প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকার মব ভায়োলেন্স সমর্থন করে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মব ভায়োলেন্স বন্ধ করতে হবে। বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ বলছেন, মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে বহুদিন ধরে।

তারপরও বাংলাদেশে একের পর এক মব ভায়োলেন্স বা সংঘবদ্ধ সহিংসতা ঘটছে। মবের কবলে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত ও নিগৃহীত হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ৭ মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন।

তাহলে দেশে আইনের শাসন কোথায়? মব থেকে উদ্ধারের উপায় কী? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও জনগণের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। আছে তাঁদের বিচারিক ক্ষমতাও। তারপরও সংঘবদ্ধ শক্তির আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা থামছে না।

গত বোরবার উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা করে। তারা তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে, ডিম ছুড়ে মেরেছে। এসব যখন তারা করছিল, তখন পুলিশ সদস্যরাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি; বরং সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল লোকজনই পুলিশের হাতে সাবেক সিইসিকে তুলে দিয়েছে।

এ ঘটনা ঘটেছে বিএনপির পক্ষ থেকে সাবেক তিন সিইসির বিরুদ্ধে মামলা করার কয়েক ঘণ্টা পর। দুপুরে মামলা। সন্ধ্যায় বিচারকার্য সম্পাদন! এটাই কি আইনের শাসনের নমুনা? যার যখন মনে হবে অমুক লোক অপরাধ করেছেন, তাঁর বাড়িতে ঢুকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসে মারধর করা হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে আওয়ামী লীগ আমলের মব ভায়োলেন্সের ছবি দেখিয়ে এখনকার মব ভায়োলেন্সকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ আমলেও মব ভায়োলেন্স নিয়ে প্রতিবাদ করা হলে তাঁরাও আগের আমলের ছবি দেখাতেন। তাহলে পরিবর্তনটা কী হলো। কেবল ‘শিকার’ ও ‘শিকারি’ বদল হয়েছে।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ করেছে। এর মাধ্যমে তিনি নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কে এম নূরুল হুদার নির্বাচনী মশকরা নিয়ে প্রথম আলোয় কয়েক ডজন লেখা লিখেছি। তাঁর কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছি। বিচার চেয়েছি। সাবেক সিইসিসহ আরও যেসব ব্যক্তি এ রকম জালিয়াতি ও কারচুপির নির্বাচন করেছেন, তাঁদের সবার বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু একদল লোক বাড়িতে গিয়ে অশীতিপর এই ব্যক্তির গলায় জুতা পরাবে, এটা হতে পারে না। এরপর আমরা কীভাবে দাবি করব যে সভ্য দুনিয়ায় আছি! গণতন্ত্র, শুভবোধ তো অনেক পরের কথা, আগে আমাদের সভ্য হতে হবে। অসভ্যতা ত্যাগ করতে হবে।

অতীতের মতো এবারও সরকার কাগুজে প্রতিবাদ করে দায়িত্ব শেষ করেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে হুংকার দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের হুংকার কোনো কাজে আসে না। সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ ও তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থী ও ফৌজদারি অপরাধ।’

গত বৃহস্পতিবার সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো.

শফিকুল ইসলাম মব ভায়োলেন্স ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেকোনো পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। মব ভায়োলেন্স অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

দেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় কোনো নাগরিক যদি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যায় আচরণের শিকার হন, এর প্রতিকারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না।

এর তিন দিন পর রোববার সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা ‘মবের’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিশৃঙ্খলা) শিকার হলেন। এ ঘটনা নিয়ে নাগরিক সমাজে সমালোচনা তৈরি হয়। হেনস্তাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিও ওঠে। যার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি আসে। মঙ্গলবার একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ঘটনার পর সরকারকে বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। কিন্তু ঘটনা রোধে সরকারকে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেছেন, সরকার শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় সারতে পারে না। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’

দেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় কোনো নাগরিক যদি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যায় আচরণের শিকার হন, এর প্রতিকারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না।

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাঁকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’

কিন্তু তারপরও যত্রতত্র মব ভায়োলেন্স ঘটেছে। এমনকি সুরক্ষিত আদালত অঙ্গনে আসামি ও তাঁদের পক্ষের আইনজীবীরা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এতে বিচারপ্রক্রিয়াই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে না, সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে এমন অরাজকতায় উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে কমপক্ষে ৮৩ জন নিহত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এসব গোষ্ঠীর অপকর্মে পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

