পবিত্র কাবাঘর ঘিরে হারাম শরিফের প্রাঙ্গণে কাবার ছায়াতলে অনুষ্ঠিত ‘মক্কার সনদ সম্মেলনে’ ইসলামি উম্মাহর বিশিষ্ট আলেমরা উপস্থিত হয়েছেন, যাঁদের অগ্রভাগে রয়েছেন প্রধান মুফতিগণ। তাঁরা গভীরভাবে অনুধাবন করেন সেই মহান প্রতিধ্বনি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা বহন করে ‘মদিনা সনদ’।
মহানবী (সা.) চৌদ্দ শতাব্দী আগে এটি প্রণয়ন করেছিলেন বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও বর্ণের অধিকারী উপাদানগুলোর সঙ্গে তাঁর আলোকিত নগরী মদিনায়। সেটা ছিল একটি সাংবিধানিক চুক্তি, যা মানবসমাজের উপাদানগুলোর মধ্যে সহাবস্থানের মূল্যবোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক অনুকরণীয় দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
আল-মক্কা আল-মুকাররমা সনদ হলো একটি ইসলামি দান, যার আলোকশিখা সেই অমর সনদ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি ইসলামি উম্মাহর বিশিষ্ট আলেমদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যাঁরা তাঁদের কিবলাতল থেকে পুরো পৃথিবীকে পথপ্রদর্শন করছেন। এই সনদের ঐতিহ্য আজও চলমান—পঞ্চদশ হিজরি শতাব্দী ও একবিংশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
এই সনদ প্রকাশিত হয়েছে প্রাচীন ঘরের প্রাঙ্গণ থেকে, যা মুসলিমদের হৃদয়ে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। এটি ইসলামি বিশ্বের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করে, যেখানে কিবলা এবং মুসলিমরা অবস্থিত।
এই সনদের প্রণয়ন এমন সময় ও স্থানে অনুষ্ঠিত হয় যা ইতিহাসের গৌরবময়। তাঁরা উপস্থিত ছিলেন পবিত্র ঘরের প্রাঙ্গণে, রমজানের শেষ দশকে এবং এ সময় তাঁরা জোর দিয়ে ঘোষণা করেন যে: তারা সভ্যতার সঙ্গে আন্তসম্পর্কযুক্ত এই বিশ্বের অংশ।এটি পরিষ্কারভাবে প্রদর্শন করে যে এই সনদ ইসলামের এবং মুসলিমদের জন্য এক উজ্জ্বল আলোক উৎস, যা মক্কা শরিফের পবিত্র প্রাঙ্গণ থেকে সমগ্র বিশ্বের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি এটি তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মান এবং ইসলাম, মুসলিম ও মানবতার জন্য তাদের মহান সেবার স্বীকৃতি প্রদান করে।
যখন মুসলিমরা এই মক্কার সনদ প্রকাশ করেন, তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই সনদের প্রণয়ন এমন সময় ও স্থানে অনুষ্ঠিত হয় যা ইতিহাসের গৌরবময়। তাঁরা উপস্থিত ছিলেন পবিত্র ঘরের প্রাঙ্গণে, রমজানের শেষ দশকে এবং এ সময় তাঁরা জোর দিয়ে ঘোষণা করেন যে: তারা সভ্যতার সঙ্গে আন্তসম্পর্কযুক্ত এই বিশ্বের অংশ।
তাদের লক্ষ্য হলো: মানবজাতির কল্যাণ অর্জন করা, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নীত করা, ভালোবাসা ও মানবিক সম্পর্কের সেতু নির্মাণ, অন্যায়, সভ্যতাগত সংঘাত এবং ঘৃণার যেকোনো কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা।
এ ছাড়া সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীরা জোর দিয়ে বলেন যে এই ঐতিহাসিক সনদ আগের শিক্ষা ও নিম্নলিখিত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করে।
১.
