এবার যেন একটু তড়িঘড়িই গরমটা পড়ল। পড়েই একেবারে চৌচির করে ছাড়ছে। কেতাবি ভাষায় বোধহয় দাবদাহ বলে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের খুব বোঝাপড়া চলছে। বিষণ্ন রাত ফুরিয়ে সূর্য ওঠার তোড়জোড়ে পূব আকাশটা খুনখারাবি করে উঠেছে। তার আলোকছটা এখনো এলাকার সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংটার কাচের দেয়ালের ওপর পড়েনি। গরমে রাতভর বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাদের এই শেষরাতের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছে সেই সব ঘুমন্ত মানুষের ওপর দিয়ে নির্বিবাদ ভোরের বাতাস ছঁয়ে যাচ্ছিল, ছুঁয়ে যাচ্ছিল গাছের শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লবে। আর জানালার নির্লিপ্ত গরাদ জড়ানো পর্দাগুলোতে। অতি সস্তার মেসঘরে মাথার কাছে ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকা ছোট টেবিল ফ্যানটা বন্ধ হয়ে যায়। দিনের শুরুতেই লোডশেডিং, একেবারে হাসফাস অবস্থা।
ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে যায় আবুলের। ব্যস্ত সমস্ত রাস্তার একটু ভেতরের দিকের এক গলির মুখে তার ছাপড়া চায়ের দোকান। খানিকটা হেঁটে গেলেই একটা লেক, লেকের সাথেই একটা পার্ক। স্বাস্থ্য উদ্ধারে ব্যস্ত মানুষগুলো একটা দুটো করে পথে বের হচ্ছে। দিনভর ধুলোবালি, শব্দের ধস্তাধস্তির শহরটা একটু যেন অচেনা লাগে এই ভোর ভোর বেলাটায়। লাগবেই তো। বাস-ট্রাকটেম্পু-ব্যাটারি রিক্সার মাখামাখি, কানে তালা লাগানো ভেঁপুর ঐক্যতান তখনো সেভাবে শুরু হয়নি। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে ফেলে রাখা পলিথিনে ভরা এঁটোকাঁটার স্তূপ ফুটপাতের ওপরে। যদ্দুর পেরেছে রাতভর রাস্তার কুকুরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুরিভোজ সেরেছে। আবার সেই কুকুরদের ফেলে রাখা এঁটোকাঁটা থেকেও এমন গন্ধ বের হচ্ছে যে আবুলের তো বটেই সে রাস্তা দিয়ে যে-ই যাচ্ছে তার-ই মনে হচ্ছে পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে। কে বলবে এটা অভিজাত এলাকা! অভিজাত বড়লোক এলাকার একটা ভাবসাব থাকবে না? না, এখানে তা নেই। নামেই অভিজাত।
মেয়র ভাইয়ের লোকেরা কখন আসবে কে জানে, এদিকে দুর্গন্ধে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রাণের দায়ে নিজেই সাফ করতে লেগে যায় আবুল। তাছাড়া খরিদ্দার লক্ষ্মী, সে কথাটাও তার মাথায় রাখতে হয়। একটু পরেই তো লক্ষ্মীর আনাগোনা শুরু হবে। লেকের পাড়ে হেঁটে ক্লান্ত লোকজন এসে দিনের প্রথম চায়ের ঢোকটা তার দোকানে বসেই পান করে। বাঁশ দিয়ে বানানো ছোট সাইজের দুইটা বেঞ্চ আছে। আগে আসলে আগে বসবেন এই নিয়মে বসে খরিদ্দার। এখনো দেখা যায় লোকজনের ভিতরে কিছু আদব-লেহাজ আছে। মুরব্বি দেখলে উঠে দাঁড়ায়।