সরকার আইনের শাসনের কথা বলবে, আবার মব ভায়োলেন্সকারীদের প্রশ্রয় দেবে, এই দ্বৈতনীতি চলতে পারে না। আমরা দেখতে চাই, প্রতিটি ঘটনার বিচার হবে। অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে। এখানে সামান্য শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নেই।

কে এম নূরুল হুদা কমিশনের রাতের ভোটই ছিল গত সাত বছরের অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়। এখন রাতের ভোট ছাপিয়ে আলোচনায় এল সাবেক সিইসির প্রতি মব ভায়োলেন্সের ঘটনা। এর মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের সহানুভূতিই পাবেন। এটা কি ন্যায়বিচারকামী সরকার চাইছিল?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র মব ভ য় ল ন স আইন ন জ র হ ত এম ন র ল হ দ ব যবস থ সরক র র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

আশুলিয়ায় প্রাইভেটকার ছিনতাই, জিপিএস ট্র্যাকিংয়ে যেভাবে টঙ্গি থেকে উদ্ধার

প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার বিকেলে আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানা থেকে তিন কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রাইভেটকারে ঢাকায় ফিরছিলেন চালক মনিরুল ইসলাম। বেড়িবাঁধের পঞ্চবটিতে যানবাহনের চাপে ধীরে ধীরে চলছিল গাড়ি। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। হঠাৎ প্রিমিও ব্রান্ডের প্রাইভেটকারের চালকের আসনের পাশ দিয়ে বাইরে থেকে রড ঢুকিয়ে দেয় এক দুর্বৃত্ত। এর পর গাড়ি সামনের দরজা খুলে আরও দু’জন চালককে মারধর করে বের করে আনেন। গাড়িতে থাকা বাকি তিন আরোহীকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হামলা করে তারা। এরপর গাড়িটি ছিনতাই করে তারা পালিয়ে যায়। 

এ ঘটনার সময় একই সড়কে একই কোম্পানির আরেকটি প্রাইভেটকার অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে আসছিলেন। সেই গাড়ির চালক রফিকুল ইসলাম ছিনতাইয়ের ঘটনাটি দেখতে পান। তখন নিজের প্রাইভেটকার রেখে দৌড়ে তিনি ছিনতাই হওয়া গাড়ির সামনের বনেটের ওপর লাফিয়ে উঠেন। তখন ছিনতাইকারী জোরে গাড়ি চালানোর পর বনেট থেকে তিনি ছিটকে পড়েন। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান শারমিন গ্রুপের প্রাইভেটকার ছিনতাইয়ের এমন ঘটনাটি ফোনে চালক ও হামলার শিকার অন্যরা জানান অফিসের অন্য কর্মকর্তাদের। এটি জানার পর কামরুজ্জামান ও সাজিদুল ইসলাম সম্রাট নামে দুই কর্মকর্তা গাড়ির জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করেন। তাদের মধ্যে কামরুজ্জামান ছিলেন আশুলিয়ার কর্মস্থলে। আর সম্রাট উত্তরায় তার বাসার কাছাকাছি। 

সম্রাট সমকালকে জানান, ট্র্যাকিং সিস্টেমে দেখা যায়–গাড়িটি বেরিবাঁধ উত্তরার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে গাজীপুরের দিকে যাচ্ছিল। এরপর সম্রাট মোটরসাইকেলে গাড়ির পিছু নেন। এক পর্যায়ে তারা বিষয়টি পুলিশকে জানান। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ কল করেন। গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারকে জানানো হয়। এর মধ্যে গ্রামীণ ফোনের সহায়তায় ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয় গাড়ির ইঞ্জিন। তখন প্রাইভেটকারটি ছিল টঙ্গী কলেজ গেটের কাছাকাছি। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পর বিপাকে পড়েন ছিনতাইকারীরা। তারা রাস্তায় পাশে গাড়িটি রেখে পালিয়ে যান। এরপর শারমিন গ্রুপের লোকজন ও পুলিশ গিয়ে রাত সাড়ে ৯টায় গাড়িটি উদ্ধার করে।

শারমিন গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, কোম্পানির কয়েকজন একটি টিম হিসেবে কাজ করে। তারা গাড়ির গতিবিধির ওপর নজর রাখে, পরে তা উদ্ধার করা হয়েছে। গাজীপুরের পুলিশও সহযোগিতা করেছে। উদ্ধারের পর প্রাইভেটকারের মধ্যে চাপাতি, রডসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র পাওয়া গেছে। এর আগে প্রাইভেটকারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের যে তিন কর্মকর্তা ছিলেন তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে তুরাগ থানায় জিডি করা হয়েছিল। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার সব ধরনের সহযোগিতা করেন।  
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