Prothomalo:
2025-11-17@06:58:25 GMT

মাতৃরূপে ঈশ্বরের উপাসনা

Published: 30th, September 2025 GMT

ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের গবেষণা, যা–ই বলুক না কেন, সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, সভ্য মানুষ যখন প্রথম ঈশ্বরের কল্পনা করেছিল, অথবা মানুষ যখন তার চেয়ে উচ্চতর বা ঊর্ধ্বতর কোনো অলৌকিক অথবা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রথম কল্পনা করেছিল, তখন সে ঈশ্বরকে অথবা সেই অতিমানবিক শক্তিকে নারী হিসেবেই ভেবেছিল। আমাদের মনে হয়, মানবেতিহাসে ঈশ্বর–ধারণার সে–ই সূচনা৷

বলা বাহুল্য, মানুষের মানসচক্ষে ঈশ্বরের যে রূপটি তখন ভেসে উঠেছিল, তা ছিল স্বাভাবিকভাবেই তার আপন গর্ভধারিণীরই এক মহত্তর, আদর্শায়িত রূপকল্প। অর্থাৎ সভ্য মানুষের চিন্তায় ঈশ্বর সম্ভবত মাতৃরূপেই প্রথম কল্পিত হয়েছেন।

আমরা নিছক কল্পনার ডানায় ভর করে এ কথা বলছি তা নয়। আমাদের ধারণার ভিত্তি অবশ্যই আছে। মানবসভ্যতার প্রাচীনতম সাহিত্য বা মানুষের প্রাচীনতম ‘লিপিবদ্ধ ইতিহাস’ ঋগ্‌বেদে আমরা এর সমর্থন পাচ্ছি। ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্তটি ‘দেবীসূক্ত’ নামে প্রসিদ্ধ।

মানবসভ্যতার প্রভাতে উচ্চারিত এই সূক্তে আমরা ঋষি অম্ভৃণের কন্যা ঋষি বাকের উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হই। ঋষি বাক উপলব্ধি করেছিলেন: জগৎ-প্রপঞ্চের পেছনে জগৎ-কারণরূপে যিনি অবস্থান করছেন, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে বা ইচ্ছানুসারে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি পরিচালিত হচ্ছে; যাঁর প্রভাব ব্যতীত রুদ্র তাঁর ধনুকে জ্যা বসাতে অসমর্থ; ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর মধ্যে যিনি ওতপ্রোতভাবে অনুস্যূত ও পরিব্যাপ্ত এবং তার বাইরেও যিনি বিদ্যমান, তিনি একজন নারী। তিনিই জগতের ঈশ্বরী, আদ্যাশক্তি। দেবীসূক্তের পরেই ‘রাত্রিসূক্ত’। ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৭তম সূক্তটিই প্রসিদ্ধ ‘রাত্রিসূক্ত’।

এই সূক্তে তৎকালীন মানুষের যে পরিচয় আমরা পাই, সে মানুষ হিংস্র প্রাণী ও দুর্ধর্ষ দস্যুর পীড়নে আর্ত ও সন্ত্রস্ত; শত্রুর (অসুরের?) আক্রমণের আশঙ্কায় সদা উদ্বিগ্ন। শঙ্কাহীন, নিরুদ্বেগ জীবন ও শত্রুনাশের জন্য তারা তাই ব্যাকুলভাবে প্রার্থনায় রত।

স্মরণাতীতকালে আমাদের এই অগ্রজদের প্রার্থনা কার কাছে? কার উদ্দেশে তাঁরা নতজানু? রাত্রিসূক্তের ঋষি কুশিকের ভাষায়—তিনি হলেন সর্বব্যাপিনী, বিশ্ববিধাত্রী, বিশ্বত্রাত্রী, বিশ্বপ্রসবিত্রী, জগৎ-প্রকাশিকা আদ্যাশক্তি। ঋষি তাঁকে ‘রাত্রি’ নামে অভিহিত করেছেন।

