ঢাকায় রাজউকের এক কর্মচারীর ৩৬ ফ্ল্যাট
Published: 18th, May 2025 GMT
‘আমি চাকরিজীবনে কারও ক্ষতি করিনি। বিভিন্ন সাংবাদিকের উপকার করেছি। বিভিন্ন সময় তিনজন সাংবাদিক আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আল্লার কী খেল, তিনজনই অকালে মারা গেছেন।’
রাজধানীতে ৩৬টি ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিদর্শক কাজী আমীর খশরু এই বক্তব্য দিয়েছেন। দ্রুত তাঁর কাছে তিন সাংবাদিকের নাম জানতে চাওয়া হয়। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে তিনজনের নাম জানালেন।
তাৎক্ষণিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিন সাংবাদিকই জীবিত আছেন। একজন বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, আরেকজন একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। অন্যজন একটি দৈনিকে কর্মরত। এ তথ্য জানালে কাজী আমীর খশরু কিছুটা নমনীয় হন। তাঁর সম্পদপ্রাপ্তির নিজস্ব ব্যাখ্যাও দেন।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, উপইমারত পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের সময় আমীর খশরুর বেতন স্কেল ছিল ১ হাজার ৪৮০ টাকা। মাসে মূল বেতন ছিল প্রায় চার হাজার টাকা। চাকরিজীবনের ৩২ বছরে নানা সময় নানা অভিযোগে এক যুগেরও বেশি সময় তিনি সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। বর্তমানে তাঁর বেতন প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
রাজধানীতে আমীর খশরু ও তাঁর স্ত্রীর নামে ৩৬টি ফ্ল্যাট আছে। উত্তরায় ৩০ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট আছে। সব মিলিয়ে শতকোটি টাকার সম্পদ তাঁর। প্রাপ্ত অভিযোগ ও কাগজপত্র যাচাই করেছে সমকাল। তথ্য সংগ্রহ করেছে সরেজমিন।
বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১০ নম্বর রোডের ৭৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ছয়তলা বাড়িটির নাম ফারিয়া নিশাত কুঞ্জ। আনুমানিক পাঁচ কাঠা আয়তনের কর্নার প্লটের বাড়িটির কাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। নিচতলায় পার্কিং, গার্ডরুম, একটি ফ্ল্যাট ছাড়াও অন্য তলাগুলোতে রয়েছে দুটি করে ১১টি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া। আমীর খশরু মাঝেমধ্যে সেখানে যান। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী মো.
সেই সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১১ নম্বর রোডের ৬৯ ও ৭১ নম্বর হোল্ডিংয়ে দুটি প্লটেরও মালিক এই রাজউক কর্মচারী। তিন কাঠা আয়তনের দুটি প্লটকে এক করে সেখানে ছয়তলা আরেকটি বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। বাড়িটিতে গাড়ি ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য রয়েছে দুটি বড় ফটক। প্রতিটি ফ্ল্যাটে রয়েছে তিনটি বেডরুম, তিনটি বারান্দা, ড্রইং-ডাইনিং, চারটি বাথরুম ও কিচেন কেবিনেট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন প্রায় দুই হাজার বর্গফুট।
ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী ও একাধিক বাসিন্দা জানান, এ বাড়ির তিনটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন আমীর খশরু। তারা বলেন, একেকটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। ভবনের নিচতলায় পার্কিং, গার্ডরুম ও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ১১।
আমীর খশরু সমকালকে বলেন, ‘এই দুটি প্লটের মালিক আমার স্ত্রী। যখন বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তখন ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে আমি কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড (মালিকানাস্বত্ব) কিনে নিই। তখন একেকটি অ্যাওয়ার্ড ৪০-৫০ হাজার টাকায় কেনা যেত। পরে ডেভেলপারকে দিয়ে বাড়ি করি এবং অর্ধেক ফ্ল্যাট পাই।’
বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১২ নম্বর রোডের ৬৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে তিন কাঠার ওপর আরেকটি ছয়তলার বাড়ির সঙ্গে আমীর খশরুর নাম জড়িয়ে আছে। এটিরও প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। তবে এই বাড়ির মালিকের নাম আসলাম বলে জানান বাড়ির একজন নিরাপত্তাকর্মী। আমীর খশরুর একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জানান, খশরুর ভাগনে এই আসলাম। বাড়িটির মূল মালিক তিনি নিজেই। বোন ও ভাগনের নামে এ বাড়ি করেছেন তিনি।
এ বাড়ির বিষয়ে আমীর খশরু বলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজনের কার কী সম্পত্তি আছে, তা আমি জানি না।’
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৭৪১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৭টি ফ্ল্যাটের ছয়তলা বাড়ি রয়েছে আমীর খশরুর। এটি তাঁর প্রথম করা বাড়ি। আনুমানিক পাঁচ কাঠার ওপর গোলাপি, লাল ও আকাশি রং করা বাড়িটিতে একসময় তিনি নিজেই থাকতেন।
বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, বাড়ির মালিক খশরু তেমন একটা আসেন না। তবে একটি ফ্ল্যাটে তাঁর এক আত্মীয় থাকেন। আর ভাড়া তুলে মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কাজী আমীর খশরু সমকালকে বলেন, পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাড়িটিই কেবল তাঁর নামে। তাঁর মা পৈতৃক সূত্রে সেখানে এক কাঠা জমি পেয়েছিলেন। আরও কয়েক কাঠা কিনে পারিবারিকভাবে বাড়িটি তিনি তৈরি করেছেন।
উত্তরায় দুই প্লট
উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ২২/এ নম্বর হোল্ডিংয়ে আমীর খশরুর রয়েছে পাঁচ কাঠার একটি প্লট। গত ৩০ এপ্রিল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে টিনশেড বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সামনে তিনটি দোকান।
