বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যার ৩৬ শতাংশ ব্যবহারের পরপরই ফেলে দেওয়া হয়। এর বড় অংশই এককালীন (সিঙ্গেল ইউজ) প্লাস্টিক; যেমন পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, খাবারের মোড়ক– যা সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশে থেকে যায়।

চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত হলেও, গত এক দশকে শহরটি ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের চাপে পড়েছে। প্রতিদিন সেখানে কয়েক হাজার টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে প্রায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিকের বড় অংশ যথাযথভাবে সংগ্রহ বা রিসাইক্লিং না হওয়ায় তা গিয়ে পড়ে খাল, ড্রেন, নালা ও কর্ণফুলী নদীতে। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়ায় শহরবাসীর নিত্যদিনের দুর্ভোগের কারণ।

পরিবেশগত দিক থেকেও চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। বৈশ্বিকভাবে প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারে আসে। তবে বাংলাদেশের চিত্র তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো– ঢাকায় রিসাইক্লিং হার প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে তা ৩১ শতাংশের মতো। তবুও বাকি বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য নানা পথে শেষ পর্যন্ত গিয়ে জমা হয় ডাস্টবিন, খোলা জায়গা, ড্রেন, নদী ও সমুদ্রে। এর ফলে সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে, উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস ও নদীপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, এমনকি এসব ক্ষতিকর বর্জ্য মানবদেহেও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে, যা দেশের সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য এক বড় বিপদ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

এই সংকট মোকাবিলায় চট্টগ্রামে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। নগরীর বাংলা বাজার এলাকার গৃহবধূ খাদিজা বেগম এখন তাঁর চার সদস্যের পরিবারে প্রতিদিন ঘর থেকেই আলাদা করে রাখেন এককালীন প্লাস্টিক। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এসব বর্জ্য ফেলার বদলে বিক্রি করবেন স্থানীয় রিসাইক্লারদের কাছে। এখন তিনি সপ্তাহে প্রায় এক কেজি প্লাস্টিক জমিয়ে বিক্রি করেন। এতে সামান্য আয় যেমন হচ্ছে, তেমনি এই অভ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর ছোট সন্তানদের মধ্যেও। খাদিজা বলেন, ‘আগে এসব প্যাকেট আর বোতল ড্রেনে ফেলতাম। এখন বুঝি, এগুলো জমলে পানি আটকে যায়, রোগ ছড়ায়। ঘর থেকেই যদি শুরু না করি, শহর পরিষ্কার হবে কীভাবে?’

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে পরিবারে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক নারী এখন স্থানীয়ভাবে পাটের ব্যাগ, কাগজের প্যাকেট ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসাও গড়ে তুলছেন– যা পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা গেলে এই দূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষাই নয়, জনস্বাস্থ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের অতি সূক্ষ্ম কণিকা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) এখন আমাদের খাদ্য, পানি এমনকি রক্তেও পাওয়া যাচ্ছে– যা ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা এবং শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বাড়ায়।

ঘরের ছোট একটি অভ্যাসই হতে পারে বৃহৎ পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা। পরিবেশের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ হোক দায়িত্বশীল ও স্থায়ী– আজ থেকেই।

শিক্ষার্থী
নৃবিজ্ঞান, তৃতীয় বর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য পর ব শ র ব যবহ র বর জ য

এছাড়াও পড়ুন:

সহানুভূতি: একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ

সহানুভূতি একটি শক্তিশালী মানবিক গুণ, যা আমাদেরকে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আবেগ ও অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করে। তাদের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ বা ভয়ের মতো অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে অনুভব করা যায়।

সহানুভূতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, যা রাসুল (সা.) তাঁর জীবনে বারবার প্রদর্শন করেছেন। সহানুভূতি অনুশীলনের পাঁচটি ধাপ নিয়ে আমরা আলোচনা করব, যা আমাদের জীবনে এই ভুলে যাওয়া সুন্নাহ পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে আশা করা যায়।

