গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনের ঘোষণা দীর্ঘ ৭ বছর পর শিক্ষার্থীদের মাঝে আশার সঞ্চার করলেও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রায় ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রকাশ করা হয়নি কোনো রোডম্যাপ, তফসিল বা কার্যকর প্রস্তুতির চিত্র। এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে না হওয়া নিয়ে ক্রমেই বাড়ছে সংশয়।

গবি দেশের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ছাত্র সংসদের কাঠামো রয়েছে। চলতি বছরের ২৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রফিকুল আলমকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করে গবি প্রশাসন। এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলেও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কমিশন গঠনের পর থেকে নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ, তফসিল বা প্রস্তুতি প্রকাশ করা হয়নি।

প্রশাসনের ধীরগতি নিয়ে গবির রাজনীতি প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদা আক্তার নূরী বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ শুরু করে ঠিকই, কিন্তু পরে আর সেটার কোনো অগ্রগতি থাকে না। বিভিন্ন মনভুলানো অজুহাত আর অহেতুক জটিলতা দেখিয়ে প্রতিটি বিষয়ই দেরি করানোর নজির অহরহ। শিক্ষার্থীদের উচিত কালক্ষেপণ না করে দ্রুতই নির্বাচন কার্যকর করার জন্য অগ্রসর হওয়া।”

ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস অনুষদের শিক্ষার্থী মাজেদ সালাফি বলেন, “একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ (গকসু) আছে। নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যেই গকসু তৈরি। কিন্তু আজ সেখানেও বিভিন্ন জটিলতার অজুহাত বিরজমান। সব জটিলতা প্রহসন সরিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করে গকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত।”

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আইন বিভাগের সভাপতি রফিকুল আলম বলেন, “নির্বাচন হবে, কিন্তু কিছুটা সময়সাপেক্ষ। ভোটার তালিকা, রোডম্যাপ, তফসিলসহ এখানে কিছু আলোচনার বিষয় আছে। কিছু সংশোধন সংযোজন-বিয়োজনেরও বিষয় আছে। একইসঙ্গে জাতীয় বিষয়াদিও আছে।”

ঢাকা/সানজিদা/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে বিত্তশালী ও সুবিধাবাদীর লাভ বেশি

সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সরাসরি ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন নিয়ে গত ২৯ এপ্রিল সমকালে প্রকাশিত নিবন্ধের ওপর মতামত দিয়েছেন অনেকেই। অনেকেই একমত, একটি আসনে একই সঙ্গে সাধারণ ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য থাকলে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি হবে; যার প্রভাব ভয়াবহ হতে বাধ্য। সে কারণে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এই ব্যবস্থা চালু হলে অদূর ভবিষ্যতে এক ঝাঁক নারী নেত্রীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে এবং তারা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন। 

কমিশন বর্তমান এক কক্ষের পরিবর্তে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর সুপারিশ করেছে। বর্তমান ব্যবস্থার মতো প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে ৪০০ আসনের নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ১০০ জন নারী ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসন থেকে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। আইন পাসের ক্ষমতা থাকবে নিম্নকক্ষের কাছে, মেয়াদ চার বছর।

ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি কী? এ পদ্ধতিতে মোট ৪০০ আসনের মধ্যে ‘লটারি অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি’তে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এসব আসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে কেবল নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। চাইলে যে কোনো নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। এ ছাড়া পুরুষদের সঙ্গে সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে পারবেন নারীরা। পরের নির্বাচনে ওই ১০০ আসন বাদে বাকি ৩০০ আসনের মধ্য থেকে নতুন করে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করা হবে। এভাবে চার মেয়াদে দেশের সব আসনে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। কমিশন মনে করে, এভাবে চলতে থাকলে একসময় নারীরা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়ে উঠবেন। 

তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তাবটি ভালো। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, এটি ‘ইতিবাচক বৈষম্য’, যা জুরিসপ্রুডেন্সে গ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানেও এমন বিধান আছে। তবে রাতারাতি সংসদ নির্বাচনে ২৫ শতাংশ আসন ঘূর্ণায়মান ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হলে রাজনৈতিক দলগুলো মানবে না। তৃণমূল রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যাবে, কেন মানবে না। 

রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে স্বপ্ন থাকে, তিনি এক সময় এমপি হবেন। সে জন্য ১০-১৫ বছর ধরে এলাকায় অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। হঠাৎ সেই আসনটি নারীর জন্য সংরক্ষিত হয়ে গেলে তিনি মানবেন? কোনো দলের প্রধানের নির্বাচনী আসনটি রাতারাতি সংরক্ষিত নারী আসন হিসেবে ঘোষণা করা হলে তিনি কি মানবেন? 
দেখা যাবে, কোনো আসন সংরক্ষিত ঘোষণা হওয়ার পর সেখানকার পুরুষ নেতা তাঁর মা, স্ত্রী বা মেয়েকে প্রার্থী করে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়বেন। মা জায়েদা খাতুনকে মেয়র বানিয়ে নিজে সব কাজ করতেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। নোয়াখালীর হাতিয়া আসনের মোহাম্মদ আলী নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ায় তাঁর স্ত্রী সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। 
এমনকি নারীর প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। নির্বাচনের পর পুরুষ নেতারা ওই আসনের নারী প্রার্থীদের মামলা, হামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাহস না করেন। এমন পরিস্থিতিতে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে, না পিছিয়ে যাবে?

ঢাকার কথাই ধরা যাক। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা জেলার মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াবে ২৫, যার মধ্যে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন হবে পাঁচটি। এই পাঁচ আসনে কি স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করা নারী মনোনয়ন পাবেন? মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারবেন? দুই-একটি বাদে বাকি আসনে তৃণমূলে রাজনীতি করা নারীদের সংসদ নির্বাচন করার মতো আর্থিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতাই নেই। এ অবস্থার সুযোগ নিতে পারেন টাকাওয়ালারা। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দল থেকে মনোনয়ন কিনতে পারেন অর্থবান পুরুষের স্ত্রী, শ্বাশুড়ি, কন্যা বা নিকটাত্মীয়। যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে, তারা আইন প্রণয়নে ব্যাপক প্রভাব খাটাতে পারেন ওই সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে।  

দেখা যাবে, ঢাকায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী পরিবারের নারীরা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে টাকা ছিটাতে শুরু করবেন। তাদের হয়ে কাজ করবেন পুরুষ টাউটরা। এদের টাকার কাছে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি করা নারীরা অসহায় হয়ে যাবেন। এক পর্যায়ে তারাও টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাবেন। ফলে স্থানীয় রাজনীতি করবেন তৃণমূলের দরিদ্র নারীরা। আর সংসদ সদস্য হবেন ঢাকার এলিটরা। 
২০০৯ সালে সংরক্ষিত আসন থেকে এমপি হওয়ার পর ২০১৪ এবং ’১৮ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইর আসন থেকে এমপি হন গায়িকা মমতাজ বেগম। তিনি সেখানে হাসপাতাল বানিয়েছেন। মানুষের সেবা করেছেন। কিন্তু মানুষ তাঁকে মেনে নেননি; ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনেও হেরে গেছেন স্থানীয় এক পুরুষ নেতার কাছে। সরকার পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা। 

অন্যদিকে ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়ে এলাকায় কাজ করেছেন, সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেও পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি হবিগঞ্জ-১ আসনের আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। প্রচুর পরিশ্রম করে মানুষের মন জয় করেছেন। ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন।

বিএনপির আসিফা আশরাফী পাপিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতি করে হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্র রাজনীতি শেষ করে বিএনপির রাজনীতি করেন। তাঁর স্বামী বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের চেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির রাজনীতিতে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই তিনি। সেটি সম্ভব হয়েছে প্রান্ত থেকে রাজনীতি করেছেন বলেই। 
তৃণমূল নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আরেকটি সুপারিশ করা উচিত নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের। সেটি হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন অথবা কোনো সংস্কার কমিশনের সদস্য হয়ে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে কোনো নারী যেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উচ্চকক্ষ অথবা নিম্নকক্ষের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। অন্তত শুধু আগামীবারের জন্য। না করলে সেটি হবে স্বার্থের সংঘাত।  
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা এলেই বলা হয়– সংসদে নারীদের আনতে হবে। অবশ্যই নারীদের সংসদে আনতে হবে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতির সুযোগ না দিয়ে রাতারাতি বিভিন্ন আইনকানুনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সদস্য বানালে কী লাভ হবে? বরং সমাজে নারী-পুরুষ বিরোধ বেড়ে যাবে। 

নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলেছে, পুরুষদের বিরোধিতার মুখে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি বাদ দেওয়া সঠিক কাজ হবে না। কারণ পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চালু করে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আমরাও স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি শুরু করতে পারি। রাজনৈতিক দলগুলো এখন চাপের মধ্যে আছে। এই অবস্থায় তাদের দিয়ে নারীর প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য ব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজি করানো যাবে। কিন্তু সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে কোনোটিই বাস্তবায়িত হবে না।

কামরান রেজা চৌধুরী: সাংবাদিক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