‘যাই আর ঘুইরা আহি, ক্লিনিক বন্ধ থাহে। ঔষধও পাই না, চিকিৎসাও পাই না। সরকার চরের মানষের চিকিৎসার লাইগা এত সোন্দর ক্লিনিক করছে; কিন্তু ডাক্তার থাহে না। এত টাহা খরচ করি কি লাভ হইছে? ক্লিনিক আমাগোর কোনো কাজে লাগতাছে না।’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন উলিপুরের ঘুঘুমারী চরের ৪২ বছর বয়সী ছকিনা বেওয়া।
হাতিয়া কামারটারী গ্রামের লিপি রানী কান্তি। তাঁর বাড়ির কাছেই রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। কিছু হলে যান চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসক না থাকায় শুধু সাধারণ রোগের ওষুধ পান বলে অভিযোগ তাঁর। তিনি বলেন, ‘নারীর গোপন অসুবিধার কথা পুরুষকে বলতে পারি না। ক্লিনিকের ক­ম্পাউন্ডার (প্রোভাইডার) তো ডাক্তার না। তিনি কি চিকিৎসা দেবেন? মহিলা কর্মী ও ডাক্তার থাকলে মা ও শিশুর চিকিৎসা নিতে পারতাম।’
ছকিনা বেওয়া ও লিপি রানীর মতো একই ধরনের কথা বলেন ঠুটিয়ারপাড় গ্রামের ফজলুল হক, সুখের চরের রোজিয়া বেগম ও মালা বেগম। তাদের অভিযোগ, ক্লিনিক নিয়মিত খোলা হয় না। খুললেও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে চলে যান। বিষয়টি স্বীকার করে চর ঘুঘুমারী কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রোভাইডার জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘তিনটি নদী পার হয়ে যেতে হয়। ফোন করে মাঝেমধ্যে যাই। নামাজের চর ক্লিনিকেও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছি।’
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ও প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ৫৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে নদীবেষ্টিত চারটি ইউনিয়নের চরে ১৩টি রয়েছে। এসব ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়োগ দেওয়া হয়। ওষুধ সরবরাহ করা হয় ২১ পদের। এসব ক্লিনিকে কর্মরত রয়েছেন ৫৬ জন। একটি পদ শূন্য আছে।
হিজলী গোপপাড়া ঠুঠিয়ার পাড় কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মোজাফ্‌ফর  রহমানের ভাষ্য, ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা বন্ধ থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী বেড়েছে। জনবল না থাকায় তাঁকে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, কম্পিউটার অপারেটর, কেরানি, ঝাড়ুদার ও পিয়নের কাজসহ মিটিং-সিটিং সব একাই করতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে। পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) ও উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) সপ্তাহে দু’দিন বসার কথা। ১৪ বছরে একদিনও কেউ আসেননি। ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। 
জানা গেছে, এসব ক্লিনিকে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচি, সন্তান প্রসব, প্রসব-পরবর্তী ও পূর্ববর্তী যত্ন, পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ দিতে সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। সপ্তাহে দু’দিন করে এফডব্লিউএ ও স্যাকমো বসার সিদ্ধান্ত থাকলেও তারা আসেন না। ফলে প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সাহেবের আলগার পরিবারকল্যাণ সহকারী মনোয়ারা বেগম বলেন, চর ঘুঘুমারী ক্লিনিকে কয়েকটি নদী পাড়ি দিয়ে যেতে-আসতে অনেক খরচ। ওষুধ ও নারীদের জন্য চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ না থাকায় ক্লিনিকে যাওয়া হয় না। 
ধামশ্রেনী ইউনিয়ন মডেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো.

শরিয়ত উল্ল্যা বলছিলেন, ‘ওষুধ না থাকায় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ। কেন্দ্রে গিয়ে বসে থাকি আর মানুষের গালি খাই। বিভাগীয় কোনো নির্দেশনা না থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়া হয় না।’
ক্লিনিকে আসা রোগী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সর্দি, জ্বরসহ সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয় কমিউনিটি ক্লিনিকে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা মেলে না। ৯ মাস ধরে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ থাকায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী বেশি এলেও সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
সাহেবের আলগা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোজাফ্‌ফর রহমানের বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় তিনটি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। মুমূর্ষু রোগীকে উলিপুর অথবা কুড়িগ্রামের হাসপাতালে নিতে হয়। এভাবে কয়েকজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি।
জনবল সংকটের কারণে অনেক ক্লিনিকে পরিবারকল্যাণ সহকারী নেই বলে জানান উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন। তিনি বলেন, সমস্যার বিষয়টি জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি স্বাস্থ্যের দুই বিভাগের সমন্বয়হীনতাকেও এ অবস্থার জন্য দায়ী করেন।
ক্লিনিকের কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ক্লিনিক বন্ধ থাকে, এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবারকল্যাণ সহকারী ও উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বসেন না। এটি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিষয়, আমাদের করার কিছু নেই।’ তিনিও দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে এ অবস্থার জন্য দায়ী করেন।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বন ধ থ ক ব যবস থ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ন্যায্য মূল্য পান না পেঁয়াজচাষি, মজুতদারদের পোয়াবারো

বর্তমানে বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু, চাষিরা এমন উচ্চমূল্য পাননি। চাষির ঘরে এখন পেঁয়াজ নেই। মৌসুমের শুরুতেই ২০ থেকে ৩০ টাকায় তারা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। এখন সেই পেঁয়াজই দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের পকেটে। 

শনিবার (১০ মে) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি সফিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডি ডটকমের এ প্রতিবেদক। সফিউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ক্ষেতে ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু, ২২ টাকার চেয়ে বেশি দাম পাইনি। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারিনি। আজ যখন পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তখন আমার ঘর ফাঁকা।” 

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন। এ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি হয়েছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিয়েছে সংরক্ষণে। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে কৃষকরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এখন বাজারে সেই পেঁয়াজই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে, পেঁয়াজের মজুতদারদের পোয়াবারো।

যাত্রাবাড়ীর পাইকারি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেছেন, “চাষিরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করেন। তখন আমরা মজুত করি। এখন দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়া অন্যতম কারণ।”

এ বিষয়ে কৃষি উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “এ বৈষম্য আমাদের কৃষিব্যবস্থার বড় দুর্বলতা। কৃষক উৎপাদন করেন ঠিকই, কিন্তু ন্যায্য মূল্য পান না। অন্যদিকে, কিছু ব্যবসায়ী মজুতের মাধ্যমে ফায়দা লুটে নেন। এটা রোধ করতে হলে উৎপাদন থেকে বাজার পর্যন্ত একটি সুসংহত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।”

তিনি জানান, সরকার কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। পেঁয়াজের জন্য পৃথক হিমাগার স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে কৃষক এভাবে ঠকবেন না।

এই বাজার ব্যবস্থায় বিপাকে আছেন ভোক্তা ও উৎপাদক দু’পক্ষই। লাভ হচ্ছে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের। 

রাজধানীর বাসিন্দা সানজিদা শ্যামা বলেছেন, চৈত্র মাসে শুনেছি, কৃষকরা পেঁয়াজ ফেলেও দিয়েছেন দাম না পেয়ে। এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা দিয়ে! তাহলে কার লাভ, কার ক্ষতি?

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি মৌসুমেই একই রকম ভুক্তভোগী হন—উৎপাদন করে লোকসান, আর বাজারে সেই পণ্য বিক্রি হয় চড়া দামে। পেঁয়াজের বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করল, উৎপাদন বাড়লেই কৃষকের লাভ বাড়ে না। বাজার ব্যবস্থাপনা সুসংহত না হলে কোনো লাভই কৃষকের ঘরে পৌঁছায় না। সময় এসেছে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কথা নয়, কাজ দেখানোর।

ভোক্তাদের সংগঠন সচেতন নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক শামীমা হক বলেন, পেঁয়াজের বাজার একটি চক্রের হাতে। এখানে স্বচ্ছতা নেই। কৃষককে রক্ষা করতে হলে উৎপাদন-পরবর্তী ন্যায্য বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ মৌসুম শেষে সংরক্ষণ করা যায় না। দেশে বিদ্যমান হিমাগারগুলো মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য নির্মিত, যা পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। কৃষকরা তাই কম দাম পেলেও বাধ্য হয়ে আগেই বিক্রি করেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ফিরোজ কবির বলেছেন, কৃষক দাম না পেলে চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। এতে ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। তখন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এই চক্র রোধ করতে হলে উৎপাদনকারীকে লাভ দিতে হবে। 

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকিসহ মজুত-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল কৃষি বিপণন চালু করে সরাসরি বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। মজুদার ও বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ করতে হবে।

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নড়াইল জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের অপসারণ দাবিতে মানববন্ধন
  • গৃহকর্মী সরবরাহ করে হ্যালো টাস্কের বছরে আয় এখন ১ কোটি টাকা
  • ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পর আলোচনায় সিন্ধু পানিচুক্তি
  • যুদ্ধের আবহে এক সপ্তাহে পাকিস্তানের শেয়ার সূচক কমেছে ৬,৯৩৯ পয়েন্ট
  • পুতিনের প্রতি ৩০ দিনের নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান ইউরোপের নেতাদের
  • ন্যায্য মূল্য পান না পেঁয়াজচাষি, মজুতদারদের পোয়াবারো
  • চালের দাম আরও কমেছে ডিম-সবজির বাজার চড়া