তারপর তার হাতের আদা চা, লেবু চা, এলাচ চা, দুধ চা যার যেমন খুশি খেয়ে যেদিকে যাওয়ার চলে যায়। কিছু লোক যায় না। চা খেতে খেতে আজাইরা আলাপ করে। চায়ের পানি গরম হবার আগেই যে লোকটা প্রতিদিন সবার আগে আসে, সে আজ একটু আগেই এসেছে। এসে চুপচাপ বেঞ্চে বসে মাথাটা একটু নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। হাত দুটো হাঁটুর ওপর ভর করা যেন দুই খুঁটিতে লম্বা কলাগাছটাকে ঠেকা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। গরমে রাতে তার নিশ্চয়ই ভালো ঘুম হয়নি। তাই এখানে এসে ঝিমোছে। গরমের এই সময়টাতে সে একটু ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্য সময় যা থাকে উদ্দীপনার মতো তা হয়ে ওঠে রীতিমতো উত্তেজনা। কিন্তু এখানে এসে সেরকম বাড়াবাড়ি, কোনো খ্যাপামি করে না। তা না করুক, আজাইরা আলাপের শুরুটা সেই করে। চা’টা একটু বেশিই খায়। চা খেতে খেতে রাজা উজির মারে। আলাপ করে দেশের রাজনীতি নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, খাদ্যে ভেজাল নিয়ে, দুর্নীতি-বাটপারি নিয়ে। তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। হাতাহাতির ভয় থাকে। হাতাহাতি হলে রক্ষে নেই। তার দোকানের ওপর ঝাল ঝাড়বে সবাই। সর্বনাশ! এই ছাপড়া দোকানটাই তার মা-বাপ। তাই সে প্রতিদিন মানত করে চুল দাড়ির জোব্বায় হাজি বুড়ো আসলে বিনেপয়সায় যত্ন করে দুকাপ চা খাওয়বে। সে আর কিছু খায় না। আবুল শুনেছে তার বুজুরগি আছে।
টাকমাথা লোকটা কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে আসছে। দরদর করে ঘামছে। গায়ের সাদা পাঞ্জাবিটা লেপ্টে আছে তার কালো চামড়ার সাথে। বেঞ্চের খালি জায়গাটা পেয়ে ধপ করে বসে পড়ে। তারপর আস্তে-ধীরে হাতের পেপারটা খুলে চোখ বুলাতে থাকে চুপচাপ।
— ‘আবুল মিয়া!’ খবরের কাগজে চোখ রেখেই হেঁকে ওঠে সে। আর কিছু বলতে হয় না। আবুল চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয় তার হাতে। এক ঢোক চায়ে গলাটা ভিজেছে কি ভেজেনি মনে হয় মেশিনে তেল পড়ল। ওমনি শুরু হয় তার প্যাচাল। আবুল সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে.
— ‘একটা দিন বাদ যায় না এইসব খবরে। আজকেও তিন তিনটা লাশ ফেলনের খবর।’
ধীরে ধীরে চা-পিপাসুদের ভিড় বাড়তে থাকে।
— ‘মারার অধিকার খালি সন্ত্রাসিগোই থাকব, তাই না? যে যারে বাগে পাইতেছে সে হেরে মারতাছে।’
— ‘মারবেই তো। মগের মুল্লুক না। দ্যাশটা কী আর দ্যাশ আছে। দ্যাশ পইড়াগেছে মাঝদরিয়ার পাগলা ঢেউয়ের মধ্যে। মাঝি-মাল্লা নাই। পাগলা ঢেউ সামাল দিব কেমনে!’
