পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্ব অধিদপ্তর নেবে কেন
Published: 30th, September 2025 GMT
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কাজ মূলত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও সংস্কার এবং পাঠ্যবই তৈরি ও বিতরণ। বছরের পর বছর ধরে গঠনতন্ত্র মেনেই প্রতিষ্ঠানটি এসব কাজ করে আসছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মুদ্রণ ও বিতরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। দুই-আড়াই বছর ধরেই এই চেষ্টা চলছিল; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তা বাস্তবায়নের পথে যাবে, এমনটি ভাবা যায়নি।
পাঠ্যবই প্রকাশের ক্ষেত্রে এনসিটিবি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দক্ষ লোকবলের অভাব ও নীতিনির্ধারণে দুর্বলতার কারণে এনসিটিবি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।
কয়েক বছর ধরে পাঠ্যবই যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বই তৈরি থেকে বিতরণ পর্যন্ত কাজের বিভিন্ন ধাপে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ রকম আরও অনেক দুর্বলতা ও ঘাটতি দেখানো যাবে। কিন্তু এসব অজুহাতে প্রাথমিকের বই ছাপানো ও বিতরণের দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নেওয়া ঠিক হবে না।
নতুন প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, এনসিটিবি কেবল মাধ্যমিকের বই ছাপা ও বিতরণের কাজ করবে। এ ছাড়া শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও সংস্কারের দায়িত্বও থাকবে তাদের হাতে। কিন্তু এভাবে এনসিটিবির দায়িত্ব অংশত ভাগ করে দিলে বই তৈরি ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা না বাড়িয়ে একে দুর্বল করার যেকোনো সিদ্ধান্ত সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বই ছাপানো ও বিতরণের দায়িত্ব দিলেই বিদ্যমান সমস্যাগুলো ভোজবাজির মতো উড়ে যাবে, ব্যাপারটি এমন নয়। এটি করা হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে এনসিটিবির কাজের সমন্বয়হীনতা আরও বাড়বেএনসিটিবির একটি পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। এর পাঁচটি বিভাগ: প্রশাসন, অর্থ, শিক্ষাক্রম, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক। একজন চেয়ারম্যানের অধীন এই পাঁচটি বিভাগ পরিচালিত হয় সচিব অথবা সদস্যের মাধ্যমে। এসব শাখা আবার একাধিক উপশাখায় বিভক্ত। যেমন পাঠ্যপুস্তক শাখার চারটি উপশাখা—শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখা, উৎপাদন শাখা, ভান্ডার শাখা এবং বিতরণ শাখা। শাখাগুলো পরস্পরের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে থাকে।
আরও পড়ুনপাঠ্যপুস্তক কেমন হবে এবং কারা লিখবেন২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪পাঠ্যবই লেখা হয়ে গেলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেগুলো সম্পাদনা ও অলংকরণের প্রয়োজন হয়। এরপর দরপত্র আহ্বান করে বইয়ের চূড়ান্ত কপি ছাপাখানায় পাঠাতে হয়। মুদ্রণকাজ চলার সময়ে বইয়ের মান যাচাই করতে হয়। ছাপা ও বাঁধাই শেষ হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই সরবরাহ করতে হয়। অতিরিক্ত বই আবার মজুত করে রাখতে হয়। এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক বিভাগ এগুলো সম্পন্ন করে।
বই ছাপানোর আগে-পরে আরও কিছু কাজ থাকে। যেমন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হয়। এর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। এসব কাজে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বাইরেও শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক এবং প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়।
এনসিটিবি মূলত দিনব্যাপী কর্মশালার মাধ্যমে এসব কাজ করে থাকে। এগুলোর বাইরেও এনসিটিবির দায়িত্ব রয়েছে। নতুনভাবে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হলে পরীক্ষামূলকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার কার্যকারিতা যাচাই করার দরকার হয়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ তৈরি করতে হয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হয়।