পোশাক দোকানি অজন্তা সেলাইঘরের স্বত্বাধিকারী আবদুস সালাম সমকালকে নিশ্চিত করেন, কাজী আমীর খশরু নামে রাজউকের এক ‘কর্মকর্তা’র কাছ থেকেই দোকান ভাড়া নিয়েছেন। তিনি জানান, দোকানগুলো ছাড়াও পেছনে আরও কিছু ভাড়াটিয়া আছেন। সব মিলিয়ে মাসে লাখ টাকার মতো ভাড়া ওঠে। মাস শেষে খশরু নিজে এসে ভাড়া নিয়ে যান। স্থানীয়রা জানান, প্লটটির বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর প্লটের মালিকও এই আমীর খশরু। কর্নারের এই প্লটটিতেও কিছু দোকানপাট বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোকানগুলো থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া পান তিনি।
একটি দোকানের মালিক নিশ্চিত করেন, এটিও আমীর খশরুর। তিনি জানান, মাস শেষে প্লটের মালিক ভাড়া নিয়ে যান। স্থানীয়রা জানান, এই প্লটটির বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোটায় পূর্বাচলে আরেকটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন আমীর খশরু। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগে বরখাস্ত থাকার কারণে রাজউক তাঁকে প্লটের আইডি দেয়নি।
এ প্লটের বিষয়ে আমীর খশরু বলেন, ‘একটি প্লট আমার মায়ের নামে।’ ভাড়াটিয়ারা বলছেন, অন্য প্লটটিও আপনার। আপনি ভাড়া তোলেন। এর জবাবে তিনি কিছু বলেননি।
রাজউকে একচেটিয়া প্রভাব
বিভিন্ন প্লটের ফাইল আটকে রেখে বাণিজ্য করার অভিযোগে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হন আমীর খশরু। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর নামে একটি মামলা করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই মামলা থেকে দায়মুক্তি পান তিনি। তখন তাঁর আইনজীবী ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। আমীর খশরু এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পরে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে খশরুর বিরুদ্ধে দুদক ফের মামলা করে। এবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাজউক। বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আছে।
১৯৯৩ সালে রাজউকে চাকরিতে যোগদানের পর থেকে রাজউকের বিএনপিপন্থি শ্রমিক ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। একসময় ইউনিয়নের সভাপতিও হন। ওই সময় রাজউকে ছিল তাঁর একচেটিয়া প্রভাব। গত ৬ আগস্ট দলবল নিয়ে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানকে চাপ দিয়ে ইন্সপেক্টর পদ নেওয়ার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে রাজউক এখনও তাঁকে কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় পদায়ন করেনি।
এর পর রাজউকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে গত অক্টোবরে তাঁকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়। তিন মাস পর আমীর খশরু আবার রাজউকে বদলি হয়ে আসেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমাকে অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ভুল বুঝতে পেরে আবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেভাবেই তিনি ব্যাখ্যা করুন না কেন, রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হয়েও বৈধ আয়ে এত সম্পত্তির মালিক হওয়া সম্ভব না। এটা খুবই সোজাসাপ্টা ব্যাপার, রাজউকে অনিয়ম-দুর্নীতি আছে। তার ওপর তিনি রাজউকে শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় তিনি এসব সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, বোঝাই যায়। রাজউকের উচিত হবে, এটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা না হলে দুর্নীতির অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারব না।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জউক কর মকর ত র জউক র সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
বিপ্লবের এক বছর পর আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে
এক বছরের সামান্য কিছু আগের কথা। বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম দমন অভিযান চালান, তখন রংপুর শহরে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর দুই হাত ছিল প্রসারিত।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হন। পরিবার জানায়, আহত হয়ে পরে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন সেই গণ–অভ্যুত্থানের একজন শহীদ; যেখানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। শেষ পর্যন্ত ওই আন্দোলনেই শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
শেখ হাসিনা পরে পালিয়ে ভারতে চলে যান। দেশকে নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে রেখে তিনি পালিয়েছেন; কিন্তু তখনো দেশে ছিল আশার আলো।
শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশকে আরও ন্যায়সংগত ও কম দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে বসাতে সহায়তা করেন। এ সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল দেশকে বিশৃঙ্খলা থেকে স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ধীরগতিতে অনেক বাংলাদেশি হতাশ। তাঁরা ভাবছেন, তবে কি আবু সাঈদের মতো বিক্ষোভকারীরা বৃথাই নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, চাকরির স্বল্পতা ও প্রবলভাবে জেঁকে বসা প্রশাসনের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনরোষ আংশিক বাড়িয়ে দিয়েছিল এসব সমস্যা।
গণতান্ত্রিক সংস্কারকাজ দ্রুত কার্যকর করা—শিক্ষার্থীদের জোর দাবি। তাঁরা চাইছেন, গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের অভিযুক্ত নেতা–কর্মী, পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের দ্রুত শাস্তি হোক।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ‘আমাকে কষ্ট দেয়’ উল্লেখ করে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য শেষ হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবেন এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের আতঙ্কিত করবে; কিন্তু এ রকম কিছুই ঘটেনি।’
