চুল নিধনের ক্ষুর–কাঁচি যে কারণে বেপরোয়া
Published: 30th, September 2025 GMT
দেশজুড়ে মাজার ভাঙা, ফকির-সাধু ব্যক্তিদের জোর করে চুল কেটে দেওয়া, নারীদের প্রতি আক্রমণ বা হেনস্তার মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চিন্তক ও কবি ফরহাদ মজহার যথার্থ বলেছেন, মাজার ভাঙার ঘটনায় সরকার অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে, এমন প্রমাণ নেই (প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫)। এ কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
সরকারের নির্লিপ্ততা ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রধানতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অপরাধীদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা বেশ অনুকূল সরকার পেয়েছে। সরকার এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিন্দা জানানোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
ইতিমধ্যে সরকারের প্রেস সচিব বলেছেন, সরকারের নিন্দা জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব (ঢাকা ট্রিবিউন; ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)। মনে রাখতে হবে, নিন্দা জানানোর মধ্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ‘সরকারের নিন্দা’ জনগণের কাছে এক নতুন রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে মানবাধিকার সুরক্ষায় জনগণ এক নির্লিপ্ত বাংলাদেশ দেখছে!
আরও পড়ুন‘আল্লাহ তুই দেহিস’: চুল-দাড়ি কেটে দেওয়ার এই জুলুম কে থামাবে২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫মানবাধিকার সামষ্টিক এবং ব্যক্তিক অধিকার বটে। কোটি মানুষের মানবাধিকার এবং একজন ব্যক্তির মানবাধিকার সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই অর্থে নুরাল পাগলা বা ফকির হালিম উদ্দিন আকন্দের মানবাধিকারও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নুরাল পাগলার চিন্তাচর্চায় যদি কোনো আপত্তি থাকে, তবে তা উন্নত চিন্তা দিয়ে কাউন্টার করতে হবে। তাই বলে বহু চিন্তার বিনাশ কিছুতেই কাম্য নয়। এসব ঘটনা সমাজের ক্ষয় ও ক্ষরণের রুগ্ণ চিত্র ফুটিয়ে তুলছে।
ফকির হালিম উদ্দিন আকন্দের চুলগুচ্ছ তাঁর বিশেষ চিহ্ন, বিশেষ পরিচয় ও চর্চার ধারক। জোর করে হালিম উদ্দিন আকন্দের চুল কাটা, তথাকথিতভাবে তাঁকে স্বাভাবিক অবয়বে আনার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। হালিম উদ্দিন আকন্দ বা নুরাল পাগলার যে পছন্দ, সেটিই তাঁদের মানবাধিকার। ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ও পরিচয় কেউ নির্মাণ করে দেয় না। সুতরাং তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। মূলকথা হলো অন্যরা যা দেয় না, তা কেড়ে নিতে পারে না।
এ দেশের মানুষ ঘনসমাজে বাস করে। ফলে যারা এসব অপকর্ম করছে, তারা খুব অপরিচিত নয়। কিন্তু এদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি দেখে ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়ার আশাও উবে যাচ্ছে। ফকির হালিম উদ্দিন আকন্দকে বলতে হচ্ছে ‘আল্লাহ, তুই দেহিস’। এই গভীর আস্থাহীনতা ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করছে।সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খানের কাছে শোনা একটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক। একজন যৌনকর্মীকে এক সংঘবদ্ধ চক্র জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এ ঘটনা প্রকাশ পেলে সাংবাদিকেরা ওই ভুক্তভোগীর কাছে যান। ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যৌনকর্মী ১০ টাকায় কাম করি, আমাকে জোর করল ক্যান?’ ব্যক্তির এই যে পছন্দ বা সিদ্ধান্ত, সেটিই মানবাধিকার। মানবাধিকার সবার জন্য, সবখানে, সমানভাবে। মানবাধিকার অবিভাজ্য ধারণ। ভোটের অধিকার নিশ্চিত হবে কিন্তু ভিন্নমত চর্চার অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে, তা হয় না। মানবাধিকার সব অধিকারের সমষ্টি।
ফকির–সাধুদের চুলগুচ্ছ বা মাজার যে বিশাল শক্তির আধার, তা আজ প্রমাণিত হচ্ছে। এটি প্রমাণ করছে দঙ্গল বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা। ফকির–সাধুদের চুলগুচ্ছ অন্যদের জন্য আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠছে। ক্ষুর, কাঁচি আর ট্রিমার নিয়ে নেমে পড়েছে চুল নিধনে। তাদের দোসর আনুগত্যশীল সরকার। এ বিশেষ বাহিনীর ফকির–সাধুদের কেবল দৃশ্যমান চুলে অস্বস্তি, অদৃশ্য চুলের প্রতি কোনো মনোযোগ নেই!
