দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত উগ্র ধর্মীয় ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও একাত্তরে রক্তাক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রণীত হয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান। পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলো এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় ষড়যন্ত্র।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালে শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় সারা দেশে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হামলাকারীদের কেউ ধরা পড়েনি। রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংবিধানের চরিত্র পাল্টে দেওয়া হয়, পাল্টে যায় সংবিধানের মূল নীতিমালা। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে ছাঁটাই করা হয়, পরিবর্তিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তিও। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রণীত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন ১৯৭৪ সালে বাতিল হলেও নির্যাতনের আরও ভয়ংকর হাতিয়ার করে এই আইন ফিরিয়ে আনা হয়।

একদিকে মুক্তিযুদ্ধে যে স্বপ্ন জাতিকে আলোড়িত করেছিল তা পূরণ না হওয়া, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নানা পর্যায়ে আলোচনা করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৃথক কোনো সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়টি নিয়ে তখন একটি দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল, কেউ কেউ ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই ধরনের সংগঠনের জন্ম হলে বিভ্রান্ত সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন। কয়েকটি বৈঠক হয় নেতাদের মধ্যে।

শেষ পর্যন্ত স্থির হয় পূজা আঙ্গিকে প্রাথমিকভাবে শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হওয়ার কাজ শুরু হতে পারে। এতে বিভ্রান্তি কিংবা ভুল–বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ থাকবে না।

এ উদ্যোগে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার চিত্তরঞ্জন দত্ত বীরউত্তম (তখন ব্রিগেডিয়ার, পরে মেজর জেনারেল। বর্তমানে প্রয়াত), বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (প্রয়াত), পাকিস্তান সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব কমলভূষণ রায়চৌধুরী (কে বি রায়চৌধুরী, প্রয়াত), আইনজীবী ও সাবেক সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (পরে মন্ত্রী, প্রয়াত), আইনজীবী ও সাবেক সংসদ সদস্য সুধাংশু শেখর হালদার (প্রয়াত), বিচারপতি রণধীর সেন (প্রয়াত), বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর অসিতকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (প্রয়াত), ব্যারিস্টার সুধীর চন্দ্র দাস (প্রয়াত), বিশিষ্ট সমাজসেবী আর এন দত্তগুপ্ত (প্রয়াত), চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনিল কুমার নাথ, বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা চিত্তরঞ্জন সরকার, প্রকৌশলী প্রফুল্ল কুমার হাওলাদার (প্রয়াত) প্রমুখ।

১৯৭৮ সালে শারদীয় দুর্গাপূজার কয়েক মাস আগে স্থির হয়, এ উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ঢাকায় পূজার আয়োজন করা হবে। বর্তমান নতুন ঢাকায় সেভাবে দুর্গোৎসবের কোনো আয়োজন ছিল না। হাতে গোনা কয়েকটি পূজার খবর পাওয়া যায়। পুরান ঢাকায় কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, লালবাগে বেশ কয়েকটি পূজার আয়োজন হতো সর্বজনীনভাবে, পারিবারিক পূজা ছিল কিছু। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দশভুজার নিত্যপূজা হতো, দুর্গাপূজায় ছিল কিছু বাড়তি আয়োজন।

এই প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তারা গঠন করেন মহানগর সার্বজনীন কেন্দ্রীয় পূজা কমিটি। সভাপতি নির্বাচন করা হয় কে বি রায়চৌধুরীকে, সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সরকার। পরে অবশ্য কমিটির নাম থেকে কেন্দ্রীয় শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। পূজা কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপিত হয় মিরপুর রোডে কে বি রায়চৌধুরীর বাসায়।

সমস্যা দেখা দেয় পূজার জায়গা নিয়ে। উপযুক্ত ও বড় জায়গা না হলে দুর্গাপূজার মতো বড় উৎসবের আয়োজন বিশেষ করে উদ্যোক্তারা যেভাবে চাইছিলেন সেভাবে করা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত জায়গার খোঁজে উদ্যোক্তারা ছুটে আসেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। হেমচন্দ্র চক্রবর্তী (প্রদীপ চক্রবর্তী বাবুলের পিতা। দুজনেই বর্তমানে প্রয়াত) তখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সেবায়েত।

হেমচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে শিবমন্দিরের সামনের জায়গায় পূজার অনুমতি চান কমিটির নেতারা। সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। তাঁকে জানানো হয়, পূজা ও বিজয়া সম্মিলনীর পরপরই প্যান্ডেল সরিয়ে নেওয়া হবে। উপর্যুপরি অনুরোধে শেষ পর্যন্ত হেমচন্দ্র চক্রবর্তী শিবমন্দিরের সামনে পূজার অনুমতি দিলেন। এভাবেই ঢাকেশ্বরী অঙ্গন থেকে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যাত্রা শুরু হয়। শিবমন্দিরের সামনে দ্বিতীয় বছরও পূজার আয়োজন করা হয়।