সহানুভূতি মানে অন্যের অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বোঝা।সহানুভূতি ও সমবেদনার পার্থক্য

সহানুভূতি (এমপ্যাথি) ও সমবেদনা (সিমপ্যাথি) প্রায়ই একই মনে হলেও এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সমবেদনা হলো অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করা বা তাদের দুঃখে দুঃখিত হওয়া। কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য দুঃখবোধ করা সমবেদনা। কিন্তু সহানুভূতি এর চেয়ে গভীর।

সহানুভূতি মানে অন্যের অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বোঝা। যেমন, একজন মা তার সন্তানের পড়ে যাওয়ার ব্যথা কেবল বুঝেন না, বরং নিজেও সেই ব্যথা অনুভব করেন। এই পার্থক্য বোঝা সহানুভূতির প্রকৃতি উপলব্ধি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫সহানুভূতির প্রকারভেদ

সহানুভূতির তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে, যা এই গুণটির বিভিন্ন দিক বুঝতে সাহায্য করে।

১. জ্ঞানগত সহানুভূতি

জ্ঞানগত সহানুভূতি হলো অন্যের পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা। একজন শিক্ষক যখন দেখেন তার ছাত্র পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তিনি ছাত্রের স্থানে নিজেকে কল্পনা করে প্রশ্নপত্রের কাঠিন্য অনুভব করেন। এই ধরনের সহানুভূতি মানুষকে অন্যের অবস্থান বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

২. আবেগগত সহানুভূতি

আবেগগত সহানুভূতি হলো অন্যের আবেগ নিজের মধ্যে অনুভব করা। এটি দুঃখ, আনন্দ, ভয় বা রাগের মতো অনুভূতিগুলো নিজে অনুভব করে তাদের তীব্রতা বোঝা। যেমন, একজন মা যখন তার সন্তানের পড়ে যাওয়ার ব্যথা দেখেন, তিনি কেবল ব্যথার কথা চিন্তা করেন না, বরং সেই ব্যথা নিজের মধ্যে অনুভব করেন। এই ধরনের সহানুভূতি মানুষের মধ্যে গভীর সংযোগ তৈরি করে।

তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল, যিনি তোমাদের কষ্টে কষ্ট পান, তোমাদের কল্যাণে আগ্রহী এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়।সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮

৩. নবীজির সহানুভূতি

মহানবী (সা.)-এর জীবন সহানুভূতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল, যিনি তোমাদের কষ্টে কষ্ট পান, তোমাদের কল্যাণে আগ্রহী এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়। ” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮)

রাসুল (সা.) কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, এমনকি অমুসলিমদের জন্যও উদ্বিগ্ন ছিলেন।

রাসুল (সা.)-এর জীবন থেকে সহানুভূতির উদাহরণ

তাঁর জীবন সহানুভূতির অসংখ্য উদাহরণে ভরপুর। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

১. ইকরিমা ইবন আবু জাহলের প্রতি সহানুভূতি

ইকরিমার পিতা আবু জাহল ছিলেন ইসলামের কট্টর শত্রু। বদরের যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এই সংবাদে ইকরিমা গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং মক্কায় রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। রাসুল (সা.) সাহাবীদের নির্দেশ দেন যেন তারা ইকরিমার পিতাকে ‘আবু জাহল’ (অজ্ঞতার পিতা) বলে না ডাকে, কারণ এটি ইকরিমার অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে। (ইবনে হিশাম, আস–সিরাত আন–নাবাবিয়্যা, ৪/৩২)

এমনকি ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি তার পিতার প্রতি তার সন্তানসুলভ ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। এটি সহানুভূতির একটি অসাধারণ উদাহরণ, যা দেখায় কীভাবে একজন নেতা শত্রুর সন্তানের প্রতিও সংবেদনশীল হতে পারেন।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-এর প্রথম ক্রন্দন১১ জুন ২০২৫

