সরকারের উচিত সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করা ও কর সুবিধা দেওয়া। এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ‘সিঙ্গেল উইন্ডো সার্ভিস’ বা এক জায়গা থেকে সেবা চালু করা উচিত

সমকাল: অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স এসএমই খাতে কীভাবে ভূমিকা রাখছে? 
মো. সাইফুল ইসলাম: এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এটি দেশের মোট জিডিপির একটি বড় অংশে অবদান রাখে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, নারী উদ্যোক্তা ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এসএমই খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স আমাদের প্রতিষ্ঠান এসএমই উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ সেবা দিয়ে থাকে। আমরা ব্যবসা শুরু করা বা সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় বাজার সংযোগ, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং ব্র্যান্ডিংয়ে সহায়তা দেই। বিশেষ করে নবীন ও নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে।
সমকাল: এসএমই খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন হচ্ছে? অর্থায়নের প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
মো.

সাইফুল ইসলাম: দুঃখজনকভাবে এসএমই খাতে এখনও পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। মূলত ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার জটিলতা, জামানতসংক্রান্ত বাধা, উদ্যোক্তাদের আর্থিক সাক্ষরতার অভাব এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্রের ঘাটতি এ খাতে অর্থায়নের বড় প্রতিবন্ধকতা। অনেক সময় ব্যাংকগুলোও এসএমইকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে অর্থায়নে অনাগ্রহ দেখায়।
সমকাল: এ খাতের উন্নয়নে সরকারের দিক থেকে কী কী করা উচিত?
মো. সাইফুল ইসলাম: সরকারের উচিত সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করা ও কর সুবিধা দেওয়া। এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ‘সিঙ্গেল উইন্ডো সার্ভিস’ বা এক জায়গা থেকে সেবা চালু করা উচিত। বাজারে প্রবেশাধিকারে সহায়তা দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন।
সমকাল: এসএমই খাতে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে করণীয় কী?
মো. সাইফুল ইসলাম: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। তাছাড়া পরিবার ও সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক গড়তে সহায়তা করতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
সমকাল: এসএমই খাতের উন্নয়নে আপনার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।
মো. সাইফুল ইসলাম: আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে– এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল ট্রেনিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি, মার্কেটিং ও ই-কমার্সে সহায়তা বাড়ানো, স্টার্টআপ ও উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলোর জন্য বিশেষ ফান্ড তৈরি এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম সম্প্রসারণ। আমরা বিশ্বাস করি, এসএমই খাতকে শক্তিশালী করলেই একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়া সম্ভব।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এসএমই খ ত সমক ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষুদ্র উদ্যোগই বাংলাদেশকে নীরবে এগিয়ে নিচ্ছে

দেশের অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান পণ্যের ব্র্যান্ডিং, প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, বাজারসাপেক্ষে দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন মৌলিক ব্যবসায়িক দক্ষতার ঘাটতিতে ভুগছে

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে একটি ছোট কারখানা, যেখানে কয়েকজন নারী প্রতিদিন নিজ হাতে তৈরি করছেন পাটের ব্যাগ। শহরের গলিতে তরুণ উদ্যোক্তা তাঁর ক্ষুদ্র কফিশপে বানাচ্ছেন নতুন স্বাদের পানীয়। মফস্বলের কোনো কিশোরী তার ছোট্ট টেইলারিং শপে বসে ভবিষ্যতে কোনো একদিন নিজের একটা বুটিক ব্র্যান্ড বানানোর স্বপ্নে নোটখাতায় এঁকে চলেছে নতুন সব ডিজাইন। এমন হাজারো স্বপ্ন, হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোগই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে নীরবে। এসব স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে আমাদের করণীয় কী?
আজ আন্তর্জাতিক এসএমই দিবসে আমরা যখন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প খাতের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছি, তখন এসব উদ্যোগের টিকে থাকা এবং লাভজনকভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। শিল্প খাতের ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সেই সঙ্গে দেশের জিডিপিতেও ৩০ শতাংশের কাছাকাছি অবদান রেখে খাতটি বিগত বছরগুলোতে প্রমাণ করেছে, সংকট মোকাবিলা করে টিকে থাকা ও এগিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও সম্ভাবনা দুটোই এর রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়ন্ত দাম, বাজারে চাহিদার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে এসএমই খাতের অনেক উদ্যোক্তাই চাপের মুখে রয়েছেন। ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমেছে, যার বিপরীতে নতুন বিনিয়োগ হয়েছে হাতে গোনা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঋণ বিতরণে প্রায় ১৩ শতাংশ পতন এরই প্রমাণ দেয়। তবে ২০২৫ সাল আমাদের জন্য আবার আশার আলো নিয়ে এসেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এসএমই খাতকে ঘিরে বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, আগামী তিন অর্থবছরে দেশে অন্তত ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ২৫ হাজার উদ্যোক্তাকে দক্ষতা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা জানান দেয়, আগামীতে দেশের এসএমই খাতে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব কমে আসবে। বিভাগীয় শহরগুলোতে এসএমই পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ এসএমই ব্যবসার প্রসার ও লাভজনকতা বাড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে দেশের ১০ হাজার এসএমই উদ্যোক্তাকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। জেলা শহরগুলোতে আঞ্চলিক এসএমই মেলার আয়োজন, নারী উদ্যোক্তাদের করপোরেট ক্রেতাদের সঙ্গে ডিজিটাল সংযোগ গঠন, কেন্দ্রীয় এসএমই তথ্যভান্ডার তৈরির পরিকল্পনাসহ অন্যান্য উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাস্তবভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এসএমই সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
তবে কেবল আর্থিক সহায়তা দিয়েই সম্ভাবনাময় খাতটি পুরোপুরি গতিশীল হতে পারবে না। দেশের অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান পণ্যের ব্র্যান্ডিং, প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, বাজারসাপেক্ষে দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন মৌলিক ব্যবসায়িক দক্ষতার ঘাটতিতে ভুগছে। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা প্রথাগত ও ডিজিটাল বিপণনের পার্থক্য জানেন না। কেমনভাবে নিজেদের উন্নত মানসম্পন্ন পণ্যকে জেলা, বিভাগ এমনকি দেশের সীমার বাইরে ক্রেতার সামনে তুলে ধরা যায়, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। ই-কমার্সের যুগেও এমন পিছিয়ে পড়া উদ্যোক্তাদের 

জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ জরুরি। বাজেটে প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ থাকলেও এর বাস্তবায়নে মনোযোগ না দিলে আশানুরূপ কার্যকারিতা আসবে না।

এসএমই খাতের অবকাঠামো উন্নয়নের আলোচনায় আরও একটি বিবেচ্য বিষয় হলো, ২০১৯ সালের এসএমই নীতিমালার মেয়াদ ২০২৪ সালেই শেষ হয়ে গেছে। ‘বৈষম্যহীন টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষমতায়ন’– এই রূপকল্প সামনে রেখে সম্প্রতি খসড়া এসএমই নীতিমালা ২০২৫ প্রণীত হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৩৫ শতাংশে উন্নীতকরণ। একটি নতুন, সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী নীতিমালার অধীনে আমাদের বর্তমানের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দুটিকেই সমানভাবে আমলে নিতে হবে। 

এসএমই ব্যবসা পরিচালনায় আইনি ও প্রশাসনিক শর্ত সহজ করা, কর ব্যবস্থা সহজ ও যৌক্তিক করা এবং রপ্তানিমুখী এসএমই খাতকে বিনিয়োগ, রাজস্ব ও অন্যান্য প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন নতুন কর্মকৌশলকে আমাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। এসএমই খাতের উন্নয়নে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি জাতীয় এসএমই উন্নয়ন পরিষদ যেন দেশের লাখো তরুণ উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা ও সমাধানের একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হতে পারে, সেই আশাবাদও ব্যক্ত করি।

সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রদানে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও নিজেদের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং স্কিমের আওতায় এ খাতে ঋণসুবিধা সহজলভ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স। একটি ‘ডিজিটালাইজড ও অ্যাসিস্টিভ’ মডেলে আমাদের এসএমই অর্থায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী রিলেশনশিপ ম্যানেজারের সহায়তা, বিনামূল্যের ডিজিটাল লোন স্টেটমেন্ট ইত্যাদি সুবিধাও দিয়ে থাকে আইডিএলসি। বাংলাদেশে আমরাই প্রথম লোন ওরিজিনেশন সিস্টেম ও ক্রেডিট স্কোরকার্ডের ব্যবহার শুরু করি, যা গ্রাহকদের জন্য অর্থায়ন প্রাপ্তির সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছে। এছাড়া আমরা ২০১৬ সাল থেকে ‘আইডিএলসি এসএমই পূর্ণতা’ নামে একটি বিশেষায়িত পণ্য চালু রেখেছি, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৭ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা নিজেদের ব্যবসায়ের স্বপ্নকে বাস্তব রূপদানে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।

বাংলাদেশের এসএমই খাতের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন টিকে থাকার শক্তিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহসে রূপ দেওয়ার মতো পরিবেশ ও অবকাঠামো। সেই পরিবেশ যদি তৈরি করা যায়, তাহলে ছোট প্রতিটি উদ্যোগ একদিন দেশের অর্থনীতির বড় প্রভাবক হয়ে উঠবে। ধীরে ধীরে হলেও দেশের মূল্যস্ফীতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসছে। সুদের হার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। এখনই দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যথাযথ সহযোগিতা ও সময়োচিত নীতির ভিত্তিতে দেশের সম্ভাবনাময় এসএমই খাতের জন্য একটি শক্ত ভিত গড়ে তোলা। 


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্র্যাংক ব্যাংকের বেশির ভাগ এসএমই ঋণ জামানতবিহীন
  • আমাদের বিনিয়োগের ৩০% এসএমইতে
  • এসএমই খাতের বিকাশই অর্থনীতির বিকাশ
  • অর্থনীতির প্রাণ ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ
  • পাঁচ বছরে ১৪৪ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ
  • কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ রয়েছে
  • আমরা আরও প্রযুক্তিনির্ভর ঋণ প্রক্রিয়া চালু করব
  • ক্ষুদ্র উদ্যোগই বাংলাদেশকে নীরবে এগিয়ে নিচ্ছে
  • ব্যাংক ঋণে অস্থাবর সম্পত্তিকে জামানত হিসেবে গ্রহণের তাগিদ