জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকায় কক্সবাজার শহরের সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমানের নাম আছে। তিনি আওয়ামী লীগেরও নেতা। শহরে নিজের বাড়ি থাকার পরও ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন একই দলের নেত্রী টিপু সুলতানা। তালিকায় আরও আছেন স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলরের বোন ও তাঁর স্বামী।

কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী। এ নদীর পূর্ব-উত্তর পাড়ের খুরুশকুল এলাকায় গড়ে উঠছে ৪ হাজার ৪০৯ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুর জন্য আবাসন প্রকল্প। এখানে ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবন। ভবনগুলোর নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন নদী, গাছ ও ফুলের নামে। এখানে পয়োনিষ্কাশন ও রাস্তার নির্মাণকাজ এখনো চলছে।

২০১৭ সালে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে প্রথমবারের মতো নেওয়া জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আবাসন প্রকল্পে প্রকৃত উদ্বাস্তুদের অধিকাংশেরই ঠাঁই হয়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনেকেই প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন।

ফ্ল্যাট বরাদ্দে নানা অনিয়মের বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরকে জানিয়েছি। এখন যে সিদ্ধান্ত আসে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন, জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার

স্থানীয় সমিতি পাড়ার বাসিন্দা ফারুকুন্নেছা অভিযোগ করেন, এক দশকের বেশি সময় এখানে আছেন। অথচ এখানে থাকেন না—এমন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু উদ্বাস্তু পাড়ার অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তি মো.

নুরুল্লাহ (৭৫) গত ১৮ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ থেকে ৪৫ বছর ধরে এখানে বাস করছি। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে এখন উচ্ছেদ হতে হবে। কিন্তু তালিকায় আমার নাম নাই। কাউন্সিলরের কাছে গিয়েছি কয়েকবার। আশ্বাস দিলেও তালিকায় নাম তোলেননি। আমার ছয় ছেলের ছয়টি পরিবার। প্রথম তালিকায় তাঁদের নাম ছিল। হালনাগাদ করার সময় এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্ল্যাট বরাদ্দে নানা অনিয়মের বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরকে জানিয়েছি। এখন যে সিদ্ধান্ত আসে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’

কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করার সময় উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য মূলত আবাসন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। বসতিগুলো ছিল খুরুশকুলের পশ্চিম পাশে। এখানকার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরার টেক, মোস্তাকপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনার ডেইল, কুতুবদিয়াপাড়া, বাসিন্নাপাড়াসহ মোট ২১টি মহল্লা। এর সব কটিই সরকারের খাসজমি।

২০১৭ সালে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে কক্সবাজারের দ্বীপ অঞ্চল মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার বাস্তুচ্যুত লোকজন ১৯৮১ সাল থেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে জনবসতি গড়ে তুলেছিলেন। বিমানবন্দরের জন্য তাঁদেরই উঠিয়ে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তারপর পুনর্বাসনের জন্য ২০১১ সালের দিকে ২১ মহল্লার ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারের একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এস আই এম আকতার কামাল, জেলা প্রশাসন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে এ তালিকা প্রণয়ন করেন। ২০১৬ সালে ওই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এ সময় বাদ দেওয়া হয় এক হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তুকে।

নীতিমালা ভেঙে প্রভাবশালীদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, তালিকায় কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ২১ মহল্লার হতদরিদ্র ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ তালিকায় যেমন আছেন তৎকালীন সরকারি দলের লোকজন, তেমনি আছেন এখনকার বড় দলের প্রভাবশালীরাও।

ফ্ল্যাট পেয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামালের বোন মিনা বেগম ও তাঁর স্বামী খালেদ মোশাররফ। এই দম্পতি কুতুবদিয়ায় থাকেন, তাঁরা ২১ মহল্লার বাসিন্দা নন। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন বিএনপির ১ নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব শাখার সভাপতি আবুল বশর, পশ্চিম শাখার সভাপতি সাবেরের মেয়ে তানিয়া, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা নুর উদ্দিন, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আতিক উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজ উদ্দিন, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রোজিনা আক্তার, ওয়ার্ড যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের নেত্রী টিপু সুলতানা এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক মো. হানিফ। এ ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত খোরশেদ, আবু তাহের, সিরাজুল করিম ও জিল্লুল করিম।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবর রহমান, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক সরওয়ার আলম ও জেলা যুবদলের তৎকালীন আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক দিদারুল ইসলাম। এ ছাড়া তালিকায় স্বামী ও স্ত্রী দুজনের নামেই ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ ও তালিকায় উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে—জানতে চাইলে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প এলাকায় বসবাস করার একটা নীতিমালা আছে। কিন্তু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো নীতিমালা ছিল না। ২০১১ সালে সরেজমিনে যাঁদের পাওয়া গেছে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তালিকা আবার হালনাগাদ হয়। সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল ফ্ল্যাট বরাদ্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো নীতিমালা ছিল না বললেও জেলা প্রশাসন থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয় ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা আছে। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কারা হতদরিদ্র, কারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল—এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে যাঁরা ক্লাইমেট রিফিউজি, তাঁরা ৯৯ পারসেন্ট গরিব।’

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত আধুনিক ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ ল য ট বর দ দ ন ল গ র তৎক ল ন আকত র ক ম ল প রথম আল ক ন প রকল প তৎক ল ন স প রকল প র র জন য পর ব র জলব য় মহল ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

এবার পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবিতে কেএমপি ঘেরাও, সড়ক অবরোধ

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগের দাবিতে কেএমপি ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা থেকে তারা কেএমপির সামনের সড়ক অবরোধ ও সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পুলিশের এসআই সুকান্ত দাসকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) ও চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের একটি যৌথ দল চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