আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে একই দিনে। চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় নির্বাচন, গণভোটসহ অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি। ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’

অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো.

সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি পেল।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমাদের একটি গুরুদায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমি ঘোষণা করেছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।’

ভাষণে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় ৯ মাস ধরে যে কাজ করেছে, সে কথাও তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন প্রণীত জুলাই সনদে সংবিধানবিষয়ক ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিছু প্রস্তাবে সামান্য ভিন্নমত আছে। বাকি অল্প কিছু প্রস্তাবে আপাতদৃষ্টে মনে হয় অনেক দূরত্ব আছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে এসব প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও আসলে মতভিন্নতা খুব গভীর নয়। কেউ সংস্কারটা সংবিধানে করতে চেয়েছেন, কেউ আইনের মাধ্যমে করতে চেয়েছেন। কিন্তু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে কারও মধ্যে মতভেদ নেই। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য বক্তব্য যতখানি পরস্পরবিরোধী অবস্থান আছে বলে মনে হয়, জুলাই সনদ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে ততখানি মতপার্থক্য দেখা যায় না। এটি অনন্য অর্জন। এতে জাতি এগিয়ে যেতে সাহসী হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান-সংক্রান্ত। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ভিন্নমত আছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়। গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ সরকারকে দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে গণভোটের সময় নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরপর সরকার দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সাত দিনের সময় দেয়। তবে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়নি এবং তারা সরকারকে কোনো ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দিতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিল। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকেই ভিত্তি ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের দাবি সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং ন্যায়পাল, সরকারি কর্মকমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পদ্ধতির বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত গুরুত্ব পাচ্ছে না। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর দাবি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হচ্ছে না। আর এনসিপির দাবি ছিল, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তাদের এই দাবিও পূরণ হয়নি।

জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুমোদনের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে।’ গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে বলে জানান তিনি।

চার বিষয়ে গণভোট, প্রশ্ন হবে একটি

জুলাই জাতীয় সনদে মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোট হবে। প্রস্তাবগুলোকে চারটি বিষয়ে ভাগ করে একটি প্রশ্নে হবে গণভোট।

প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, গণভোটের প্রশ্নটি হবে এ রকম: ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’

ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

গ. সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।’

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ

সরকারের সিদ্ধান্ত তথা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী, গণভোটের প্রশ্নের প্রথম বিষয় হলো: ‘নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে’।

জুলাই সনদে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), ন্যায়পাল, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) নিয়োগের পদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সরকারি দল, বিরোধী দল ও ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে এসব সাংবিধানিক পদে নিয়োগ হবে।

নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে একমত হলেও বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এভাবে নিয়োগের বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত আছে। দলটি এসব প্রতিষ্ঠানে আইনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে। তবে গণভোটে বিএনপির এই ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের যে পদ্ধতি ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে একমত জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।

এ ছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে তার কিছু অংশ নিয়েও ভিন্নমত আছে বিএনপির।

যে ৩০ বিষয়ে ঐকমত্য

গণভোটের প্রশ্নের একটি বিষয় হলো, দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে—এমন ৩০টি সংস্কার প্রস্তাব। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে ৩০টি বিষয়ের সব উল্লেখ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই ৩০টি প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত। এর মধ্যে আছে ভাষা, নাগরিকের পরিচয়, সংবিধানের (৭ক) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা, ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং পঞ্চম ও সপ্তম তফসিল বিলুপ্তি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান, সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন, প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা–অযোগ্যতা, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির পদ্ধতি, ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, বিচারকদের চাকরি নিয়ন্ত্রণ, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ, সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংশোধন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ এবং সংসদ, সংসদের কমিটি ও সদস্যদের অধিকার–দায়সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন।

এই ৩০ বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল মোটাদাগে একমত। তবে আদেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঐকমত্য হয়েছে উল্লেখ করা হলেও এ বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত আছে। ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং পঞ্চম ও সপ্তম তফসিল বিলুপ্তির প্রস্তাব নিয়েও বিএনপির বক্তব্য আছে। দলটি বলে আসছে, এটি ঐকমত্য কমিশনে যেভাবে আলোচনা হয়েছে, সনদে সেভাবে নেই।

ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ

গণভোটের প্রশ্নের দ্বিতীয় বিষয় হলো, উচ্চকক্ষ গঠন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে বলেন, গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’সূচক হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এই প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবেও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের কথা ছিল। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন লাগবে।

জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি একমত হলেও এই প্রস্তাবে বিএনপির ভিন্নমত আছে। বিএনপি চায়, একটি দল নিম্নকক্ষে যে পরিমাণ আসন পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হবে। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধন করতে উচ্চকক্ষের অনুমোদন নেওয়ারও বিপক্ষে বিএনপি।

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রায় দেড় যুগ ধরে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁরা আজ আসন্ন নির্বাচনে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তা না হলে জাতি এক মহাবিপদের সম্মুখীন হবে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪-এর জুলাইয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে দেশবাসী যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, আমরা জীবিতরা যেন অল্পস্বল্প ভিন্নমত ও লঘু বিবাদে জড়িয়ে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করি। ১৩৩ শিশু, শত শত তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের অঙ্গহানির যে আত্মত্যাগ, সেটিকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। জনগণ সামান্য যা চায় তা হচ্ছে, এই অগণিত হতাহতের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা সবাই যেন ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাই। দলীয় স্বার্থ অতিক্রম করে, সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় চাওয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি আশা করি আমাদের এই সিদ্ধান্ত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে। একটি উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচনের দিকে জাতি এগিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করব। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালাম।’