এর পর থেকে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির পূজা মেলাঙ্গনে আয়োজিত হচ্ছে। তবে এই স্থানটি ঢাকেশ্বরীর দখলে ছিল না। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এই দেবোত্তর ভূমি উদ্ধার করা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ২০ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তির মধ্যে বর্তমানে ৮ বিঘার মতো সম্পত্তি রয়েছে। মেলাঙ্গনে আয়োজিত এই পূজাই সময়ের তাগিদে কেন্দ্রীয় পূজায় পরিণত হয়।

অবশ্য উল্লেখ করতে হয়, ঢাকায় মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি সংগঠিত হওয়ার পর সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায় এটাকে কেন্দ্রীয় সংগঠন ভাবতে শুরু করেন।

মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি গঠিত হয়েছিল শুধু পূজাকেই মুখ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করে নয়। এই উদ্যোগে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে আশি ও নব্বইয়ের দশকে লেখার প্রয়োজনে কয়েক দফা আলোচনা করেছিলাম। তাঁরা জানিয়েছিলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মূলত সংগঠিত হতেই তাঁরা এ প্রচেষ্টায় শামিল হন। কারণ, তখন কার্যত সেনাশাসন, অনেক কিছুই বলা যেত না। রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল। পূজায় মাতৃবন্দনায় চিরকালীন প্রার্থনা, অসুর বধের শক্তি দাও। এভাবেই ধ্বনিত হতো সত্য-সুন্দরের আকাঙ্ক্ষা। একপর্যায়ে সম-অধিকার, সমমর্যাদার দাবিও উচ্চারিত হয়। উচ্চারিত হয় বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিও। রাজনীতিতে না থেকেও অধিকারবোধের চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে।

উদ্যোক্তাদের পরিচিতির কারণে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি রাজধানী ঢাকা এবং সারা দেশের মানুষের কাছে কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। অনেক জেলায় পূজা কমিটি থাকলেও ধারণা করা হয়, এ ধরনের একটি সংগঠিত নেতৃত্বের প্রত্যাশা ছিল সারা দেশে, যা বটগাছ হিসেবে ছায়া দেবে।

এই প্রত্যাশার ধারাবাহিকতায় সারা দেশের পূজা সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে ১৯৮২ সালে ঢাকেশ্বরী অঙ্গনে জন্ম হয় বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের।

আট শ থেকে হাজার বছরের প্রাচীন ঢাকেশ্বরী মন্দির ইতিহাসের নানা উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছে। আক্রান্তও হয়েছে। ঢাকেশ্বরী এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। মূল মন্দিরে দেবী দশভুজা ঢাকেশ্বরী মাতারূপে পূজিত হন, মেলাঙ্গনে মহানগর মন্দিরেও একই কাঠামোয় ঐতিহ্য মেনে দশভুজা দুর্গা পূজিত হন। একই সময়ে পূজা, ভোগ ও আরতি হয়।

পূজাকে সামনে রেখে অধিকারবোধের চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি আয়োজিত পূজা এখন কার্যত দেশের কেন্দ্রীয় পূজায় পরিণত হয়েছে।

সরকারপ্রধান পূজায় আসেন, আসেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। আসেন সাংস্কৃতিক সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা। বিদেশি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা বাংলাদেশ সফরে এলে ঢাকেশ্বরী আসেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঐতিহাসিক মন্দিরের পাশাপাশি সংগঠিত সংগ্রামী ধারা ও প্রতিবাদী ঐক্যও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আজ সারা দেশে পূজা বাড়ছে। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার মধ্যেও পূজারিদের অদম্য মানসিকতা প্রশংসনীয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব তাঁদের সাহসী হতে সাহায্য করছে বলে ধারণা করি।

বাসুদেব ধর বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মন দ র র স উদ য ক ত ঢ ক শ বর কম ট র র জন ত সরক র স গঠন হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

এভাবে লুচি বানালে ফুলবেই ফুলবে, জেনে নিন রেসিপি

উপকরণ

ময়দা: ২ চামচ

আটা: দেড় চামচ

চিনি: ১ চা-চামচ

ঘি: ১ চা-চামচ

তেল: ১ চা-চামচ।

প্রণালি

সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। একটু গরম পানি দিয়ে ময়ান বানাতে হবে। ময়ান পাঁচ মিনিটের মতো মেখে রাখুন। তারপর লুচি বেলে ডুবোতেলে ভেজে নিতে হবে।

আরও পড়ুনপূজায় অপু বিশ্বাসের প্রিয় খাবার মহাষ্টমীর ভোগের থালা, দেখুন তাঁর দেওয়া রেসিপি৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