যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিমান হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি। ভূগর্ভস্থ ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই হামলা দেশটির পারমাণবিক কার্যক্রম শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) প্রাথমিক মূল্যায়নে এমনটা বলা হয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ মূল্যায়ন প্রত্যাখ্যান করে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার দাবি করেছেন। খোদ ইরানও স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে। 

সিএনএন জানিয়েছে, ডিআইএর প্রাথমিক মূল্যায়ন ট্রাম্পের বারবার দাবির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ যে হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে। প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ গত রোববার বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। 

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি এবং হামলার প্রভাব নিয়ে নানা পক্ষের বিশ্লেষণ চলছে। তবে ডিআইএর মূল্যায়নসহ এখন পর্যন্ত যেগুলো সামনে আসছে, তার সবই আগের তথ্য বিশ্লেষণ এবং অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সুতরাং স্থাপনাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস, না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– তার প্রকৃত তথ্য এখনও অজানা। ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়ন করতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের অভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। 

এর আগে গত শনিবার অত্যাধুনিক বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান ব্যবহার করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই হামলাকে অত্যন্ত সফল বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন দিনের মাথায় পেন্টাগন এই নতুন তথ্য জানাচ্ছে। 

মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত দুই কর্মকর্তা বলেছেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ধ্বংস হয়নি। একজন বলেছেন, সেন্ট্রিফিউজগুলো মূলত অক্ষত। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম স্থাপনাগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই ডিআইএর মূল্যায়ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরমাণবিক কার্যক্রম কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। 

এই মূল্যায়নের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও হোয়াইট হাউস বলেছে, তারা এর সঙ্গে একমত নয়। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট এক বিবৃতিতে বলেন, এই কথিত মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভুল এবং অতি গোপনীয় হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। এটি ফাঁস করা প্রেসিডেন্টকে হেয় করার একটি চেষ্টা। সবাই জানে, ১৪টি ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমা লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে ফেলে দিলে কী হয়, সম্পূর্ণ ধ্বংস। 

ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, ইরানে মার্কিন হামলার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ শামিল। তিনি ফক্স নিউজকে বলেন, এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো এবং এটি অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। 

ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডসে থাকা ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টে লিখেছেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে সফল সামরিক হামলাগুলোর একটি। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। 

স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, ফর্দোর পারমাণবিক স্থাপনার দুটি প্রবেশপথের আশপাশে ছয়টি নতুন গর্ত এবং ধুলামাখা ধ্বংসস্তূপ। তবে সেই ছবিগুলো দেখে ভূগর্ভস্থ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যায় না। 

আইএইএর সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিতে সম্মতি ইরানের পার্লামেন্টের

ইরানের পার্লামেন্ট সদস্যরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি। 

ইসলামী পরামর্শদাতা পরিষদের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না। আইএইএ তাদের দায়িত্ব পালন করেনি এবং একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিলটিকে আইনে পরিণত করতে ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে। 

বিল অনুমোদনের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি সংস্থাটি। তবে গতকাল সংস্থাটির প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, ইরানে পরিদর্শকদের আবার পাঠানোর চেষ্টা করছেন তিনি। 

বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলাই দেশটিকে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে বাধ্য করেছে। নিয়মিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বিনা উস্কানিতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় নজিরবিহীন হামলার সরাসরি পরিণতি হলো এমন সিদ্ধান্ত।

আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে তেহরান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাঈ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা নিশ্চিত, কারণ এগুলোর ওপর একের পর এক হামলা হয়েছে। 

ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধের চেষ্টা করলে ফের হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র : ট্রাম্প 

ইরান যদি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করে, তাহলে আবারও হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, তারা বোমা বানাতে পারবে না এবং তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধও করতে পারবে না। 

ইরানে চালানো হামলাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে জাপানে আমেরিকার পারমাণবিক হামলার সঙ্গে তুলনা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, আমি হিরোশিমা বা নাগাসাকির উদাহরণ ব্যবহার করতে চাই না। তবে এটিও মূলত একই রকম ছিল। এর ফলেও যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। আমরা যদি এটি বন্ধ না করতাম, তাহলে তারা এখনও যুদ্ধ করত। আগামী সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা করতে যাচ্ছে বলেও জানান ট্রাম্প। 

গত ১৩ জুন ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার মাধ্যমে তেহরান-তেল আবিবের সংঘাতের শুরু হয়। তার পর থেকে দুই দেশ একে অপরের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়ে যায়। পরে গত সোমবার রাতে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। 

এদিকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে দু’পক্ষই জয়ী হওয়ার দাবি করেছে। মঙ্গলবার রাতে দেওয়া এক বার্তায় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেন, টানা ১২ দিনের আগ্রাসনের পর ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চূড়ান্ত জবাবে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যে ঐক্য ও প্রতিরোধ ধরে রেখে বিজয়ের পর যে গর্ব, তা জনগণের কারণেই এসেছে এবং এই জন্য তাদের নিজেদের নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত। 

এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, আমরা একটি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছি। এই বিজয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি দাবি করেন, ইরানের আরাক, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র ইসর য় ল বল ছ ন ত হয় ছ ইউর ন র ওপর ত হওয়

এছাড়াও পড়ুন:

সিআইএর এজেন্ট হয়েও রাশিয়ার জন্য কাজ করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন তিনি

সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে প্রায় এক দশক ধরে গোপন তথ্য বিক্রি করেছেন। এক শটির বেশি গোপন অভিযানের সঙ্গে আপস করেছেন এবং যার কারণে কমপক্ষে ১০টি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা চরম ক্ষতির শিকার হয়েছে।

এখানে যাঁর কথা বলা হচ্ছে তিনি মার্কিন ডাবল এজেন্ট (দ্বৈত গুপ্তচর) অলড্রিখ এইমস।

১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল এই ডাবল এজেন্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি এমন একজন গুপ্তচরের সঙ্গে কথা বলেছিল, যাঁর সঙ্গে এইমস বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।

১৯৮৫ সালে হঠাৎ করেই উধাও হতে শুরু করেন সিআইএর হয়ে কাজ করা সোভিয়েত এজেন্টরা। একে একে তাদের ধরে নিয়ে যায় এবং প্রায়ই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি।

ওলেগ গর্দিভস্কি ওই ডাবল এজেন্টদের একজন। লন্ডনে কেজিবির স্টেশন প্রধান হলেও তিনি গোপনে বছরের পর বছর যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬–এর জন্য কাজ করছিলেন।

একদিন মস্কোতে নিজেকে মাদকাসক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন গর্দিভস্কি এবং পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর ফায়ারিং স্কোয়াডে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হন। তবে অল্পের জন্য সেদিন প্রাণে বেঁচে যান গর্দিভস্কি। এমআই-৬ তাঁকে একটি গাড়িতে লুকিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পাঠিয়ে দেয়।

১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল এই ডাবল এজেন্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি এমন একজন গুপ্তচরের সঙ্গে কথা বলেছিল, যাঁর সঙ্গে এইমস বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।

এরপর গর্দিভস্কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, কে তাঁর সঙ্গে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

১৯৯৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গর্দিভস্কি নিউজনাইটের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসির টম ম্যাঙ্গোল্ডকে বলেন, ‘প্রায় ৯ বছর ধরে আমি অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম, কে সেই ব্যক্তি, কে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবে আমি কোনো উত্তর জানতাম না।’

দুই মাস পরে তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেন গর্দিভস্কি। ওই সময় প্রবীণ সিআইএ কর্মকর্তা অলড্রিখ এইমস মার্কিন আদালতে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, তিনি ‘সিআইএ এবং অন্যান্য মার্কিন ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত তাঁর পরিচিত সব সোভিয়েত এজেন্টদের’ তথ্য ফাঁস করেছেন।

১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল এইমস স্বীকার করেন, তিনি পশ্চিমাদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত ৩০ জনের বেশি এজেন্টের পরিচয় প্রকাশ করেছেন এবং ১০০টির বেশি গোপন অভিযানের তথ্য ফাঁস করেছেন।

কেজিবির কাছে কোলোকল (দ্য বেল) সাংকেতিক নামে পরিচিত ছিলেন এইমস, যাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে কমপক্ষে ১০টি সিআইএ গোয়েন্দা অ্যাসেট ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

ওই অ্যাসেটের মধ্যে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেনারেল দিমিত্রি পলিয়াকভও ছিলেন। যিনি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করেছিলেন।

মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর চর এইমসকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং প্যারোল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে ১৯৯৪ সালে বিবিসির টম ম্যাঙ্গোল্ড বলেন, ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাজ্যের গুপ্তচর কিম ফিলবির সোভিয়েত এজেন্ট হিসেবে প্রকাশ্যে আসার ঘটনা যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানটিকে যেভাবে নাড়া দিয়েছিল, ঠিক তেমনি এখন ওয়াশিংটনেরও উচিত, এইমস কী পরিমাণ ক্ষতি করেছেন, তা খতিয়ে দেখা।

সিআইএর সোভিয়েত কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান হিসেবে এইমসের ভূমিকাই তাঁকে এত ক্ষতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ফলে এইমস সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান গোপন অভিযানগুলো এবং মাঠে থাকা এজেন্টদের পরিচয়সহ নানা গোপনীয় তথ্যে অবাধ ঢুকতে পেরেছিলেন।

এইমসের এই অবস্থানের অর্থ ছিল, তিনি অন্যান্য পশ্চিমা গুপ্তচর সংস্থার আলোচনায়ও অংশ নিতে পারতেন।

এভাবেই যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তচর, কেজিবির কর্নেল গর্দিভস্কি সিআইএর এইমসের সংস্পর্শে আসেন। গর্দিভস্কি দুটি ব্রিটিশ সংস্থা এমআই-৬ এবং এমআই-৫–এর কাছে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য পৌঁছে দিচ্ছিলেন।

ম্যাঙ্গোল্ড বলেন, এসব বৈঠক এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যেখানে ‘কেজিবির শীর্ষ গোয়েন্দারা তাদের শীর্ষ বিদ্রোহীকেই ডিব্রিফিং করত।

গর্দিভস্কি জানান, ‘মার্কিনরা ডিব্রিফিংয়ে সত্যিই খুবই ভালো ছিল। আমি উৎসাহী ছিলাম। আমি মার্কিনদের পছন্দ করতাম। তাঁদের সঙ্গে আমার জ্ঞান ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি তিনি (এইমস) সেখানে বসেছিলেন। যার অর্থ হলো, আমার দেওয়া সব তথ্য এবং উত্তর তিনি অবশ্যই কেজিবিতে পৌঁছে দিতেন।’

১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল এইমস স্বীকার করেন, তিনি পশ্চিমাদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত ৩০ জনের বেশি এজেন্টের পরিচয় প্রকাশ করেছেন এবং ১০০টির বেশি গোপন অভিযানের তথ্য ফাঁস করেছেন।মদ্যপান ও বিবাহবিচ্ছেদ

অল্প বয়সেই গুপ্তচর জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন অলড্রিখ এইমস। তাঁর বাবা ছিলেন সিআইএর একজন বিশ্লেষক, যিনি তাঁর ছেলেকে কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পর এজেন্সিতে চাকরি পেতে সাহায্য করেছিলেন।

কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে এইমসের বিশ্বাসঘাতকতা করার সিদ্ধান্তের পেছনে তাঁর আদর্শগত সংশয়ের চেয়ে হয়তো তাঁর অর্থের প্রয়োজনই বেশি কাজ করেছে।

শুরুতে একজন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন অলড্রিখ এইমস। তাঁর স্ত্রী ন্যান্সি সেগেবার্থও সিআইএর এজেন্ট ছিলেন।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এইমসের স্ত্রী ন্যান্সি সেগেবার্থের সঙ্গে প্রথম তুরস্কে পোস্ট করা হয়েছিল এইমসকে। সেখানে তাঁকে বিদেশি এজেন্ট নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭২ সালের মধ্যে এইমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে সিআইএ সদর দপ্তরে ডেকে পাঠান। কারণ, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি মাঠপর্যায়ে কাজের জন্য উপযুক্ত নন।

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এইমস রুশ ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং সোভিয়েত গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ের অভিযানের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব পান।

মাদকাসক্ত হওয়ায় এইমসের বাবার সিআইএ ক্যারিয়ার স্থবির হয়ে গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে এইমসের নিজের অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর অগ্রগতিকেও ব্যাহত করতে শুরু করে।

১৯৮১ সালে মেক্সিকো সিটিতে ট্রাফিক দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন এইমস। তিনি এতটাই মদ্যপ ছিলেন যে পুলিশের প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেননি। এমনকি তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাঠানো মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে চিনতেও ব্যর্থ হন তিনি।

১৯৭২ সালে এইমসের মাতাল ও বিব্রতকর অবস্থায় সিআইএর এক নারী কর্মচারীর সঙ্গে দেখেন আরেকজন এজেন্ট। এইমসের উদাসীন মনোভাব কাজের জন্য মোটেই সহায়ক ছিল না।