রমজান আলী আরও বললেন, মুহাম্মদ ইউনূস না থাকলে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপ হতো।
নতুন সূচনা
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের সংস্কারকাজের ভার মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে এসে পড়েছে। এটি এমন এক দেশ; যা (নানা বিষয়ে) এখনো বিভক্ত। সেখানে আবার প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম কাজ। গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী লুটপাট, বিশৃঙ্খলা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। তবে দেশ বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, হিন্দু সংখ্যালঘু ও শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর চালানো সহিংসতা দমনে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি। অন্যদিকে একই সময়ে ‘ইসলামি কট্টরপন্থীরা’ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
বড় পরিসরে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের পরবর্তী লক্ষ্য। তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশ বাহিনীর মতো ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছিলেন। শেখ হাসিনা যেসব প্রতিষ্ঠানকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করেছিলেন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে চাপ মোকাবিলায় সেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর শক্তিশালী করাই ছিল (সংস্কার কর্মসূচির) প্রধান লক্ষ্য।
৫ আগস্ট হাসিনার পতনের বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষ সমবেত হন। সন্ধ্যার হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শোনেন। তাঁর কথায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন; কিন্তু এসব উদ্যাপনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাগ-ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল। কারণ, ২০২৪-এর জুলাই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি।কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। এ পরিস্থিতিতে আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন বলেন, ‘এখন সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।’ গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তোষ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে তাঁর পায়েও গুলি লেগেছিল।
‘আমাদের স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রয়ে গেছে’ মন্তব্য করে আবদুল্লাহ বলেন, ছাত্রনেতারা যে তাগিদ নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনাগুলো শুরু করেছিলেন, তা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।
গত সপ্তাহে মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংস্কার করা একটি ভোটব্যবস্থার আওতায় দেশে নির্বাচন হবে; কিন্তু এর আগেই বিস্তারিত অনেক বিষয়ের সমাধান বাকি; যা রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের কারণে সুরাহা করা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তাঁর সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ‘সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত’ দেশ পেয়েছে। তবে দেশ সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের দায়িত্ব পালনের অর্ধেকের বেশি সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ নিয়ে আলাপ–আলোচনায় কেটে গেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অস্তিত্ব সংকটে পড়ার পর দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গুরুত্বের সঙ্গে বলে আসছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজের বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য সংস্কারের ভার নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রথমে আরও বিস্তৃত পরিসরে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের অবস্থানকে সমর্থন করেছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। আমরা ভেবেছিলাম, দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য শেষ হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবেন এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের আতঙ্কিত করবে; কিন্তু এ রকম কিছুই ঘটেনিরমজান আলী, আবু সাঈদের বড় ভাইজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে সংবিধান ও শাসনব্যবস্থা–সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছে।
অগ্রগতির আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘কোনো ধরনের তিক্ত বিবাদ ছাড়াই’ তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ও একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, সেই সীমা নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিভাজন
সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের নেতাদের নির্বাচিত করতে পারাটা প্রায় ১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ প্রধানত দুটি রাজনৈতিক পরিবার দিয়ে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান (শেখ হাসিনার বাবা) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা শুরু করেন (স্বাধীন হওয়ার পর)।