— ‘কেমনে সন্ত্রাস দমন করবে সেইডা সরকারের ব্যাপার। আপনার মাথা ঘামানির কাম কী? বলতে বলতে মোটাসোটা থলথলে লোকটা ব্যাঞ্চে একটা লাথি মেরে বেরিয়ে যায়। বেলা উঠতে উঠতে প্যাচালের পাতিল আরও গরম হয়ে ওঠে।
দুম করে আজাইরা প্যাচাল ঘুরে যায় চান্দাবাজ আর ঘুষখোরদের গোষ্ঠী উদ্ধারে। ব্যাংক লুট থেকে শুরু করে দেশের মাঠ-ঘাঠ, নদী-নালা, খাল-বিল, পাথর-বালু লুটপাট হয়ে যাচ্ছে বলে পাবলিকের আহা-উঁহুরও কমতি নেই।
ওভার ব্রিজের নিচে জোয়ান পঙ্গু ভিক্ষুকটা যে কতখানি লুচ্চা, তার উদ্দেশ্য যে ভালো না, এই মর্মে তাকে যাচ্ছেতাই বলে গালমন্দ দেওয়া থেকে শুরু করে শেয়ার বাজারের মালিকদের কাপড় খুলতে এরা বাকি রাখছে না। খুব জমেছে আজকে। কিছু লোক খামোখাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সব শুনছে দাঁত দিয়ে নখ খুটতে খুটতে।
— ‘বুঝলেন ভাই, এই দেশের মানুষের কিচ্ছু হবে না।’
— ‘কিছু যে হবে না সে তো বুঝতেই পারছি। আমরা খারাপ বলেই তো আমাদের নাচায় চেয়ারে বসা লোকগুলো।’ মানুষজন যে খারাপ এই কথা দুধের শিশুও বোঝে। সেই কথাই বুঝাবার জন্য সেই লোকটা উঠে দাঁড়ায় যার চেহারা ঠিক ভদ্রলোকের মতো। সবার সামনেই একদলা থুতু ফেলে একটা সিগারেট ধরায় সে।
— ‘মানুষজন এত খারাপের খারাপ। এত খাইসটার খাইসটা—’ বলতে বলতে তৃতীয়বারের মতো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দু চুমক দিয়ে কাপটা ছুড়ে মারে রাস্তার ওপর। আবুল ইতিমধ্যে মিউ মিউ করে বলে, স্যার, এইখানে ময়লা ফেলার বালতি আছে। এইখানে ফেলেন। তার মিহি ভীতু অনুচ্চস্বর ভদ্রলোক গোছের লোকটির উচ্চস্বরের ডামাডোলে চাপা পড়ে যায়।
— ‘দেহেন না রাস্তায় রাস্তায় ট্রাকে ভইরা ময়লার পাহাড় ফ্যালইয়া রাখে এইডার মানে কী? ময়লা ফেলোনের আর জাগা পায় না। দুর্গন্ধে রাস্তা দিয়া হাটা যায় না।’
— ‘বুঝলেন পেপার খুললেই মেজাজ গরম হয়ে যায়। এই যে প্রত্যেক দিন ধর্ষণ হইতেছে। এইডা কেমনতর দেশ হইল! মেয়েরা রাস্তাঘাটে চলবে না? স্কুল কলেজে যাবে না? বাসে গাড়িতে মেয়েরা উঠবে না? উঠলেই এই রকম কাহিনি হবে?’
— ‘আপনে পয়সা খরচ কইরা পেপার কেনেন কী কামে? সব খবরই তো ইউটিবয়ালারা বিরানি পাকাইয়া ছাইড়া দেয়।’
— ‘আরে মিয়া, আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার নিরাপত্তা আছে? আবার মেয়েদের নিরাপত্তা খোঁজে! যত্তসব আবালের দল।’
— ‘আরে ভাই, আপনি তো শুধু পেপারের খবর দেখতাছেন। পেপারের বাইরেও যে কত ঘটনা ঘটছে তার খবর কে রাখে? আর মেয়েদের নিরাপত্তা? ভাইরে আপনি যেমন বলতাছেন, তাইলে তো একজন মেয়ের সাথে একজন পুলিশ, বডিগার্ড এইরকম কিছু লাগাইয়া রাখা দরকার। এর বিরুদ্ধে কড়া আইন দরকার বুঝলেন?’
— ‘কী বলতে চান আপনে? আল্লার চাইতে পুলিশ কী বড় হয়ে গেছে? আল্লারে ভয় নাই কারো?’