১৯৭৬ সালে গোপন তথ্য ভর্তি একটি ব্রিফকেস সাবওয়েতেই রেখে যান এইমস।

নিজের কর্মজীবনকে আবার সঠিক পথে ফেরাতে স্ত্রীকে নিউইয়র্কের বাড়িতে রেখেই ১৯৮১ সালে বিদেশের মাটিতে (মেক্সিকো সিটি) দ্বিতীয়বারের মতো পোস্টিং নেন এইমস। কিন্তু আচরণ ও অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে তিনি নিজেকে একজন সিআইএ কর্মকর্তা হিসেবে প্রমাণে আবারও ব্যর্থ হন।

১৯৮১ সালে মেক্সিকো সিটিতে ট্রাফিক দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন এইমস। তিনি এতটাই মদ্যপ ছিলেন যে তিনি পুলিশের প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেননি। এমনকি তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাঠানো মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে চিনতেও ব্যর্থ হন তিনি।

দূতাবাসে এক কূটনৈতিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মাতাল অবস্থায় এক কিউবান কর্মকর্তার সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন এইমস। এ ঘটনার পরে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মদ্যপানের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করতে সিআইএকে সুপারিশ করেন তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন এইমসস। এটি তাঁর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৮২ সালের শেষের দিকে এইমস সিআইএতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কলম্বিয়ান সাংস্কৃতিক অ্যাটাশে মারিয়া দেল রোজারিও কাসাস দুপুইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। ধীরে ধীরে তাঁদের প্রেম তীব্র হয়ে ওঠে। নিজের প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে রোজারিওকে বিয়ে করে নিজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন এইমস।

১৯৮৬ সালে সিআইএর এত সংখ্যক অ্যাসেট হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং সংস্থার মধ্যে সেই গুপ্তচরের সন্ধান শুরু হয়। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে নজরের বাইরেই থেকে যান এইমস।

সিআইএতে নিজের মোটামুটি ভালো কাজের পরও এইমস ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকেন।

১৯৮৩ সালে এজেন্সির সদর দপ্তরে ফিরে আসার পর এইমসকে সোভিয়েত অভিযানের জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান করা হয়। এর ফলে তিনি সিআইএর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য পেতে সক্ষম হন।

বিবাহবিচ্ছেদের সমঝোতার অংশ হিসেবে ন্যান্সির সঙ্গে এইমস সম্মত হন যে তিনি দম্পতি হিসেবে তাঁদের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করবেন। পাশাপাশি মাসিক ভরণপোষণও চালিয়ে যাবেন।

কিন্তু নতুন স্ত্রী রোজারিওর ব্যয়বহুল রুচি, কেনাকাটার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও কলম্বিয়ায় তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘন ঘন ফোনকলের কারণে এইমসের আর্থিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

অ্যারিজোনার সিনেটর ডেনিস ডিকনসিনিকে এইমস বলেছিলেন, নিজের ক্রমবর্ধমান ঋণই তাঁকে গোপন তথ্য বিক্রি করার কথা ভাবতে বাধ্য করেছিল।

এইমস বলেন, ‘আমি প্রবল আর্থিক চাপ অনুভব করেছি। যার ফলে স্পষ্টতই আমি অতীতে বেশি প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছিলাম।’

নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা

এইমসের গ্রেপ্তারের তদন্তে জড়িত থাকা এফবিআই এজেন্ট লেসলি জি ওয়াইজার ২০১৫ সালে বিবিসির উইটনেস হিস্ট্রিকে বলেছিলেন, ‘এটি অর্থের বিষয় ছিল। আমার মনে হয় না, তিনি কখনো কাউকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে এটি তার চেয়েও বেশি কিছু ছিল।’

১৯৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল কিছুটা মদ্যপান করার পর এইমস সোজা ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসে প্রবেশ করেন। ভেতরে প্রবেশের পর অভ্যর্থনাকারীর হাতে কিছু ডাবল এজেন্টের নাম, সিআইএর একজন অভ্যন্তরীণ সদস্য হিসেবে তাঁর পরিচয়ের প্রমাণপত্র এবং ৫০ হাজার ডলার দাবি করে একটি নোট দেন।

সিনেটের একটি প্রতিবেদনে এইমস দাবি করেন, তিনি ভেবেছিলেন, এই কাজের মাধ্যমে নিজেকে আর্থিক অন্ধকার থেকে চিরতরে বের করতে পারবেন। কিন্তু দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন, ‘একটি সীমা অতিক্রম করেছি এবং কখনই পিছিয়ে আসতে পারব না।’