হালে আরেকটি খবর চাউর হয়েছে। কিছু সংগঠন ও উদ্যোক্তা নাকি চুল কেটে তার ভিডিও প্রচার করছে ভিউ–বাণিজ্যের আশায়। ফ্যাক্টচেকাররা বলছেন, এর ভেতর রয়েছে ভিউ–বাণিজ্যের বিশেষ দিক।
এ দেশের মানুষ ঘনসমাজে বাস করে। ফলে যারা এসব অপকর্ম করছে, তারা খুব অপরিচিত নয়। কিন্তু এদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি দেখে ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়ার আশাও উবে যাচ্ছে। ফকির হালিম উদ্দিন আকন্দকে বলতে হচ্ছে ‘আল্লাহ, তুই দেহিস’। এই গভীর আস্থাহীনতা ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করছে।
সিনিয়র সাংবাদিক মীর মাসরুর জামানের কাছে শোনা একটি গল্প। তিনি মানবাধিকারের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্পটি শেয়ার করেন। তা হলো রাম বনবিহারে বেরিয়েছেন। পথের মধ্যে তাঁর পিপাসা পেল। হাতে রাখা ফলাটি মাটিতে গেঁথে ঝরনায় গেলেন পানি পানের জন্য। ফিরে এসে ফলাটি তুললেন। দেখলেন, অগ্রভাগে এক ফোঁটা রক্ত। রক্ত দেখে রাম আহত হলেন। মাটি খোঁড়া শুরু করলেন। দেখলেন মাটির নিচে ছোট্ট একটি ব্যাঙাচি।
রাম বললেন, ‘তুমি বললে না কেন যে এখানে আছ?’ ব্যাঙাচি বলল, ‘আমরা যখন বিপদের আশঙ্কা করি, তখন রামকেই স্মরণ করি। স্বয়ং রাম যখন ফলা গাঁথছেন, তখন কার কাছে সাহায্য চাইব!’ অর্থাৎ একটি নির্লিপ্ত সরকারের পদক্ষেপহীনতা যখন অপরাধীদের উৎসাহিত করছে, তখন বাউল ফকিরেরা কার কাছে প্রতিকার চাইবেন? এমন পরিস্থিতিতে ফকির হালিম উদ্দিন আকন্দকে নৈরাশ্যের পথ দেখতে হচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রতিটি সত্তা স্বতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র্যের ভেতর ঐক্য থাকে, যাকে তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়াম বলেছেন ফিলিং স্ট্রাকচার মানে বিনি সুতার মালা। এ বিনি সুতার মালা দিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলো তৈরি ও বাঁধা। মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মবিশ্বাসসহ নানা পরিচয় নিয়ে এক সমাজে বাস করে। সমাজ হয়ে ওঠে বহুমুখিতার সমষ্টি। কিন্তু বহুত্ববাদের অভ্যস্ততায় মানুষ যখন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে, তখন সমাজে বিপদ নেমে আসে। আজকের সমাজ সেই অন্ধকারের অভীমুখীন।
অন্যের বিশ্বাস সবচেয়ে অনুন্নত ও অপরিশুদ্ধ, এ সনদ কে দিল? বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ববোধ অবৈধ কর্তৃত্ব তৈরি করে। এ অবৈধ কর্তৃত্ব জন্ম দেয় একদল শাখামৃগের। যারা এক হৃদয়হীন সত্তা। সমাজে সেই অবৈধ কর্তৃত্বের স্বরূপ দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা অন্যদের নিজেদের বিশ্বাসের উপযোগী করে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে। সবাইকে নিজেদের আদলে সাজাতে চাইছে। ভিন্নমত বা আদর্শ তাদের কাছে অস্বস্তিকর।
এর কারণ, ফকির–সাধু ব্যক্তিদের লম্বা চুল, জটবাঁধা চুল তাদের অস্বস্তি উৎপাদন করে। তারা ফকির–সাধক ব্যক্তিদের পরিশুদ্ধ করতে চায়, নিজেদের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চায়। সমাজে এ দঙ্গলের সংখ্যা কম নয়।