আরও পড়ুনবাংলা পাঠ্যপুস্তক: এলেম আমি কোথা থেকে২৩ অক্টোবর ২০২৪দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কাজ খুবই সুনির্দিষ্ট ও সুসংবদ্ধ। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এনসিটিবিতে কাজ করার সূত্রে দেখেছি, দলীয় সরকারের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দক্ষ ও মেধাবী লোকের বদলে অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ ও দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, কম্পোজ, অলংকরণ, গ্রাফিকস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও দক্ষ লোকের মারাত্মক অভাব রয়েছে। এমনকি পাঠ্যবই লেখা ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাইরে থেকে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের ক্ষেত্রেও আগে দলীয় পরিচয় যাচাই করা হয়! এনসিটিবি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের উঁচু মহল থেকে সব সময় একে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
এগুলো নিয়ে আগে ভাবা দরকার, চিন্তা করা দরকার কীভাবে এনসিটিবির সক্ষমতা বাড়ানো যায়। একে ভেঙে ফেলে কিংবা দুর্বল করে সমস্যার সমাধান হবে না। এনসিটিবিতে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে। বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান ভালো করার জন্য আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। এনসিটিবিকে স্বাধীনমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। সামগ্রিক শিক্ষা ক্ষেত্রে সফলতার জন্য জাতীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বই ছাপানো ও বিতরণের দায়িত্ব দিলেই বিদ্যমান সমস্যাগুলো ভোজবাজির মতো উড়ে যাবে, ব্যাপারটি এমন নয়। এটি করা হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে এনসিটিবির কাজের সমন্বয়হীনতা আরও বাড়বে। দেখে মনে হচ্ছে, বর্তমান সিদ্ধান্তের পেছনে বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব। এমনকি বিভিন্ন সময়ে এনসিটিবির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শাখার মধ্যেও দ্বন্দ্ব দেখেছি। এভাবে নিজেদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে, তবে সংকট আরও বাড়বে।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ও ব তরণ র এনস ট ব র বই ছ প ন প ঠ যবই ক জ কর দ র বল বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক জাতীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের উদ্যোগে ‘ভিশনএক্স: এআই পাওয়ার্ড ন্যাশনাল ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক জাতীয় প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ১৫ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১টি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এই প্রতিযোগিতার ‘ভিশনএক্স’-এ দুটি ট্র্যাক ছিল। বিজনেস আইডিয়া ট্র্যাকে ৪১টি উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক ধারণা উপস্থাপন করা হয়। প্রজেক্ট শোকেসিং ট্র্যাকে এআই–ভিত্তিক প্রকল্প ও উদ্ভাবন প্রদর্শন করা হয়।
আরও পড়ুনঅস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস ফেলোশিপ, ৬ খাতে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ৭ ঘণ্টা আগেপ্রতিযোগিতায় পুরস্কার—প্রতিযোগিতার প্রজেক্ট শোকেসিং ট্র্যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি প্রথম রানার্সআপ এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়। বিজনেস আইডিয়া ট্র্যাকে লিডিং ইউনিভার্সিটি ও শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চ্যাম্পিয়ন হয়। এই ট্র্যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম রানার্সআপ ও শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়। প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন দল ১ লাখ টাকা ও ২ দিনের ব্যাংকক ভ্রমণ, প্রথম রানার্সআপ দল ৮০ হাজার টাকা ও কক্সবাজার ভ্রমণ এবং দ্বিতীয় রানার্সআপ দল ৫০ হাজার টাকা ও কক্সবাজার ভ্রমণের সুবিধা পেয়েছে।
প্রতিযোগিতায় অতিথি ছিলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুনমেডিকেল-ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষা : দেখে নিন আবেদনের নিয়মাবলি১৩ নভেম্বর ২০২৫কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. উপমা কবির এবং ইউএস–বাংলা গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
অতিথিদের কথা—উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও মননশীলতার চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
আরও পড়ুননিউজিল্যান্ড আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যে নতুন সুযোগ দিল ১৬ নভেম্বর ২০২৫বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সরকারি অর্থের অপচয় রোধ এবং জনস্বার্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, তাত্ত্বিক জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি এর প্রায়োগিক সফলতা নিয়েও কাজ করতে হবে।
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তরুণেরা বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশাবাদী।