রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে আটক নেতা মুক্তি পেলে তাঁর অনুসারীরা জেল গেটে গিয়ে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে বরণ করে নেন। এই রেওয়াজ বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনীতিতে বহু পুরোনো। কিন্তু নারী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছেন, এমন ব্যক্তিরা মুক্তি পেলে তাঁদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার একটা প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। নানা নেতিবাচক মাত্রিকতা থাকার কারণেই এ প্রবণতা উদ্বেগজনক। কেননা, এখানে নিছক শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফুল দিয়ে বরণ করে অপরাধকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উসকে দেওয়া হয়।

মার্চ ও মে—দুই মাসের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ ধরনের দুটি ঘটনা ঘটেছে। দুই ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে তাঁর পোশাকের জন্য প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা হয়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ওপর ঘটা সহিংসতার বর্ণনা দিয়ে পোস্ট দেন। সেটিও ভাইরাল হয়। নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে অপরাধীকে গ্রেপ্তারে চাপ তৈরি হয়। একপর্যায়ে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

কিন্তু এরপরের ঘটনাপ্রবাহ ছিল এককথায় বাংলাদেশের সমাজের জন্য অচিন্তনীয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল লোক ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীকে মুক্ত করার জন্য শাহবাগ থানা ঘেরাও কর্মসূচি দেন। ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো একটি মব সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত থানা ঘেরাও করে রাখেন। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীকে নিয়ে চলতে থাকে বুলিং। তাঁর ইনবক্সে হুমকিও আসতে থাকে। তিনি বাধ্য হন অভিযোগ তুলে নিতে। মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি জুলাই আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। হতাশায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

যা–ই হোক, অভিযোগ তুলে নেওয়ার পর অপরাধীকে জামিন দেন আদালত। এরপর তৌহিদি জনতার নামে তাঁর গলায় ফুলের মালা দিয়ে এবং মাথায় পাগড়ি পরিয়ে বরণ করা হয়।

অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট না হলেও তাঁর পক্ষে যেটা ঘটেছে, সেটা ভীষণ রাজনৈতিক। সেই রাজনীতিটা নারীবিদ্বেষী, নারীর অগ্রযাত্রাকে পেছনে টেনে ধরার পক্ষের।

একদিকে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে নেতৃত্ব দেওয়া নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফার মন্তব্য দিয়ে শেষের শুরুটা করা যাক। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘অপরাধীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা ভয়াবহ বার্তা দেয় এবং সেই বার্তাটি হলো নারী নিপীড়ন স্বাভাবিকের চেয়েও বড় বীরত্ব।’

দ্বিতীয় ঘটনাটি আমরা দেখলাম চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলায় জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস ও মুক্তি পান। এর প্রতিবাদে কর্মসূচি দেয় বামপন্থী সংগঠনগুলো। সেই কর্মসূচি চলাকালে একটি বাম ছাত্রসংগঠনের নারী কর্মীকে পেছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেন শাহবাগবিরোধী ঐক্য নামের একটি সংগঠনের কর্মী। এই লাথি মারার ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।

সমালোচনার মুখে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তিনি জামিন পান। আইনে জামিন পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের আছে। কিন্তু জামিন পাওয়া আকাশকেও ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ঢাকা আর চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার হলেও এ দুটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। কেননা, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের নারীরা, বিশেষ করে সামনের কাতারের মুখগুলো সামাজিক পরিসর ও ডিজিটাল পরিসর—দুই জায়গাতেই কোনো কোনো গোষ্ঠীর দিক থেকে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ একসময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ নানা সমস্যার পরও এখন যে বিশ্বের ৩১তম অর্থনীতি, তার পেছনে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। কয়েক দশকের এই অগ্রগতির ফলেই লিঙ্গসমতার দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২৫ সেই তথ্যই দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত তরুণকে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অপর ধ ক র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

এনসিপি নেতাকে ‘প্রস্তুত হ রাজাকার’ চিরকুটের সঙ্গে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হুমকি

রাজশাহীতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বাড়ির সামনে ‘প্রস্তুত হ রাজাকার’ লেখা একটি চিরকুটের সঙ্গে কাফনের কাপড় ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শনিবার রাতে জেলার মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

ওই নেতার নাম খালিদ হাসান ওরফে মিলু। তিনি এনসিপির রাজশাহী জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সংগঠক। জেলার মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে তাঁর বাড়ি।

চিরকুটে লেখা ছিল, ‘প্রস্তুত হ রাজাকার। বাপ-মায়ের দোয়া নে। তোদের দিন শেষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ ওই রাতে খালিদ হাসানের বাড়িতে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয় বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

এনসিপি নেতা খালিদ হাসান জানান, শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বাড়িতে যান। এরপর ঘরের মধ্যে বসে ছিলেন। হঠাৎ জানালার পাশ দিয়ে অপরিচিত একজন বলেন, ‘বাইরে বের হয়ে দেখ।’ এরপর তিনি বারান্দায় গিয়ে দেখেন, টিনের সঙ্গে থাকা কাঠের আড়ায় আগুন জ্বলছে। এ সময় তিনি পেট্রলের গন্ধ পান।

খালিদ হাসান বলেন, এ ঘটনার পর তিনি বাড়ি থেকে বের না হয়ে প্রতিবেশীদের ডাকেন। ধুরইল বাজারের নৈশপ্রহরীও আসেন। ইতিমধ্যে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। এরপর তিনি বাড়ি থেকে বের হলে সামনে একটি পলিথিন দেখতে পান। পলিথিনে কী আছে না জেনে তাঁরা সেটিতে হাত দেননি। পুলিশ আসার পর সেটি দেখে। তখন ভেতরে একটি কাফনের কাপড় ও চিরকুট পাওয়া যায়। পরে চিরকুট ও কাফনের কাপড়টি পুলিশ নিয়ে যায়।

খালিদ হাসান বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে বাড়ি ভেজা অবস্থায় আছে। এ জন্য পেট্রল ঢাললেও আগুন ছড়িয়ে পড়েনি। যেটুকু আগুন লেগেছিল, সেটা আমরা নিভিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম। এখন এমন হুমকি পাওয়ায় আমি উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। চিরকুটে জয় বাংলা লেখা আছে। তাতে বোঝা যায়, কারা করেছে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করব।’

মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, ‘রাত পৌনে ১২টার দিকে খবর পেয়েই সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। আমি খালিদ হাসানকে অভিযোগ দিতে বলেছি। অভিযোগ পাওয়ার পর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি।’

এনসিপির রাজশাহী জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত থানায় একটি জিডি করা হবে। তারপর পুলিশ তদন্ত করে ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন করবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রেমের টানে চীনা যুবক দিনাজপুরে, মুসলিম হয়ে করলেন বিয়ে 
  • ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ ২২ দল, আছে ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’ও
  • শ্রেণিকক্ষে বিষমিশ্রিত পানি খেয়ে ৫ শিক্ষার্থী হাসপাতালে
  • ঘর থেকে তুলে নিয়ে চুরির অপবাদে নির্যাতনের শিকার জাকিরের চোখ হারানোর শঙ্কা
  • নেই মেসি, হারল মায়ামি
  • প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণের কাছে কোহলি-ডি ভিলিয়ার্সের ফোন, এরপর যা ঘটল
  • ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বসিয়ে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে: শফিকুল আলম
  • এনসিপি নেতাকে ‘প্রস্তুত হ রাজাকার’ চিরকুটের সঙ্গে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হুমকি
  • এসব উপকারিতা জানলে আপনিও সাঁতার শুরু করবেন
  • তিন বিভাগে বৃষ্টি বাড়তে পারে