— ‘আরে উল্টা বুঝলে কেমনে হবে? এইগুলা কোন কথাই না। মাইরের ওপর কোনো ওষুধ নাই। আল্লার বিচার তো পরকালে। সেই বিচারের তো কোনো মাফ নাই। হাবিয়া দোজখ মনে করেন যে খোলাই আছে। কিন্তু এই দুনিয়ায় কুলাঙ্গারগুলারে ধরতে পারলেই জায়গা মতো গুলি। পুলিশের হাতে বন্দুক আছে, জানতেছেন লোকটা অপরাধী তারপরেও বিচারের নাটক করেন। তারপর সেই নাটক সিরিয়াল হয়ে যায়। এই সব চলবে না। তো যা সব চলবে তাও তো কেউ চালাচ্ছে না।’
আবুলের অসহ্য লাগে। কেউ আস্তেসুস্থে কথা বলে না। সবাই উত্তেজিত। খামোখাই চিল্লাচিল্লি, হাকাহাকি, মব দিয়েই দেশ উদ্ধার করছে। সে কিন্তু কেচোর মতো গুটিয়ে থাকে। তার আতংক লাগে কখন না জানি মারপিট লেগে যায়। তার রুটিরুজির ছাপড়াটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে দেয়। আগে যে চাঁদাবাজি করত চোখের ইশারায় পঞ্চাশ/একশতে, সে এখন সরবে তার পকেট হাতিয়ে সবটুকু নিয়ে চলে যায়। সেদিন তাকে না খেয়ে থাকতে হয় কিন্তু কিছু বলার নেই। কেউ শোনার নেই। আইন আছে আইনের মতো। যারা আইন ভাঙতে চায় তারা আছে বুক ফুলিয়ে। যারা ঘুস খাওয়ার সুযোগ পায় তারা ঘুস খায়। যারা অন্যায় করার তারা অন্যায় করে। যারা পার পাওয়ার তারা পার পেয়ে যায়। সে চুপচাপ থাকে। তার ওপর অন্যায় হলেও কিছু বলা সাজে না, সামান্য অতি সামান্য পিঁপড়ির মতো মানুষ সে। তবে সে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঠাওর করার চেষ্টা করে—লোকগুলো আসলে কোন দলের? এত দিনে বুঝেছে এরা আসলে কোন দলের না। এদের কিছু করার নেই তাই আজাইরা প্যাচাল পাড়ে, চিল্লাচিল্লি করে মনের ঝাল মিটায়। যাদের কিছু বলার ক্ষমতা আছে তারাই তো একটা দলের হয়ে যায়। অথবা তাদেরকে দল টেনে নেয় চুম্বুকের মতো।
আবুল চুপচাপ এঁটো চায়ের কাপ ধোয়, চা বানায়, কাপে চা ঢালে, চিনি ঢালে। তারপর তুমুল চামুচ নেড়ে চিনি গোলায়। আসলে ওই তুমুল চামুচ নাড়ানোর মধ্যেই তার সমস্ত রাগ ঢালে। এক সময় এই সব আজাইরা আলাপ থেকে কেউ কেউ ইস্তফা দিয়ে চলে যায়। কে জানে কোন চুলোয় যায়। যোগ হয় নতুন নতুন মুখ। কেউ কেউ চায়ের দাম না দিয়েই চলে যায়, যাওয়ার সময় টংয়ের চালে ঝুলানো পলিথিনের প্যাকেট করা বনরুটি ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়, যেমন রাস্তায় লোকজন হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতের গাছপালার ফুল, ডালপাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায় অকারণে। আবুল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর মনে মনে গাল দেয়, ফরিন্নির জাত কোথার। যারা বড় বড় কথা বলে তাদের মধ্যেই কেউ কেউ এ কাজটা করে। বুঝতে পারে কিন্তু আবুল কিছু বলে না, কিছু বলা তার সাজেও না। কেননা ভাঙচুর করলে তারই সর্বনাশ। এক কাপ চা, একটা বনরুটির ওপর দিয়ে যায় তো যাক। চা, বনরুটির দাম চেয়ে উটকো বিপদ ডেকে আনার মতো এত বড় আহম্মক সে নয়। মা, বৌ, পোলাপান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আটজনের সংসার এই চা বিক্রির ওপর। আবুলের বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার সামান্য আয় রোজগারের পথ তাও এই শহরের চান্দাবাজদের দয়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সে আবারও মনে মনে গাল দেয় ফকিরনির জাত।