অন্য প্রস্তাবগুলোর কী হবে

সনদ বাস্তবায়ন আদেশে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অপরাপর সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করবে। এসব প্রস্তাবের ক্ষেত্রে দলগুলোর ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যেমন জুলাই জাতীয় সনদের একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করা হবে যে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকবেন না। এই প্রস্তাবে বিএনপিসহ চারটি দলের ভিন্নমত আছে। জুলাই সনদে এ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলের মতামত অংশে বলা হয়েছে, বিএনপির মত হলো প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন। এই প্রস্তাবে দলের মতামত অংশে নোট আকারে বলা আছে, অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

লালদিয়া টার্মিনাল প্রসঙ্গ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতিকে গভীর গহ্বর থেকে উদ্ধার করা ছিল তাঁদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। গত ১৫ মাসে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে সক্ষম হয়েছেন। রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রিজার্ভসহ অর্থনীতির সব সূচকে দেশ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাত ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করতে নানামুখী পদক্ষেপ চলমান রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ কমলেও বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ অর্থাৎ এফডিআই ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে এক অনন্য অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আগামী সপ্তাহে ডেনমার্কভিত্তিক মায়ার্স্ক গ্রুপের মালিকানাধীন এপিএম টার্মিনালস বিভির সঙ্গে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এই চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় এই কোম্পানি ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। এটি এযাবৎকালে বাংলাদেশে ইউরোপের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ। লালদিয়া হবে দেশের প্রথম বিশ্বমানের গ্রিন পোর্ট।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ভ ন নমত জ ল ই জ ত য় সনদ র ষ ট রপত র র জন ত ক দল দলগ ল র প র ঐকমত য হয় র প রস ত ব গ রহণ কর অন ষ ঠ ন ন অন ষ ঠ র অন প ত প রক র য় র প রথম সরক র র বর ণ ত ঠ ত হব র র জন লক ষ য র জন য এসব প এনস প সদস য র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সব দলের ঐক্য ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কঠিন হবে: নাগরিক কোয়ালিশন

‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কারের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো বলে মন্তব্য করেছে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘নাগরিক কোয়ালিশন’। তবে তারা মনে করছে, সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এর পূর্ণ বাস্তবায়ন দুরূহ হবে। আদেশ অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সহায়তা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলসহ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে প্ল্যাটফর্মটি।

বৃহস্পতিবার প্ল্যাটফর্মের পক্ষে এমন বিবৃতি পাঠিয়েছেন নাগরিক কোয়ালিশনের সহসমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর। বিবৃতিতে বলা হয়, ঐতিহাসিক জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ শিরোনামে গেজেট প্রকাশ করেছে। গেজেট প্রকাশের আগে আজই জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই আদেশ প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং সবাইকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ সব সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংস্কারের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য গণভোট আয়োজনের রূপরেখা তুলে ধরেন।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ প্রণয়নকে স্বাগত জানিয়ে নাগরিক কোয়ালিশন বলেছে, এই আদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হবে। আমরা মনে করি, ইতিপূর্বে প্রকাশিত ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাবের কিছু ধারা ও তফসিল (নোট অব ডিসেন্ট–সংক্রান্ত) সম্পর্কিত ব্যাপারে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যে আশঙ্কা বা আপত্তি ছিল, সেটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হয়েছে।

আনুপাতিক ভোটের (পিআর) ভিত্তিতে সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন—গত মে মাসে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরা নাগরিক কোয়ালিশনের এ দুটি প্রস্তাব গণভোটের প্রশ্ন হিসেবে রাখা হয়েছে।

এতে প্ল্যাটফর্মটি আনন্দিত জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যকর ও ভারসাম্যমূলক উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হবে, যারা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আমাদের দেশে সব ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ভূমিকা রাখবে।

বিবৃতি বলা হয়েছে, আগামী সংসদ যাতে একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবেও কাজ করতে পারে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচন ও গণভোট যাতে একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়—এমন দুটি বিষয়ও কোয়ালিশনের প্রস্তাবে ছিল। এগুলো সরকার গ্রহণ করায় প্ল্যাটফর্মটি আনন্দিত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গোঁজামিলের গণভোট অগ্রহণযোগ্য: বাংলাদেশ জাসদ
  • সব দলের ঐক্য ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কঠিন হবে: নাগরিক কোয়ালিশন
  • জুলাই সনদ, জাতীয় নির্বাচন, গণভোট, সংসদের উচ্চকক্ষসহ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে যা যা আছে
  • প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন আলী রীয়াজ
  • প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ
  • জাতীয় নির্বাচন, গণভোট একই দিনে: প্রধান উপদেষ্টা
  • বৈঠকে বসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ, পরে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ
  • গণভোটে ৪টির বেশি প্রশ্ন রাখার চিন্তা সরকারের
  • সনদের বিষয়ে সুরাহা না হওয়াটাই নির্বাচনের আগে একমাত্র সংকট
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের শেষ চেষ্টা, বিএনপি–জামায়াত–এনসিপি কী ভাবছে