বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীকে প্রান্তিক করে ফেলার রাজনীতিটি বুঝতে খুব বেশি রাজনৈতিক জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই। বিষয়টি দিন দিন এত বেশি প্রকট হয়ে উঠছে যে তা আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

এ দেশের নারী রাজনীতিবিদেরা আজ ২০২৫ সালে এসেও ‘নারী’ পরিচয়টির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তাঁদের নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা এখনো শরীরকেন্দ্রিক। শরীরের রাজনীতিকে ছাপিয়ে আসল রাজনীতির মঞ্চে নারীরা এখনো আসীন হতে পারেননি; কিংবা তঁাদের আসীন হতে দেওয়া হয়নি! বাস্তবিক রাজনীতির মাঠ কিংবা ভার্চ্যুয়াল জগৎ—কোনোখানেই এখনো নারীর বলিষ্ঠতা, বুদ্ধিদীপ্ততা কিংবা নেতৃত্বের মতো বিষয়গুলো নারীর শরীরের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর ক্লিকবেজড অনলাইন মাধ্যম তো বটে; মূলধারার গণমাধ্যমেও কখনো কখনো নারী রাজনীতিবিদের সাজপোশাক, শরীর কিংবা চরিত্রকে হেয়প্রতিপন্ন করে তাঁদের প্রান্তিক করে ফেলার এক মহোৎসব যেন শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হলো কেন এই প্রবণতা?

বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে নারীকে প্রান্তিক করে ফেলার যে চেষ্টা, সেই একই চেষ্টা দেখা যায় রাজনীতির অঙ্গনে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের সম্পর্কটি যেহেতু নিবিড়ভাবে জড়িত, তাই এ ক্ষেত্রে নারীকে টেনে ধরার জন্য পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি অন্য ক্ষেত্রগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় থাকে।

রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি পুরুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মেনে নেয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত নারীকে ব্যবহার করে পুরুষ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেন। এরপর লক্ষ্যে পৌঁছেই নারীকে কোণঠাসা করে ফেলার সব কৌশল ব্যবহার করেন পুরুষ।

জানি আমার এই বক্তব্যে অনেকেই বিগত কয়েক দশকের নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারব্যবস্থার কথা বলবেন; কিন্তু বিশেষ কয়েকটি পদে নারীর আসীন হওয়া দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। যদি তা–ই হতো, তবে রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যের বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাজনীতির মঞ্চ আজ ‘মেনজ ক্লাব’ কিংবা ‘পুরুষের মঞ্চ’ হয়ে উঠত না।

রাজনীতি শেখায় কীভাবে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হয়। রাজনীতির মঞ্চে থাকা নারীটি অন্যান্য নারীর চোখে হয়ে ওঠেন অধিকার আদায়ের এক বিমূর্ত প্রতীক; যাঁকে দেখে বুকে সাহস পান হাজারো নারী। আর সেখানেই পুরুষের ভয়। নারী শুধুই ঘরে থাকবেন, সন্তানাদি লালন-পালন করবেন, গৃহস্থালি কাজকর্ম করবেন—সেটিই স্বাভাবিক তাঁদের কাছে। নারী কেন বাইরের জগতে আসবেন কিংবা অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হবেন?

পুরুষ যে কেবল নারীকে ক্ষমতায় দেখতে ভয় পান, তা কিন্তু নয়; বরং তাঁরা ভয় পান নারীর নেতৃত্বে সামাজিক পরিবর্তনের; যা পুরুষের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতাকাঠামোর পুনর্বণ্টনকে ইঙ্গিত করে। ফলে এত দিন ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া কর্তৃত্ববাদী পুরুষদের দল নড়েচড়ে বসে এবং নিজের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে নারীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করে। পুরুষ ভালোভাবেই জানেন, নারীর এগিয়ে যাওয়াকে আটকানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো নারীর শরীর ও চরিত্রকে আক্রমণ করা। তাই তাঁরা বারবার আঘাত করেন সেই জায়গায়, যেখানে তাঁর বিজয় সুনিশ্চিত।

নারীর শরীর কিংবা তাঁর চারিত্রিক শুদ্ধতাকে আক্রমণ করার মাধ্যমে তাঁরা আঘাত করেন নারীর সম্মান ও আত্মমর্যাদাকে। আর একজন নারী সহজাতভাবে সবচেয়ে ভীত থাকেন তাঁর মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে। আত্মসম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস থাকে খুব কম নারীর। ফলে পুরুষতান্ত্রিক অস্ত্রের নিশানা হয় অব্যর্থ। এভাবে ক্রমেই রাজনীতির জন্য অনুপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নারীকে। তিনি তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারান এবং একসময় নিজ থেকেই তাঁরা রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়ান। ফলাফল—পুরুষের বিজয় এবং রাজনীতির মাঠে তাঁদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

যুগে যুগে শারীরবৃত্তিক এই রাজনীতির চক্রেই আবর্তিত হয়েছে নারীর রাজনৈতিক জীবন। হাতে গোনা কিছু নারী ছাড়া তাই রাজনীতির মঞ্চে আলো ছড়াতে দেখা যায়নি নারীদের। এই চক্র থেকে মুক্তি পাননি নারী সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নারী নেত্রীরা পর্যন্ত। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা উদীয়মান তরুণ নেত্রীদের ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি।

রাজনীতিতে নারীকে অপরায়ন করার মাত্রা যেন ইদানীং অতীতের সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে যেন সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এই প্রবণতা। বিষয়টি এত পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে যে এর রাশ টেনে ধরতে না পারলে আগামীর দিনগুলোতে রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পূর্ণ নারীশূন্য হয়ে পড়বে বলে আমার ধারণা। যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী, সেই দেশের নারীদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে পুরুষ দ্বারা; এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো বাস্তবতায় আর নেই আমরা। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে এর প্রভাব পড়বে প্রতিটি ক্ষেত্রে। দিন দিন নারী প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়ে পড়বেন। রাজনীতি থেকে কি তবে হারিয়ে যাবেন নারীরা?

