদায় জানালাম। যাবার আগে ও বুঝিয়ে দিল কিভাবে আমার হোটেলে যেতে হবে। এখান থেকে মাত্র দু’ মিনিটের পথ।
মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়েই দেখি রাস্তার ওপাশে অসামান্য সুন্দর বিশাল একটা গীর্জা। আমি গীর্জার সৌন্দর্য দেখে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে গেলাম। কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গীর্জার সামনে এলাম। এত চওড়া রাস্তা এ শহরে তা কি আমি জানতাম! আর গীর্জা, সেও তো কম বড় নয়। গীর্জার আকারও প্রথাগত নয়। এমন আকার আমি আগে দেখিনি। অর্ধ বৃত্তাকার গীর্জার সামনের বারান্দায় সারি সারি স্তম্ভ আর ঠিক মাঝখানে সবুজ রঙের একটি ডোম বা গম্বুজ। গীর্জার সামনে সবুজ রঙের বড় একটা বাগান। বাগানের মাঝে জলের ফোয়ারা। আমার মনে পড়ল গতকালই এই গীর্জা সম্পর্কে পড়ছিলাম। নাম ‘কাযান’ ক্যাথিড্রাল। (চলবে)
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম র হ ট ল ব র পথ
এছাড়াও পড়ুন:
ভয়াবহ আগুন কলকাতার বড়বাজারে, ঘটনাস্থলে দমকলের ২০ ইঞ্জিন
কলকাতার পুলিশ হেডকোয়ার্টার লালবাজারের কাছে বড়বাজারের এজরা স্ট্রিটের একটি গুদামে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। শনিবার ভোর রাতে আগুন লাগলেও সেই আগুন সকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বরং দ্রুত আগুন ছড়াচ্ছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে দমকলের অন্তত ২০টি ইঞ্জিন। ল্যাডারের সাহায্য নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ইঞ্জিনের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা হতে পারে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, শনিবার ভোর ৫টা নাগাদ গুদামে আগুন লেগে যায়। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং প্রচুর বৈদ্যুতিক তার ছিল গুদামে। মজুত করা ছিল অনেক দাহ্য পদার্থ। ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভালো করে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে আকাশ। চারদিক ঢেকে যায় কালো ধোঁয়ায়। কীভাবে এই আগুন লাগল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বৈদ্যুতিক সামগ্রী থেকেই আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। কেউ কেউ শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনার কথা বলছেন।
আরো পড়ুন:
ভারত যাচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
চীন সীমান্তের পাশে নতুন বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছে ভারত
যদিও ফায়ার সার্ভিসের তরফে সূত্রপাত সম্পর্কে এখনও কিছু নিশ্চিত কিছু জানাতে পারেনি, তারা আগুন নেভাতেই এখনো পর্যন্ত ব্যস্ত। পুলিশ ও দমকল সূত্রে খবর, ভোরে ওই গুদাম থেকে কালো ধোঁয়া বার হতে দেখে স্থানীয়রাই দমকলকে জানান। ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। গুদাম থেকে পাশের আবাসনেও ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। একাধিক বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবর। ভিতরে কেউ আটকে পড়েছেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে দমকলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। তাদের অভিযোগ, দমকলে খবর দেওয়া হলেও তারা দেরিতে এসেছে। ফলে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন দমকলকর্মীরা। মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের।
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