স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা ও পরে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। বর্তমানে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লন্ডনে বসবাসরত তাঁর ছেলে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার আগ পর্যন্ত দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিয়মিতভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। জালিয়াতির ভোট আখ্যা দিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এদিকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ দেখা না যেতে পারে। কারণ, দেশে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রাম ও মফস্সল এলাকায় জনসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গণ–অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার থেকে পদত্যাগ করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) হাল ধরেন। সমর্থন জোগাড় করতে গত জুলাইতে দলটির নেতারা বিভিন্ন জেলায় ‘দেশ গড়ার’ পদযাত্রা করেন।
তরুণ ভোটাররা সব দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যবর্তী বয়স প্রায় ২৬ বছর (অর্থাৎ দেশের অর্ধেক মানুষ ২৬ বছরের কম বয়সী, বাকি অর্ধেক ২৬ বছরের বেশি বয়সী। এককথায়, জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ)। দেশের অনেক তরুণ শুধু হাসিনার শাসনামল দেখেই বেড়ে উঠেছেন।
গত বছরের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ খান সাগর। তিনি বলেন, ‘প্রজন্ম হিসেবে আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে ভালো কোনো বোঝাপড়া নেই। কারণ, আমরা এটি দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাই নাগরিকেরা যাতে কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারেন, তা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করা উচিত।’
ঢাকার বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক থাহিতুন মরিয়ম। তাঁর আশঙ্কা, অন্য দশটির মতো আরেকটি সাধারণ সমস্যাও অমীমাংসিত রয়ে যেতে পারে। তা হলো এ দেশের প্রথাগত (রক্ষণশীল) সমাজে নারীর প্রান্তিকীকরণের সমস্যার হয়তো সমাধান হবে না। তিনি আরও বলেন, বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন না এলে শুধু নির্বাচন ও সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত বদল আসবে না; বরং এগুলো আবারও ‘পুরুষকেন্দ্রিক, পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক বাস্তবতা’ তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক সংস্কারকাজ দ্রুত কার্যকর করা শিক্ষার্থীদের জোর দাবি। তাঁরা চাইছেন, গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের অভিযুক্ত নেতা-কর্মী, পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের দ্রুত শাস্তি হোক।২০২৪ সালের বিক্ষোভে বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থীকে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল; কিন্তু তাঁরা এখন প্রকাশ্য ভূমিকা থেকে নিজেদের সরিয়ে ফেলেছেন। তবে মরিয়ম বলেন, তিনি এখনো আশা করেন, বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে প্রমাণিত হবে।
মিশ্র অনুভূতি
৫ আগস্ট হাসিনার পতনের বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। সন্ধ্যার হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শুনেছেন।
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গত বছরের গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা জাতীয় বীর হিসেবে গণ্য হবেন এবং ‘শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আইনি সুরক্ষা’ দেবে সরকার। তাঁর এ কথায় উপস্থিত দর্শক–শ্রোতারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
কিন্তু এসব উদ্যাপনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাগ–ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল। কারণ, ২০২৪–এর জুলাই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি।
আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী জানান, তাঁর ভাইকে গুলি করার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন; কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনাই এ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রমজান আলী বলেন, ‘আবু সাঈদ এ অভ্যুত্থানের একজন সুপরিচিত শহীদ।’ তিনি আরও বলেন, যদি তাঁর মামলাই যথাযথভাবে পরিচালনা করা না হয়, তবে বাংলাদেশ কি কখনো কোনো সুবিচার পাবে?
হত্যাকাণ্ডে নিজ ভূমিকার জন্য ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতিতে মামলা চলছে। গত সপ্তাহে তিনি ভারত থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে ছাত্রদের বিপ্লবকে নিজেদের ‘কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রের জন্য সহিংস বাধা’ হিসেবে তিনি আখ্যায়িত করেন।
এদিকে কিছু অধিকারকর্মী বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, নতুন বাংলাদেশে স্পষ্ট কোনো দিশা নেই।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার আটকে গেছে। এ সরকারকে একদিকে সংস্কারহীন নিরাপত্তা খাত সামলাতে হচ্ছে। ‘‘সহিংস ধর্মীয় গোষ্ঠী’’ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কখনো কখনো বাংলাদেশের অধিকার রক্ষার চেয়ে হাসিনার সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে।’
বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক দৈনন্দিন জীবনের বড় রকমের সমস্যাতেও রয়েছেন। কারণ, অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে তা ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
আবদুল কাদের (৩৭) বললেন, ঢাকা শহরে তাঁর এয়ার কন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর মেরামতের দোকানের আয় গণ–অভ্যুত্থানের পর ১০ শতাংশ কমেছে। তিনি বলেন, অস্থিরতার কারণে গ্রাহকেরা সতর্ক হয়ে পড়েছেন। তবে তিনি আশা করেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে কিছুটা স্বস্তি তৈরি হতে পারে।
আবদুল কাদের আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে মানুষের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই কিংবা যাঁর কাছে আছে, তিনি খরচ করতে চাইছেন না।’