আবুলের ছাপড়া দোকানের ওপর মাঝারি সাইজের একটা কাঠবাদাম গাছ আছে। এই চান্দিফাটা গরমের মধ্যেও কী চমৎকার সবুজ বড় বড় পাতা। রোদ বৃষ্টির প্রলেপে পাতাগুলো চকচক করতে থাকে। বৃষ্টি থেমে গেলে পাতায় জমানো জলের ফোট টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে। দেখে দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। গাছটা এই বিশাল গরমে ঠান্ডা ছাতার মতো কাজ করে। ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে যায়। লোকজন হাঁসফাঁস করতে একটু জিরিয়ে নেয় এখানটায় বসে। বৃষ্টি হলে গাছ-ছাতার নিচে এসে দাঁড়ায়। তখন তার আদা কুঁচানো চা, লবঙ্গ চা, মধু মিলানো চায়ের কাটতি হয় রমরমা। তখন বস্তাপচা আজাইরা প্যাচাল অনায়াসে সহ্য হয়ে যায় তার। শুধু সহ্যই হয় না রীতিমতো উপভোগও করে। তখন তারও এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে নিজেকে সামলায়।
আবুল কম কথা বলা মানুষ। আজ আজাইরা প্যাচালের মানুষজন যেন একটু বেড়েছে। যেমন বেড়েছে গরম সেই সঙ্গে এদের ঝনঝনানি কথার তাপও। সেই ঝনঝনানির আতসে চৈত্রের ঠিক মাঝখানে বৃহষ্পতিবার দিনটাতে হঠাৎ আগুনে ঘিরে ধরল এক রাজপ্রাসাদ। এই শহরে রাজপ্রাসাদের তো কোনো অভাব নেই। চারিদিকে আগুন আগুন শব্দের ডামাডোল। আজাইরা প্যাচালবাজরা কে কোথায় ছুটে পালাল ঠিক ঠাহর করতে পারল না আবুল। লোকজন এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি করছে। বিয়ে বাড়ির পটকা ফাটার মতো ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। খুব উঁচু কোথা থেকে যেন কাচ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ পাচ্ছে আবুল। শব্দে কান ধরে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন আগুন চিৎকারে দিগ্বিদিক বিভিষীকাময় হয়ে উঠল। আবুল দোকান সামলাবে না কোথায় আগুন লেগেছে তার সন্ধান করবে বুঝে উঠতে না পেরে কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখের সামনেই তো ঘটনাটা অঘটনের দিকে যাচ্ছে। সে এতক্ষণে দেখতে পেল এই এলাকার সবচেয়ে উঁচু বিলডিংটা—সকাল দশটা এগারটা পর্যন্ত সূর্যটাকে আড়াল করে রাখে, সেই বিল্ডিংটাই এখন ধোঁয়া আর আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে ডুবে আছে মাঘের ঘন কুয়াশার মতো। ভেতরে আটকা পড়া মানুষদের বাঁচার আকুতিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে দমকল বাহিনী এল। পানির পাইপ নিয়ে তারা সাধ্যমতো ছোটাছুটি করতে লাগল। কিন্তু উৎসুক জনতার যন্ত্রণায় ঘটনা স্থলে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ল তাদের জন্য।
রাজপ্রাসাদটা ঠিক কয়তলা অবসরে আবুল তা গোনার চেষ্টা করত। আর প্রত্যেকবারই ভুল করত। কোনোবারই ঠিকঠাক গুনে উঠতে পারেনি। বিশ-বাইশ না তেইশ, না আবার এক দুই তিন। একবারও ঠিক হয় না। আহা সেই রাজপ্রাসাদ এখন আগুনে পুড়ছে। রাস্তায় শত শত লোক ভিড় করে দেখছে। ভেতরে কত লোক যে দগ্ধ হচ্ছে তার ঠিক নেই আর কত লোক যে দগ্ধ হয়ে জীবনমৃত অবস্থায় আসবে তারই বা কি ঠিক আছে। অতি কৌতূহলীরা মুঠোফোনে ভিডিও করতে ব্যস্ত, সেলফি তোলায় ব্যস্ত। ফোনে চিৎকার চেচামেচি করে কথা বলছে, আহাজারি করছে। তাতে প্রমাণ হবে যে আমি ওই ঘটনার ঠিক সামনেই ছিলাম। এখন বাংলাদেশে কেবল রোসের আগুন জ্বলছে। কিছুদিন আগেই না চুড়িহাট্টায় এইরকম একটা ঘটনা ঘটল। সেই দিনও তো এই রকম কেয়ামতের অবস্থা। এরই ভেতর এক শিশু দমকল বাহিনীর একটা পাইপের ছিদ্র প্রাণপণ চেষ্টায় তার কচি দুহাতে চেপে ধরে আছে। ছিদ্র দিয়ে যেন পানি বেরিয়ে যেতে না পারে। আবুল ভুলতে পারে না সে দৃশ্য। তার তো ফোন নেই তাই সে এই মহান কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। টেলিভিশন, প্রিন্টমিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেলগুলো উপচানো খবরের বন্যায় ভেসে যায়। খবরের কাগজগুলো অসংখ্য চিত্রসহ কত বিচিত্র আবেগঘন খবর ছাপল কদিন ধরে।