ভাষ্যকারদের মতে, ‘রাত্রি’ শব্দের অর্থ ‘অভীষ্টদাত্রী’। শুধু ঋগ্বেদেই নয়, সামবেদেও ‘রাত্রিসূক্ত’ আছে। সেখানেও দেখা যায়, আদ্যাশক্তির আদেশে সূর্য, বায়ু, বরুণ ও পৃথিবী নিজ নিজ ভূমিকা পালন করছেন। অসুরবধের জন্য, অমঙ্গলনাশের জন্য তিনি বারবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।

যজুর্বেদ ও অথর্ববেদেও বিভিন্ন স্ত্রী-দেবতার উল্লেখ রয়েছে। বেদের আরণ্যক, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ অংশেও বহু স্ত্রী দেবতার নাম পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, দেবীসূক্তের বাক্ এবং রাত্রিসূক্তের রাত্রি–পরবর্তীকালে যথাক্রমে সরস্বতী ও কালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

ঋগ্‌বেদের পরিশিষ্টভুক্ত ‘শ্রীসূক্ত’-এর মধ্যে ঋগ্‌বেদের শেষের দিকের শক্তিভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, ‘শ্রীসূক্ত’-এর শ্রী পরবর্তীকালে লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

বৈদিক যুগের পর মহাভারত ও পুরাণে স্ত্রী-দেবতার আরাধনা এক উল্লেখযোগ্য আকার ধারণ করে। পাশাপাশি বিশাল তন্ত্রসাহিত্যের মধ্যেও শাক্ত আরাধনা প্রবলভাবে বিকশিত হয়। ‘তন্ত্রসাহিত্য’ বলতে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মীয় সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারাকে বোঝানো হলেও, ‘তন্ত্র’ বলতে সাধারণত শাক্ত ধর্মীয় সাহিত্যকেই বোঝায়। তবে শাক্ত তন্ত্রসাহিত্য বা তান্ত্রিক ধারার কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

কেউ কেউ তন্ত্রকে বৈদিক যুগের সমসাময়িক, এমনকি তারও প্রাচীন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে তন্ত্রসাহিত্যের কাল সম্ভবত অতটা প্রাচীন নয় এবং বহু তন্ত্র-গ্রন্থই পরবর্তীকালে রচিত। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে তন্ত্র সুপ্রাচীন না হলেও ধর্মীয় পদ্ধতি হিসেবে তন্ত্র যে যথেষ্টই প্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তন্ত্রসাহিত্যের সূচনা যখনই হোক না কেন, অন্তত দেড় হাজার বছর আগে হিন্দুদের ধর্মসাহিত্য ও ধর্মসাধনা প্রধানত বৈদিক ও তান্ত্রিক—এই দুই ধারায় বিভক্ত ছিল।

শুধু বৈদিক যুগেই নয়, প্রাক্-বৈদিক যুগেও মানুষ ঈশ্বরকে মাতৃরূপে উপাসনা করত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত সুপ্রাচীন (পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম?) সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় যে ওই দুই প্রাচীন নগরের অধিবাসীদের প্রধান উপাস্য ছিলেন স্ত্রী দেবতারা।

তান্ত্রিকপদ্ধতির বীজ কি সেখানেই নিহিত ছিল? কে জানে! তবে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে যেসব স্ত্রী দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে, সেগুলোকে নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের শক্তিমূর্তিগুলোর আদিরূপ বলা যেতে পারে। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, ওই মূর্তিগুলো প্রধানত শস্য, প্রাণশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীকস্বরূপিনী মাতা বসুন্ধরা বা পৃথিবীর প্রতিমূর্তি।

শুধু ভারতের প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার ইতিহাসই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, ঈশ্বরকে মাতৃরূপে উপাসনা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই উদ্ভূত।