এবং আল্লাহর প্রদত্ত সম্মান তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছে । আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি, তাদের স্থলে ও সমুদ্রে বহন করেছি, তাদের উত্তম জিনিস হতে রিজিক দিয়েছি এবং আমি তাদের আমার সৃষ্ট বহু কিছুর ওপর স্পষ্টভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৭০)
আরও পড়ুনজাতীয় ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত মদিনা সনদ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪২. জাতিগত কথাবার্তা ও স্লোগান পরিত্যাগ করা। সেই জঘন্য শ্রেষ্ঠত্ববাদী দাবির নিন্দা করা—যা কৃত্রিম শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত ধারণাকে অলংকৃত করে। মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পরহেজগার।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চেনো। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সব বিষয়ে অবহিত।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১৩)
তদ্রূপ, মানুষের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ সেই, যে মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী।’ (আল-মুজাম আত-তাবারানি)
আর যদি আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই তিনি মানুষকে একটিমাত্র উম্মত করে দিতেন। কিন্তু তারা সর্বদা ভিন্নমতাবলম্বী হয়েই থাকবে।সুরা হুদ, আয়াত: ১১৮৩. জাতিগুলোর মধ্যে নিহিত বিশ্বাস, সংস্কৃতি, স্বভাব এবং চিন্তাধারার ভিন্নতা আল্লাহর উচ্চ হিকমতের প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত। পৃথিবীর এই অমোঘ নীতি স্বীকার করা এবং বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে এমনভাবে আচরণ করা, যা ঐক্য মানবিক প্রশান্তি দিকে নিয়ে যায়—এটি এর বিরোধিতা বা সংঘাতের চেয়ে শ্রেয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যদি আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই তিনি মানুষকে একটিমাত্র উম্মত করে দিতেন। কিন্তু তারা সর্বদা ভিন্নমতাবলম্বী হয়েই থাকবে।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ১১৮)
আর যে ব্যক্তি সত্যের দিকে পরিচালিত হয়, তার দায়িত্ব এটি মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।
৪. মানবসমাজে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কোনোভাবেই সংঘাত বা বিরোধের কারণ হতে পারে না; বরং এটি এক গঠনমূলক ও সভ্য ইতিবাচক অংশীদারত্ব গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এই বৈচিত্র্য হওয়া উচিত পারস্পরিক সংলাপ, বোঝাপড়া ও সহযোগিতার সেতু—যা সবার কল্যাণে নিবেদিত থাকে।
এটি মানুষকে মানবসেবায় ও মানবকল্যাণে প্রতিযোগিতা করতে, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও অভিন্ন মূল্যবোধ অন্বেষণ করে তা কাজে লাগাতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মূল্যবোধসম্পন্ন, সর্বজনীন নাগরিক রাষ্ট্র নির্মাণে উৎসাহিত করে। এই রাষ্ট্র বৈধ স্বাধীনতা, ন্যায়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সর্বজনীন কল্যাণচেতনার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
৫. আসমানি ধর্মের মূল উৎস এক ও অভিন্ন, আর তা হলো আল্লাহর প্রতি ইমান, যিনি একক ও অতুলনীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তবে এসব ধর্মের আইনব্যবস্থা (শরিয়ত) ও পদ্ধতিগত অনুশীলনে (মানহাজ) বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলে দ্বীন (ধর্ম) ও তার অনুশীলন—এই দুটিকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা কখনোই সমীচীন নয়।
৬. সভ্যতার সংলাপই পারস্পরিক বোঝাপড়া, অভিন্ন মূল্যবোধ উপলব্ধি, সহাবস্থানের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ এবং এ-সংক্রান্ত নানা সংকট উত্তরণের সর্বোত্তম পথ। এ ধরনের সংলাপ অন্যের অস্তিত্ব ও তার বৈধ অধিকারের প্রতি সক্রিয় স্বীকৃতি প্রদান করে; ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা করে, যা পরস্পরের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বকে সম্মানিত করে।
এর মাধ্যমে ইতিহাসের শত্রুতা, ঘৃণার অন্ধ তত্ত্ব, ষড়যন্ত্রমূলক ধারণা এবং কিছু ব্যক্তির বিচ্যুত আচরণের কারণে সমগ্র সম্প্রদায়কে দোষারোপ করার ভুল মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
এটিও স্পষ্ট করা জরুরি যে ইতিহাস তার নিজস্ব ব্যক্তিদের দায়িত্ব, কেউ অন্যের অপরাধের ভার বহন করবে না; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘ওরা এক জাতি, যারা অতীত হয়েছে; তাদের যা অর্জন, তা তাদের জন্য; আর তোমাদের যা অর্জন, তা তোমাদের জন্য; এবং তোমরা তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করবে না।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ১৩৪)
আর আল্লাহ আরও বলেন: ‘(ফিরআউন বলল:) অতীত জাতিগুলোর কী হাল হয়েছে?’ তিনি (মুসা আ.) বললেন, ‘তাদের জ্ঞান আমার প্রভুর নিকটে এক গ্রন্থে সংরক্ষিত; আমার প্রভু কখনো ভুল করেন না, কখনো ভুলে যান না।’ (সুরা ত্বা-হা, আয়াত: ৫১-৫২)
মক্কা আল-মুকাররমা সনদের ইংরেজি সংস্করণের প্রচ্ছদউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল র প র ঙ গণ ক ত কর র জন য ত হয় ছ বল ছ ন সনদ র ইসল ম উপস থ ই সনদ
এছাড়াও পড়ুন:
আমি একা সেফ এক্সিট নিয়ে কী করব: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “কে কী চায়, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়৷ আমার ছেলে-মেয়ে সবাই দেশে৷ আমি একা সেফ এক্সিট নিয়ে কী করব?”
রবিবার (১২ অক্টোবর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের সেনাবাহিনীর হেফাজতে রেখে বিচারকার্য করার বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, “সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য যেকোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ওসিদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাতে কোনো আইনবহির্ভূত কাজ না করেন, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/রফিক