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত র ম র র জন ত র জন ত ক ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

প্রবাসে বাংলাদেশিদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহনন প্রবণতা

দেশের বাজারে চাকরির সংকট কিংবা কম বেতন অথবা কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রবাসী হচ্ছে। মূলত অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং জীবনমান উন্নয়নের আশায় পাড়ি জমায় দূর প্রবাসে।

২০২৪–এর একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখের বেশি, এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবেই আছে ৩০ লাখের বেশি প্রবাসী। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে চলছে দেশের অর্থনীতি। তবে দুঃখের বিষয় বিশাল এই জনগোষ্ঠীর দুঃখের বাস্তব চিত্র কোথাও তুলে ধরা হয় না।

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কখনোই অকারণে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয় না, দেশের কেউ আত্মহত্যা করলে সেটার কারণ হয়তো পরিবার কিংবা আশপাশের মানুষ কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তবে প্রবাসে এই চিত্র ভিন্ন, এখানে নিজের খবর নিজেরই রাখার সময় হয় না। ফলে দেখা যায়, একই রুমে থেকেও রুমমেট কী কারণে আত্মহত্যা করছে, সেটি টেরও পাওয়া যায় না।

আমি নিজে একজন প্রবাসী হিসেবে প্রবাসে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে কয়েকটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।

বৈবাহিক জীবনে অশান্তি

প্রবাসে যেসব পুরুষ আত্মহত্যা করেন তাঁদের বেশির ভাগ বিবাহিত। স্ত্রীকে দেশে রেখে অনেক প্রবাসী শ্রমিক বছরের পর বছর প্রবাসে থেকে যান। অনেক সময় ভিসা, আকামা না থাকায় কয়েক বছরেও যাওয়া হয় না দেশে, যার প্রভাব গিয়ে পড়ে বৈবাহিক জীবনে। ফলে সম্পর্কে দেখা দেয় ভাঙন। এখানে পারিবারিক অশান্তি, পরকিয়াসহ বিবিধ কারণ যুক্ত। এসব কারণে অনেক প্রবাসী আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেন।

ঋণ শোধ করার চাপ

অনেক প্রবাসী চক্রবৃদ্ধি সুদে অথবা উচ্চ সুদে লোন করে এখানে আসেন, তিনি সেই লোনের টাকা শোধ করতে পারেন না, পাওনাদার পরিবারকে নানা রকম চাপ দেয়। এরপর সেই চাপটা আবার ওই প্রবাসীর ওপরই ফিরে আসছে। এ চাপটা নিতে না পেরেই অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

নারী কর্মীদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা

দেশে থাকা দালাল নানা রকম চটকদার কথা বললেও বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিকদের জীবন এক বিভীষিকাময় জেল বললেই চলে। বিশেষত যাঁরা বাসাবাড়িতে কাজের ভিসায় আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই নানা রকম সমস্যার মধ্যে পড়েন। কাজের কোনো নির্ধারিত সময় কিংবা ধরন কোনো কিছুরই ঠিক থাকে না। এরপরও অনেকের বেতন দেয় না ঠিকমতো। আবার নারী কর্মীদের কুকাজের প্রস্তাব করেন এমন সংখ্যাও কম না। এ ছাড়া শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের স্বীকারও হতে হয় অনেককে। এর বাইরেও দালালেরা নানা কাজের কথা বলে এখানে এনে দেহ ব্যবসার মতো কাজেও নারীদের কাজ করতে বাধ্য করে। এসব চতুর্মুখী সমস্যা মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাটাই কষ্টের হয়ে যায়, ফলে অনেকে নিয়ে নেন আত্মহননের সিদ্ধান্ত।

প্রবাসে আত্মহনন বন্ধে সরকারকে হতে হবে প্রবাসীবান্ধব। সরকার চাইলে চালু করতে পারে প্রবাসী সহায়তা অ্যাপস, যেখানে প্রবাসীরা যেকোনো সমস্যা হলে সেটি মোবাইলের মাধ্যমে জানাতে পারেন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে যাঁরা অভিবাসনপ্রত্যাশী তাঁদের যেকোনো একটি কাজে দক্ষ করে সেই কাজের ভিসায় অনুমতি দেওয়া এবং প্রবাসযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনা। প্রবাসীর পরিবারের সদস্যদেরও খেয়াল রাখতে হবে প্রবাসীর মানসিক ব্যাপারে।

প্রবাসে আত্মহত্যা করা অনেক প্রবাসীর পরিবার মনে করে তাদের স্বজন হত্যার শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা লাশের শরীরে বিভিন্ন রকম জখমের দাগকে উদাহরণ হিসেবে দেখায়। আত্মহত্যাকে হত্যা দাবি করা লাশের অধিকাংশই থাকেন প্রবাসে গৃহপরিচারিকার কাজে। এসব ক্ষেত্রে উচিত দেশে লাশ এলে সেটি আবার পোস্টমর্টেম করা। প্রবাসী বাঁচলে বাড়বে রেমিট্যান্স, রেমিট্যান্স বাড়লে এগোবে দেশ।

মিনহাজ বিন মাহবুব

কাতারের দোহায় কর্মরত চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা

ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রবাসে বাংলাদেশিদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহনন প্রবণতা