‘স্বাভাবিক প্রবণতা’ কেন বলছি? পৃথিবীর আলোয় মানুষ প্রথম যাঁকে দেখে, তিনি মা। তাই বোধ হয় আমাদের কণ্ঠ-উৎসারিত প্রথম শব্দটিও ‘মা’। একমাত্র মায়ের সঙ্গেই মানুষের ‘নাড়ি’র সম্পর্ক। এই সম্পর্ক যেমন জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) অর্থে সত্য, তেমনি মানসিক (মেন্টাল), মনস্তাত্ত্বিক (সাইকোলজিক্যাল) এবং আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল) অর্থেও সত্য। সব অর্থেই মানুষ মায়ের সঙ্গেই সর্বাপেক্ষা নিকট–সম্পর্কযুক্ত।

সে কারণেই জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের চরিত্রে মায়ের প্রভাব—জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে, সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। শিশুর সবচেয়ে বড় নির্ভরতা মা-ই, মা-ই তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত জন। যখন সে ভয় পায়, তখন মায়ের কোলেই আশ্রয় খোঁজে; যখন আনন্দ পায়, তখন সবার আগে মাকেই সেই আনন্দের ভাগীদার করতে চায়।

দুঃখ বা আনন্দে, ভয় কিংবা উদ্বেগে—মাকেই সে প্রথম খোঁজে। মায়ের সঙ্গে এই সম্পর্কের কারণেই দেখা যায়, মা যখন শিশুসন্তানকে দুষ্টুমির জন্য মারেন, তখন এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে অন্য হাতে শিশুটি মাকেই জড়িয়ে ধরে। কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—যে হাত তাকে আঘাত করেছে, সেই হাতই পরক্ষণে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে; আর যে চোখ ও মুখ এতক্ষণ ক্রোধে জ্বলছিল, সেই চোখই কয়েক মুহূর্ত পরে জলে ভাসবে এবং সেই মুখই তার অশ্রুলিপ্ত মুখকে চুম্বনে ভরিয়ে দেবে।

বস্তুত, মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বা শ্রদ্ধা করে, অথবা যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা অর্পণ করতে চায়, তার মধ্যে সম্ভবত সে অজ্ঞাতসারে নিজের মাকেই দেখতে চায়। এটিই মানুষের সহজাত মনস্তত্ত্ব। সভ্য মানুষ যখন ইতিহাসের উষালগ্নে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিল, তখন তার ভাবনায় বোধ হয় এই মনস্তত্ত্বই ক্রিয়াশীল ছিল।

যাহোক, ঈশ্বরের মাতৃরূপের এই ভাবনা ভারতবর্ষে প্রাক্-বৈদিক, বৈদিক, তান্ত্রিক ও পৌরাণিক—এই চার প্রধান ধারায় অভিব্যক্ত হয়েছে। বৈদিক ভাবনা পরবর্তীকালে উপনিষদে ক্রমবিবর্তিত হয়ে যে রূপ লাভ করেছিল, তারই উত্তরোত্তর প্রকাশ দেখা গেছে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ ও উপপুরাণগুলোতে। পাশাপাশি প্রাক্-বৈদিক যুগে দেবীভাবনার ধারণা একটি স্বতন্ত্র ধারায় বিকাশ লাভ করছিল।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আমরা যাকে ‘তন্ত্র’ বলে জানি, তার উৎস নিহিত আছে প্রাক্-বৈদিক যুগের দেবীভাবনায়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু আরেকটি ধারা ছিল। সেটি হলো আদিবাসী, উপজাতি ও সমাজের নিম্নবর্ণের মধ্যে প্রচলিত লোকায়ত ধারা। পরবর্তীকালে প্রতিটি ধারাই একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, একের মধ্যে অন্যের চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভারতের সর্বত্রই এই সংমিশ্রণ ও পারস্পরিক প্রভাব কমবেশি ঘটেছে।