রাজপ্রাসাদের আগুন ঘটনার পর এখন সব চুপচাপ। কদিন আগে এখানে ভয়াবহ একটা কিছু যে ঘটেছিল এখন তা মনেই হয় না। ভুলে গেছে সবাই। কিছু মানুষের লাশপোড়া গন্ধ শহরের ঘন কার্বন-সিসা আরও কী সব বিষাক্ত গ্যাসে মেলানো বাতাসে মিলিয়ে গেছে সন্তর্পণে। এখন সেই রাস্তায় কত স্বাভাবিকভাবে গাড়িঘোড়া চলছে। ভেঁপু বাজাচ্ছে। জ্যাম লাগছে। থেমে থাকা গাড়িগুলোর সামনে টোকাইরা ফুল, ফুলের মালা, ঠান্ডা পানির বোতল বিক্রি করছে। কেউ বা হাতে কিছু বই নিয়ে ফেরি করছে। বাধা থাকা সত্ত্বেও কিছু লোক রাস্তার ডিভাইডার পেরুচ্ছে আপ্রাণ চেষ্টায়। তারপর ধৈর্যের শেষ সীমায় চড়ে জ্যাম ছেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় নামার আগে গগনবিদারী ভেঁপু বাজানোর উৎসবে মেতে ওঠে কোন কারণ ছাড়াই। ট্রাফিক সিগনাল থোড়াই কেয়ার।
আবুলের ছাপড়া চায়ের দোকানে আজাইরা প্যাচালে আবারও গরম হয়ে ওঠে চায়ের কাপগুলো। অঘটনটা কবে যেন ঘটল? আবুল মনে করার চেষ্টা করে। অনেক পরে তার মনে পড়ে যেদিন দেখতে-শুনতে ভদ্রলোক গোছের লোকটা চা খেয়ে টাকা না দিয়েই চলে গিয়েছিল।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র খবর র ওপর ল কজন অবস থ র একট ত রপর
এছাড়াও পড়ুন:
দলের দুই পক্ষের বিরোধ মেটাতে যাচ্ছিলেন সালিস বৈঠকে, পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিএনপি নেতার
দলের দুটি পক্ষের মধ্যে হাতিহাতি ও সংঘর্ষের ঘটনায় বিরোধ মীমাংসায় ডাকা হয়েছিল সালিস বৈঠক। সে বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ফেনীর পরশুরামের বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদার (৫৮)। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন তাঁর এক সহযোগী।
পারভেজ মজুমদার ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের নিজকালিকাপুর গ্রামের সাদেক মজুমদারের ছেলে। তিনি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
পুলিশ ও নিহত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার দুপুরে নিজকালিকাপুর গ্রামে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় উভয় পক্ষের চারজন আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরশুরাম উপজেলা সদরে সন্ধ্যায় একটি সালিস বৈঠকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সালিসে যোগ দিতে স্থানীয় বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদার ও তাঁর সহযোগী মোহাম্মদ হারুন মোটরসাইকেলে নিজকালিকাপুর থেকে পরশুরাম যাচ্ছিলেন। তাঁদের বহন করা মোটরসাইকেলটি সুবার বাজার-পরশুরাম সড়কের কাউতলী রাস্তার মাথায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মোটরসাইকেল আরোহী দুজন গুরুতর আহত হন।
স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে প্রথমে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরে ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পারভেজের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে পরিবারের সদস্যরা রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
পরশুরাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল হাকিম মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদারের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে মরদেহ বাড়ি নিয়ে যায় স্বজনরা।