২. বিশর ইবনে উকবার প্রতি সান্ত্বনা

একটি সামরিক অভিযানে মদিনার একজন সাহাবী উকবা (রা.) শহীদ হন। অভিযান থেকে ফিরে আসা সাহাবীদের স্বাগত জানাতে রাসুল (সা.) মদিনার বাইরে যান। ছোট্ট বিশর তার পিতার জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু তার পিতাকে না দেখে সে বুঝতে পারে তার পিতা আর নেই। সে কাঁদতে থাকে। রাসুল তাকে দেখে তাঁর বাহন থেকে নেমে তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, “কেঁদো না। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবা হবো এবং আয়েশা হবে তোমার মা।” (ইমাম বুখারি, আত–তারিখ আল–কাবির, ২/৭৮; আলবানি, আস–সিলিসলাহ আস–সাহিহাহ, ৭/৭৫৪)

এই ঘটনা রাসুল (সা.)-এর গভীর সহানুভূতির প্রমাণ, যেখানে তিনি একটি শিশুর দুঃখ নিজের মধ্যে অনুভব করে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।

এ ছাড়াও হাদিসে আছে, তিনি শিশুর কান্না শুনে জামাতের নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন, যাতে মা অস্থির না হন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৭৮) এবং একজন বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করলে তিনি তাকে শাসন না করে শান্তভাবে বুঝিয়েছিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৫)

এই ঘটনাগুলো দেখায় যে রাসুল (সা.) কেবল তাঁর অনুসারীদের জন্য নয়, শত্রু, শিশু, এমনকি অমুসলিমদের প্রতিও গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন।

কেঁদো না। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবা হবো এবং আয়েশা হবে তোমার মা।হাদিস, ইমাম বুখারি, আত–তারিখ আল–কাবির, ২/৭৮সহানুভূতি অনুশীলনের পাঁচটি ধাপ

সহানুভূতি অনুশীলনের জন্য পাঁচটি ব্যবহারিক ধাপ রয়েছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই সুন্নাহকে প্রয়োগ করতে সাহায্য করতে পারে:

১. শোনা: কেউ যখন কিছু বলছে, তখন মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। এটি সহানুভূতির প্রথম ধাপ, যেখানে আমরা অন্যের কথা পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করি।

২. বিচার না করা: শোনার সময় বিচার করা সহানুভূতির বিপরীত। আমাদের উচিত সাহায্য করার মনোভাব নিয়ে শোনা, বিচার করার জন্য নয়।

৩. বোঝা: অন্যের পরিস্থিতি এবং আবেগ বোঝার জন্য বিচক্ষণতার প্রয়োজন। এটি জ্ঞানগত সহানুভূতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৪. কল্পনা করা: নিজেকে অন্যের জায়গায় কল্পনা করে তাদের আবেগ অনুভব করা। এটি আবেগগত সহানুভূতির মূল।

৫. প্রতিক্রিয়া জানানো: সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া মানে অন্যের সমস্যার প্রতি উপযুক্তভাবে সাড়া দেওয়া, এমনকি সমাধান দিতে না পারলেও। এটি মানুষের মধ্যে আস্থা ও সংযোগ তৈরি করে।

সহানুভূতির সীমাবদ্ধতা

মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত সহানুভূতি কখনো কখনো ক্ষতিকর হতে পারে। রাসুল (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন যে মানুষকে খুশি করার আগে আল্লাহকে খুশি করা উচিত। এটা মনে রাখলে সহানুভূতি আমাদের একটি স্বাস্থ্যকর সীমার মধ্যে রাখবে। হাদিসে বলা হয়েছে, “তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল, এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৯৩)

তাই সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি আমাদের দায়িত্ব পালনেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

আরও পড়ুনমহান আল্লাহর হাসি১১ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সহানুভূতি: একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