এসব ভয়ংকর দঙ্গলের শাসনে পড়েছে ভিন্নমতাদর্শ, চিন্তা ও চর্চাকেন্দ্র। ভিন্নমতাদর্শ বা চর্চার কেন্দ্রগুলোর সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু ছোট সংখ্যা দেখে তারা ভয় পাচ্ছে। আমেরিকান তাত্ত্বিক অর্জুন আপাদুরাই তাঁর ফেয়ার অব স্মল নম্বর গ্রন্থে বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। মতাদর্শিক পরিশুদ্ধকরণ বা বড়করণ প্রক্রিয়ায় বড়রা ছোটদের দেখে বেশি ভয় পায়। সংখ্যায় নগণ্য মাজার, বাউল ফকির ও সাধকেরা তাদের কাছে ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে।
মানবাধিকার জিতলে সবাই জিতে যায়, যেমন মুসলিম, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ। সমস্যা হলো মানুষ একাই জিততে চায়, কখনো কখনো গোষ্ঠী বা বিশ্বাস নিয়ে জিততে চায়। মোদ্দা কথা, সবাই জিততে না পারলে এককভাবে কেউ জিততে পারে না। সেই অর্থে মানবাধিকার পৃথিবীর অন্যতম মৌলিক দর্শন। মানবাধিকার সব সত্তাকেই ধারণ করে। মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য যা প্রয়োজন, তার সবই মানবাধিকারের অংশ।
মানুষকে খেয়ে ফেলার সবচেয়ে উর্বর সময় চলছে পৃথিবীজুড়ে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ সভায় ভাষণে বলেছেন, দুনিয়াজুড়ে স্বচ্ছতার পরিধি কমে আসছে আর বাড়ছে কবরের পরিধি। দুনিয়াজুড়ে শাসকগোষ্ঠী মানুষের সক্রিয় অস্তিত্বকে, ভিন্নমত বা আদর্শকে ভয় পাচ্ছে।
কথা হলো স্পিরিচুয়ালি মানুষকে নিঃশেষ করা যাচ্ছে না। জীবনের অধিকার, মানবিক মর্যাদার অধিকার আজ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানবাধিকারের ধারণা বিকশিত, সুরক্ষিত এবং পূর্ণতা পেলেই নাগরিক অধিকার অর্জিত হবে। মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকাই মুখ্য। প্রতিটি মত, বিশ্বাস, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসহ সব পরিচয়ের মানুষের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দোহাই, কানে পানি তুলুন, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা করুন।
খান মো.
রবিউল আলম যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম নব ধ ক র স র ম নব ধ ক র অপর ধ দ র র স রক ষ ভ ন নমত সরক র র বল ছ ন র জন য এমন প
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২৯
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কয়েকটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় বুধবার দিনভর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ধারালো চাকু, দুটি লোহার রড, একটি সাইকেল ও ৩০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত মামলা, মাদক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন হীরা (১৯), রফিক (২১), আবদুর রহমান (৩৯), নাবিদ হাসান ওরফে চয়ন (২৬), খোকন (৩১), মনসুর (৩৫), জুয়েল (৩২), সানজু (২২), মিলন (৪২), শাওন (৩৬), নোয়াজ শরীফ (২৮), সেলিম (৩৪), আসাদুজ্জামান ওরফে ইমন (২৩), আনোয়ার হোসেন (৩৬), সজল (৩০), বরকত গাজী (২৮), জুয়েল (৩৮), আরমান (৩০), বাদল (৩৮), কোরবান (২৮), নয়ন (২৭), মাসরুফ (২৩), আল আমিন (২৭), রাকিব (১৮), মিলন (২৫), ওয়াজিদ (৩৬), এরশাদ (২৫), ছালাম ওরফে সামাদ (৩৭) ও দিলসার (৩০)।