বৈদিক সাহিত্যে দেবীকে অদিতি, উষা, অম্বিকা, উমা, সরস্বতী, দুর্গা, সাবিত্রী, পৃথিবী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হলেও ‘কালী’ ও ‘চণ্ডী’ নাম দুটি কোথাও পাওয়া যায় না। ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে, তবে সেখানে এটি কোনো স্ত্রী দেবতার নাম নয়; সেখানে ‘কালী’ অগ্নির সপ্ত জিহ্বার একটি নাম। স্ত্রী দেবতা হিসেবে ‘কালী’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। আর ‘চণ্ডী’র প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে পৌরাণিক দেবীরূপে সাহিত্যে। ‘চণ্ডী’ বা ‘চণ্ডিকা’ নামে তাঁকে সর্বাধিক অভিহিত হতে দেখা যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ‘দেবীমাহাত্ম্যে’, যা ‘চণ্ডী’ বা ‘দুর্গাসপ্তশতী’ নামে প্রসিদ্ধ।

‘কালী’ নামটিও সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। ক্রমে দুর্গা ও কালীকে সেখানে একই মহাদেবীর বিভিন্ন রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী কালে দুর্গা, কালী প্রভৃতি পরিচিত নামের পাশাপাশি অন্যান্য পুরাণ ও উপপুরাণে ‘চামুণ্ডা’, ‘উগ্রচণ্ডী’, ‘উগ্রচণ্ডিকা’ প্রভৃতি নাম আদ্যাশক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে। ধীরে ধীরে ‘চণ্ডী’ হয়েছেন ‘মঙ্গলচণ্ডী’—যিনি মানুষের সকল অশুভ ও অমঙ্গল নাশ করেন। তবে চণ্ডীর মঙ্গলচণ্ডী হয়ে ওঠা এক দিন বা এক যুগে হয়নি। এই বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৈদিক, প্রাক্-বৈদিক, তান্ত্রিক, পৌরাণিক ও লোকায়ত ঐতিহ্যের পারস্পরিক ক্রিয়া ও বিক্রিয়ার দীর্ঘ পর্ব।

এভাবে পৌরাণিক ধারা ও লোকায়ত ধারার মধ্য দিয়ে দেবী হয়ে উঠেছেন আমাদের পরিবারের অঙ্গ, আমাদের একান্ত কাছের মানুষ। দেবী ও মানবী ভাব মিশে আমাদের দেবীভাবনায় যুক্ত হয়েছে এক নতুন মাত্রা। অবশেষে হিন্দুর শক্তিভাবনায় দুটি নাম প্রধান স্থান লাভ করেছে দুর্গা ও কালী। এই দুই মায়ের মধ্যেই হিন্দুর ধর্মভাবনায় মাতৃরূপে ঈশ্বরের উপাসনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। আজ এই দুই দেবীর পূজাই ভারতবর্ষে, বিশেষত বঙ্গদেশে, হিন্দুদের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাতৃপূজা।

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ অধ্যক্ষ ও সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরবর ত ক ল যত র প র র জন য আম দ র তত ত ব কর ছ ল ত হয় ছ ভ বন য় হয় ছ ন উল ল খ প রথম সবচ য় র দশম

এছাড়াও পড়ুন:

রোনালদো কি সত্যিই বিশ্বকাপে ১-২ ম্যাচ মিস করবেন

পর্তুগাল আজ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ খেলবে আর্মেনিয়ার বিপক্ষে। ম্যাচটা পর্তুগিজদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জিতলে ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হবে, এমনকি ড্র করলেও সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু হারলে নেমে যেতে হতে পারে প্লে-অফের পরীক্ষায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে পাচ্ছে না পর্তুগাল। বৃহস্পতিবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে লাল কার্ড দেখায় আজ দর্শক হয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে।

তবে রোনালদো ও পর্তুগালের জন্য বড় বিপদ সামনে। লাল কার্ডের জন্য এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা সবাইকেই কাটাতে হয়। শাস্তির মূল পরিমাণ ঠিক কত ম্যাচের বা দিনের, সেটি অপরাধের মাত্রার ওপর নির্ভর করে পরে ঘোষণা করা হয়। আর এখানেই শঙ্কা রোনালদোকে নিয়ে।

