‘যাই আর ঘুইরা আহি, ঔষধও পাই না চিকিৎসাও পাই না’
Published: 11th, May 2025 GMT
‘যাই আর ঘুইরা আহি, ক্লিনিক বন্ধ থাহে। ঔষধও পাই না, চিকিৎসাও পাই না। সরকার চরের মানষের চিকিৎসার লাইগা এত সোন্দর ক্লিনিক করছে; কিন্তু ডাক্তার থাহে না। এত টাহা খরচ করি কি লাভ হইছে? ক্লিনিক আমাগোর কোনো কাজে লাগতাছে না।’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন উলিপুরের ঘুঘুমারী চরের ৪২ বছর বয়সী ছকিনা বেওয়া।
হাতিয়া কামারটারী গ্রামের লিপি রানী কান্তি। তাঁর বাড়ির কাছেই রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। কিছু হলে যান চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসক না থাকায় শুধু সাধারণ রোগের ওষুধ পান বলে অভিযোগ তাঁর। তিনি বলেন, ‘নারীর গোপন অসুবিধার কথা পুরুষকে বলতে পারি না। ক্লিনিকের কম্পাউন্ডার (প্রোভাইডার) তো ডাক্তার না। তিনি কি চিকিৎসা দেবেন? মহিলা কর্মী ও ডাক্তার থাকলে মা ও শিশুর চিকিৎসা নিতে পারতাম।’
ছকিনা বেওয়া ও লিপি রানীর মতো একই ধরনের কথা বলেন ঠুটিয়ারপাড় গ্রামের ফজলুল হক, সুখের চরের রোজিয়া বেগম ও মালা বেগম। তাদের অভিযোগ, ক্লিনিক নিয়মিত খোলা হয় না। খুললেও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে চলে যান। বিষয়টি স্বীকার করে চর ঘুঘুমারী কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোভাইডার জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘তিনটি নদী পার হয়ে যেতে হয়। ফোন করে মাঝেমধ্যে যাই। নামাজের চর ক্লিনিকেও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছি।’
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ও প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ৫৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে নদীবেষ্টিত চারটি ইউনিয়নের চরে ১৩টি রয়েছে। এসব ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়োগ দেওয়া হয়। ওষুধ সরবরাহ করা হয় ২১ পদের। এসব ক্লিনিকে কর্মরত রয়েছেন ৫৬ জন। একটি পদ শূন্য আছে।
হিজলী গোপপাড়া ঠুঠিয়ার পাড় কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মোজাফ্ফর রহমানের ভাষ্য, ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা বন্ধ থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী বেড়েছে। জনবল না থাকায় তাঁকে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, কম্পিউটার অপারেটর, কেরানি, ঝাড়ুদার ও পিয়নের কাজসহ মিটিং-সিটিং সব একাই করতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে। পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) ও উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) সপ্তাহে দু’দিন বসার কথা। ১৪ বছরে একদিনও কেউ আসেননি। ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।
জানা গেছে, এসব ক্লিনিকে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচি, সন্তান প্রসব, প্রসব-পরবর্তী ও পূর্ববর্তী যত্ন, পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ দিতে সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। সপ্তাহে দু’দিন করে এফডব্লিউএ ও স্যাকমো বসার সিদ্ধান্ত থাকলেও তারা আসেন না। ফলে প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সাহেবের আলগার পরিবারকল্যাণ সহকারী মনোয়ারা বেগম বলেন, চর ঘুঘুমারী ক্লিনিকে কয়েকটি নদী পাড়ি দিয়ে যেতে-আসতে অনেক খরচ। ওষুধ ও নারীদের জন্য চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ না থাকায় ক্লিনিকে যাওয়া হয় না।
ধামশ্রেনী ইউনিয়ন মডেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো.
ক্লিনিকে আসা রোগী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সর্দি, জ্বরসহ সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয় কমিউনিটি ক্লিনিকে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা মেলে না। ৯ মাস ধরে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ থাকায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী বেশি এলেও সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
সাহেবের আলগা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোজাফ্ফর রহমানের বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় তিনটি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। মুমূর্ষু রোগীকে উলিপুর অথবা কুড়িগ্রামের হাসপাতালে নিতে হয়। এভাবে কয়েকজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি।
জনবল সংকটের কারণে অনেক ক্লিনিকে পরিবারকল্যাণ সহকারী নেই বলে জানান উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন। তিনি বলেন, সমস্যার বিষয়টি জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি স্বাস্থ্যের দুই বিভাগের সমন্বয়হীনতাকেও এ অবস্থার জন্য দায়ী করেন।
ক্লিনিকের কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ক্লিনিক বন্ধ থাকে, এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবারকল্যাণ সহকারী ও উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বসেন না। এটি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিষয়, আমাদের করার কিছু নেই।’ তিনিও দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে এ অবস্থার জন্য দায়ী করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বন ধ থ ক ব যবস থ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
এশিয়াসহ বিশ্বের চালের বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এশিয়ায় চালের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত বাজারে চালের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
থাইল্যান্ডসহ চালের অন্যান্য বড় উৎপাদনকারী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্যসূচক অনুযায়ী, চলতি বছর চালের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এমনকি বিশ্ববাজার চালের দাম আগস্ট মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। খবর দ্য নেশনের
থাইল্যান্ডে চালের দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা একদম নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষিবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চালের দাম কম থাকায় দেশটির কৃষকেরা ধানের আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
থাইল্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৩৩৫ ডলার। আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩৩৮ ডলার। থাইল্যান্ডের কৃষি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৪ বছরে থাই সরকারের জনতুষ্টিমূলক নীতির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ৪০ বিালিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হলেও একধরনের নীতিগত ফাঁদ তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ এসেছে। এটাও দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো চালের গুণগত মানের উন্নতি করেছে। আধুনিকতা এনেছে উৎপাদনব্যবস্থায়। ফলে তারা কম খরচে ভালো মানের চাল রপ্তানি করতে পারছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এখনো ভর্তুকিনির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এফএওর সূচক কমেছেপ্রতি মাসেই খাদ্যমূল্যসূচক করে থাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কেমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৯৮ দশমিক ৪–এ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১১৩ দশমিক ৬। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক ছিল ১২৫ দশমিক ৭। সেই হিসাবে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি–নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এ ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে চালের দাম কমতে শুরু করে।