পরবর্তী ৯ বছর ধরে অনেক গোপন তথ্য দেওয়ার জন্য এইমসকে অর্থ দিয়েছিল কেজিবি।

এইমস মস্কোর মহাকাশ স্থাপনার সঙ্গে যুক্ত বার্তাযন্ত্র থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র গণনা করতে সক্ষম অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত, সবকিছুর বিবরণসহ গোপন নথি প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে সিআইএ থেকে বের করে আনতেন।

যেহেতু এইমসের কাজেই রুশ কূটনীতিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক জড়িত ছিল, তাই তিনি মাঝেমধ্যেই কোনো সন্দেহ ছাড়াই তাঁর পরিচালকদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে পারতেন। এমনকি পূর্বনির্ধারিত গোপন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের প্যাকেটও তিনি রেখে যেতেন, যাকে বলা হয় ‘ডেড ড্রপস’।

এফবিআই এজেন্ট লেসলি জি ওয়াইজার বলেন, যদি তিনি একটি ডেড ড্রপস দিতে চাইতেন, তাহলে আগে থেকেই একটি চিঠির বক্সকে চক দিয়ে চিহ্নিত করত এবং রুশরা সেই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারত, নথিপত্র এখানেই রাখা হয়েছে।

এফবিআই এজেন্ট লেসলি জি ওয়াইজার বলেন, পরে নথিগুলো সংগ্রহের সময় তারা চক চিহ্নটি মুছে ফেলত। তখন এইমসও নিশ্চিত হতেন, নথিপত্র স্থানান্তর নিরাপদে সম্পন্ন হয়েছে।

এইমসের গোপন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের কারণেই কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নে সিআইএর প্রায় সব গুপ্তচরকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে সেখানে তাঁদের মার্কিন গোপন অভিযান কার্যকরভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ওয়াইজার বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনো গুপ্তচর বা গোয়েন্দার কথা জানি না, যে হিউম্যান অ্যাসেটের দিক থেকে এত বেশি মানুষের জীবনহানি করেছে।’

১৯৮৬ সালে সিআইএর এত সংখ্যক অ্যাসেট হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং সংস্থার মধ্যে সেই গুপ্তচরের সন্ধান শুরু হয়। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে নজরের বাইরেই থেকে যান এইমস।

বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থও দেওয়া হয়েছিল এইমসকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে প্রায় ২৫ লাখ মার্কিন ডলার দিয়েছিল।

নিজের নতুন সম্পদ লুকানোর জন্যও খুব কম চেষ্টাই করেছিলেন এইমস। বছরে ৭০ হাজার ডলারের বেশি বেতন না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি নগদ ৫ লাখ ৪০ হাজার ডলারের একটি নতুন বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়ির উন্নতিতে কয়েক হাজার ডলার ব্যয়ের পাশাপাশি একটি জাগুয়ার গাড়িও কিনেছিলেন।

বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও ব্যয় এইমসকে আলোচনায় এনেছিল। এর ফলে ১৯৯৪ সালে ওয়াইজারের এফবিআই দলের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন।

এফবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেন এইমস। একটি আবেদনপত্রে নিজের গুপ্তচরবৃত্তির সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী রোজারিওর জন্য কম সাজা নিশ্চিত করা হয়।

এইমস স্বীকার করেন, রোজারিও তাঁর নগদ অর্থ এবং সোভিয়েতদের সঙ্গে বৈঠকের কথা জানতেন।

পাঁচ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পান রোজারিও।

কিন্তু সিআইএর একসময়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পরে ডাবল এজেন্ট পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়া এইমস ইন্ডিয়ানার টেরে হাউজের একটি মার্কিন ফেডারেল কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

আজ পর্যন্ত এইমস নিজের কর্মকাণ্ড বা এর ফলে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর জন্য খুব কমই অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন।

এফবিআই কর্মকর্তা ওয়াইজারের মতে, তাঁর নিজের সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা ছিল এইমসের। তাঁর মতে, ধরা পড়ার বিষয়ে অনুশোচনা করলেও গুপ্তচর হওয়ার জন্য কোনো অনুতাপ নেই তাঁর।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিআইএর এজেন্ট হয়েও রাশিয়ার জন্য কাজ করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন তিনি