আইরিশ ফুটবলার দারা ও’শেয়ারকে আঘাতের দায়ে রোনালদো যদি দুই থেকে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পান, তাহলে পর্তুগাল বিশ্বকাপে উঠলে গ্রুপ পর্বের একটি বা দুটি ম্যাচই তিনি মিস করবেন। আর গ্রুপ পর্বে ম্যাচ যেহেতু মাত্র তিনটি, দল আগেভাগে খারাপ করে বিদায় নিশ্চিত হলে রোনালদোর বিশ্বকাপ শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি কি সত্যিই তৈরি হতে পারে? রোনালদোর বিশ্বকাপে ১-২ মিস করার সম্ভাবনা কতটুকু? ২০২৬ বিশ্বকাপ শুরু হবে জুনে, যা এখনো ছয় মাসেরও বেশি সময় বাকি। এর মধ্যে পর্তুগাল ম্যাচও খেলবে। আর রোনালদোকে আসলে কত ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কাটাতে হবে, সেটি জানা যাবেই–বা কবে?

রোনালদোর অপরাধ কী ছিল

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের ৬১তম মিনিটে ও’শেয়ারকে কনুই দিয়ে মেরেছেন রোনালদো। রেফারি গ্লেন নাইবার্গ এ ঘটনায় তাঁকে হলুদ কার্ড দেখান। তবে ভিএআরে ঘটনা পর্যালোচনার পর রেফারি সিদ্ধান্ত পাল্টান, দেখান লাল কার্ড। রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত বদলের অর্থ হচ্ছে, রেফারির কাছে ঘটনাটি গুরুতরই মনে হয়েছে।

শাস্তি কী

লাল কার্ডের ন্যূনতম শাস্তি এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা। এরপর ফিফার ডিসিপ্লিনারি কমিটি ঠিক করে সেটি এক ম্যাচে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাড়বে। বাড়লে কতটা? ফিফা তাদের শৃঙ্খলাবিধির ১৪.১ ধারা অনুসারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই ধারার ‘ই’ অনুচ্ছেদ অনুসারে, গুরুতর ফাউল খেলার জন্য দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এই নিয়মটি বল দখলের জন্য অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক চ্যালেঞ্জের আওতায় পড়ে।

উদাহরণ হিসেবে অঁরেলিয়ে চুয়ামেনির কথা বলা যেতে পারে। রিয়াল মাদ্রিদের এই মিডফিল্ডার সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের হয়ে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে সরাসরি লাল কার্ড দেখেছিলেন। এ ঘটনায় তাঁকে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়—একটি লাল কার্ডের জন্য, অন্যটি গুরুতর ফাউলের জন্য।

পর্তুগালের জন্য বিপদ হচ্ছে রোনালদোর পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে। ফিফা আইনের অধীনে তাঁর কনুই মারাকে সহিংস আচরণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। অনুচ্ছেদ ১৪.১ ধারার ‘এইচ’ এবং ‘আই’ অনুচ্ছেদে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার কথা বলা আছে।

এইচ. সহিংস আচরণের জন্য কমপক্ষে তিন ম্যাচ।
আই. আক্রমণাত্মক আচরণের জন্য কমপক্ষে তিন ম্যাচ বা উপযুক্ত সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা, যার মধ্যে কনুই মারা, ঘুষি মারা, লাথি মারা, কামড়ানো, থুতু দেওয়া, বা কোনো খেলোয়াড় বা রেফারি নন এমন কাউকে আক্রমণ করা অন্তর্ভুক্ত।

