৯৫ শতাংশ সাবানই দেশে তৈরি হয়
Published: 30th, September 2025 GMT
শিল্পবিপ্লবের পর অন্যান্য পণ্যের মতো সাবান–বাণিজ্যেও অগ্রগতি দেখা যায়। ১৭০০ সালে শুধু যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরেই ৬৩টি সাবান কোম্পানি ছিল। সে সময় দ্রুতই চাঙা হয়ে উঠছিল ঔপনিবেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতি। সরাসরি সাবান আদান-প্রদান ছাড়াও সাবান তৈরির উপকরণ এবং প্রণালির আদান-প্রদান হচ্ছিল দেশগুলোর মধ্যে। ১৭৯১ সালে সাধারণ লবণ থেকে সোডা অ্যাশ তৈরির সহজ উপায় বের করেন ফরাসি বিজ্ঞানী নিকোলা লেব্লাঙ্ক। এর সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে যায় সাবানের দাম। কারখানার যুগে ছোট ছোট কারখানায় বড় বড় মেশিনে একসঙ্গে হাজার হাজার সাবান তৈরি হতে লাগল।
বাংলাদেশে সাবানশিল্পের সূচনা
১৯০৩ সালে ঢাকার গেন্ডারিয়াতে ‘বুলবুল সাবান ফ্যাক্টরি’ নামে একটি সাবানের কারখানা স্থাপন করা হয়। ১৯০৪ সালে কলকাতায় ‘বেঙ্গল সাবান ফ্যাক্টরি’ স্থাপন করা হয়। সে সময় অখণ্ড ভারতের অলিগলি থেকে শোনা যাচ্ছিল ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আওয়াজ। বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক ভাসছিল বাতাসে। নিজ ভূমিতে তৈরি শিল্প এবং পণ্য ব্যবহারে সচেতনতা নিয়ে ১৯০৫ সালে শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন। এ সময় বিদেশি সাবান বাদ দিয়ে দেশি সাবান ব্যবহার করতে শুরু করেন উচ্চবিত্ত থেকে সাধারণেরা।
দেশীয় ব্র্যান্ডের উত্থান
ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় এ অঞ্চলের প্রথম সাবান কারখানা চালু করেন ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান খান। প্রতিষ্ঠানের নাম কমান্ডার সোপ কোম্পানি লিমিটেড। শুরুতে একধরনের সাবান তৈরি হতো কারখানাটিতে। সবুজ মোড়কে আঁকা এক নারীর ছবি আর হলুদ কালিতে ছাপানো সাবানের নাম—কসকো। গ্লিসারিনযুক্ত সাবানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
১৯৫৬ সালে ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি’। দেশে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়িক উপায়ে এবং শৈল্পিকভাবে সাবান ও প্রসাধনী তৈরি করতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের রূপসী কারখানায় ১৯৯৯ সালে মেরিল দিয়ে সাবানশিল্পে স্কয়ারের যাত্রা শুরু। এরপর উপস্থিত হয় ব্রিটিশ-ডাচ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান লিভার ব্রাদার্স (বর্তমানে ইউনিলিভার বাংলাদেশ)। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একটি সাবান কারখানা নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
৮০ বছর বয়সী গৃহিণী মাহমুদা হক। যিনি সংসারজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৬০–এর দশকে। মাহমুদা বলেন, ‘ভালো মানের এক বালতি সাবানের দাম ছিল এক টাকা কি দুই টাকা। কাপড় ধোয়ার জন্য একই সাবান গলিয়ে নিতাম। গুঁড়া সাবান এসেছে সম্ভবত ১৯৯০–এর দশকে।’
বর্তমান বাজার
দিন যত যাচ্ছে, দেশের বাজারে সাবানের চাহিদা ততই বাড়ছে। কোহিনূর কেমিক্যালের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (ব্র্যান্ড) গোলাম কিবরিয়া সরকার বলেন, সাবানের বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশ। দেশে সাবানের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। মোট চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশ সাবানই দেশে তৈরি হয়।
প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর অবস্থান
বর্তমানে সাবানের বাজারে ৫০টির বেশি দেশি–বিদেশি ব্র্যান্ড রয়েছে। দেশের সাবান সরবরাহকারী প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কোহিনূর কেমিক্যালস, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ভিটাক্যান ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কেয়া কসমেটিকস, এসিআই কসমেটিকস, রিমার্ক, কমান্ডার সোপ কোম্পানি এবং রেকিট বেঙ্কিজার।
বহুল ব্যবহৃত বিউটি সাবানগুলো হলো মেরিল, মায়া, কেয়া, স্যান্ডেলিনা স্যান্ডাল সোপ, তিব্বত, লাক্স, ডাভ, ভিটাকেয়ার, আইসকুল, লিলি, কিউট, কসকো ইত্যাদি। জীবাণুরোধী সাবানের মধ্যে ডেটল, লাইফবয়, সেপনিল, ব্যাকট্রোল, স্যাভলন, অ্যাকনোল ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। হাত ধোওয়ার তরল সাবানও তৈরি করছে ব্র্যান্ডগুলো। আরও আছে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট পাউডার এবং তরল সাবান।
আড়ং-এর আড়ং আর্থ সেগমেন্টেও আছে বেশ কয়েক ধরনের ভেষজ সাবান। বাংলাদেশের ত্বকের যত্ন এবং সৌন্দর্যপণ্য প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারকদের সমিতির (এএসবিপিএমবি) সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, বছরে প্রায় ১০০ হাজার টন সাবান বিক্রি হয় দেশের বাজারে। প্রতিনিয়তই চলছে গ্রাহকদের কাছে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরার চেষ্টা করছে ব্র্যান্ডগুলো। চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন হচ্ছে সাবানের রূপ। গ্রাহকের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয়ে উঠছে ব্র্যান্ডগুলো।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি।
পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।
আরো পড়ুন:
রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ
আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।
চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”
তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”
যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।
৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত
তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।
তৌকির বিশ্বাস করেন, “স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”
তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।
তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।
তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন
ঢাকা/মাসুদ