যেহেতু রোনালদো আইরিশ ডিফেন্ডারকে কনুই দিয়ে আঘাত করেছেন, তাই তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার খড়্গে পড়তে পারেন, যার ফলে বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচ মিস করবেন তিনি। এর আগে চলতি মৌসুমের শুরুতে আর্মেনিয়ার তিগরান বারসেঘিয়ানকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক খেলোয়াড়কে সামান্য মাথা দিয়ে আঘাত করার দায়ে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ফিফা।

পর্তুগাল আজই বিশ্বকাপ নিশ্চিত করলে কী হবে

আজ আর্মেনিয়ার বিপক্ষে জিতলে বা ড্র করলে বিশ্বকাপের টিকিট কাটা হয়ে যাবে পর্তুগালের। এর অর্থ হচ্ছে, পর্তুগাল তাদের পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলবে আগামী বছরের জুনে বিশ্বকাপের মূল পর্বে। সে ক্ষেত্রে রোনালদো গ্রুপ পর্বের প্রথম একটি বা দুটি ম্যাচ (মোট নিষেধাজ্ঞা দুই বা তিন ম্যাচ সাপেক্ষে) মিস করবেন। এর আগে মার্চে ফিফা উইন্ডো আছে। তবে সে সময় পর্তুগাল খেললেও তা হবে ‘প্রীতি ম্যাচ’। রোনালদোকে শাস্তি ভোগ করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেই।

কবে জানা যাবে রোনালদোর নিষেধাজ্ঞা কত ম্যাচের

ঘটনার কত দিনের মধ্যে ফিফা ডিসিপ্লিনারি কমিটি শাস্তি ঘোষণা করবে, সে বিষয়ে কোনো বিধান নেই। সাধারণত, ঘটনার পরবর্তী মাসের শুরুতে রায় পাওয়া যায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হচ্ছে আগামী ৫ ডিসেম্বর। সে দিন ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০২৬ বিশ্বকাপের সূচি চূড়ান্ত (ড্র) হবে। এর কাছাকাছি সময়েই রোনালদো তাঁর নিষিদ্ধ ম্যাচসংখ্যার খবর পেয়ে যাবেন।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে খেলার কি কোনো উপায়ই থাকবে না

প্রথম কথা, রোনালদো এখন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা পাননি। যদি অন্তত দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পান, তবেই বিশ্বকাপের প্রথম থেকে না খেলার প্রশ্ন আসবে। তবে অপরাধের ধরনের কারণে ধরে নেওয়া যায় নিষেধাজ্ঞা তিনি পেতে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে পর্তুগালের বিশ্বকাপে জায়গা করাও একটা বিষয়। আজ পর্তুগাল যদি আর্মেনিয়াকে হারাতে না পারে এবং একই গ্রুপে হাঙ্গেরি আয়ারল্যান্ডকে হারায়, তাহলে পর্তুগাল গ্রুপে পিছিয়ে ইউরোপিয়ান প্লে-অফে নেমে যাবে।

সে ক্ষেত্রে পর্তুগালের পরবর্তী দুটি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ হবে প্লে-অফ সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল। নিষেধাজ্ঞা পেলে রোনালদো এই ম্যাচগুলো মিস করবেন। দল বিশ্বকাপে গেলে সেখানে শুরু থেকেই খেলতে পারবেন ‘সিআরসেভেন’। কিন্তু যে প্লে-অফের ওপরে বিশ্বকাপে খেলা, না খেলা নির্ভর করবে, সেই ম্যাচে না খেলতে পারাও তো রোনালদো এবং পর্তুগালের জন্য ধাক্কা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন ও ট্যাগিংয়ের অভিযোগ
  • সিদ্ধিরগঞ্জে দুই গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা
  • একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের দুরবস্থার সময় দায়িত্বে ছিলেন যারা
  • রোনালদো কি সত্যিই বিশ্বকাপে ১-২ ম্যাচ মিস করবেন
  • চতুর্থ সন্তানের মা হলেন কার্ডি বি
  • পত্রিকা পড়ে বেড়ে ওঠা